চট্টগ্রামে আয়াত নামের ৫ বছরের একটি ফুটফুটে বাচ্চাকে অপহরণ করে খুন করে ছয় টুকরা করে স্লুইস গেইটে ফেলা দিয়েছে আবির আলী নামের ১৯ বছরের এক যুবক। গত ১৫ নভেম্বর থেকে বাচ্চাটি নিখোঁজ ছিল। কী সুন্দর মুখটা। এখন বিশ্বকাপের উৎসব চলছে দেশে আর আয়াতের যে ছবিটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে সেটিও আর্জেন্টিনা দলের জার্সি গায়ে দেয়া।
Advertisement
এই যে ১৯ বছরের একটি ছেলে ৫ বছরের একটি বাচ্চাকে তুলে নিয়ে পরিকল্পনা করে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করলো এই ঘটনাটি আমার কাছে স্বাভাবিক চিত্র মনে হচ্ছেনা। এই ছেলেটির পরিবার আয়াতের বাবার বাসায় ভাড়া থাকতো অনেকবছর ধরেই। জানা যায় অনেকটাই পরিবারের মত সম্পর্ক ছিল তাদের। আয়াত আবিরকে চাচ্চু বলে সম্বোধন করতো। বাবা মায়ের আলাদা হবার সিদ্ধান্তের কারণে আবির আলী তার মায়ের সাথে ভিন্ন বাসায় থাকলেও তার বাবা থাকতো আয়াতদের বাসাতেই। আবির প্রায়শই আসা যাওয়া করতো।
পিবিআই এর কাছে স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্যে আবির যে বর্ণনা দিয়েছে সেটি পড়ে আমার গা শিউড়ে উঠেছে বারবার। আবির নিজেওতো এখনও বাচ্চা একটি ছেলে। সে কেন এই লাইনে গেল? কেমন করে সাহস করলো এই বাচ্চাটিকে আরবি পড়তে যাওয়ার পথে তুলে নিয়ে হত্যা করে বস্তা বন্দি করা? কেবল তাই নয়। আয়াতের বাসার সবাই যখন পাগলের মত তাদের সন্তানকে খুঁজছিল তখন এই আবির নিজেও তাদের সাথে উদ্বিগ্ন চেহারায় আয়াতের খোঁজ করেছে। বাসায় এসেছে। তার মা ও বোনকে নিখোঁজ সংবাদ দিয়ে আয়াতের পরিবারের পাশে থাকার জন্য তাদেরকে পাঠিয়েছে। এই ফাঁকে সে আগে থেকে খুন করা আয়াতের লাশকে কেটে টুকরা করেছে। এতটুকু পড়েই আমি স্তব্দ হয়ে ভাবছি কেন এই ছেলেটা এতো অল্প বয়সে তারই পারিবারিক পরিচিত বাচ্চাটাকে তুলে নিয়ে এমন নিষ্ঠুরভাবে খুন করলো?
সাহস করে আবার পড়া শুরু করলাম। বুঝতে চাইলাম সে কেন এমনটা করলো? গ্রেফতারের পর কী তার প্রতিক্রিয়া বা কোন অনুশোচনা হচ্ছে কি না? একে একে সবগুলো রিপোর্ট পড়লাম। যে জায়গায় এই সংবাদ এসেছে সেটি পড়ে বুঝার চেষ্টা করলাম। যত পড়ছি শিউড়ে উঠছি কেবল। সে অপহরণের পরিকল্পনা করে রেখেছে অনেক আগেই। মওকামত সেটি সফলতার সাথে করতে পেরেছে কিন্তু সামলাতে পারেনি। আয়াতের চিৎকার আর চারদিকের খোঁজাখুঁজির কারণে সে আয়াতকে হত্যা করে বস্তায় ভরে। সেই লাশকে নিজের বাসায় নিয়ে আসে। এবং পরবর্তীতে মা ও বোনকে আয়াতের পরিবারের কাছে পাঠিয়ে লাশ কেটে টুকরা করে। ভাবা যায় একটা ১৯ বছরের ছেলে এগুলো শিখলো কোথা থেকে?
Advertisement
সেই উত্তরও পেলাম। সে এগুলো শিখেছে ভারতীয় জনপ্রিয় ক্রাইম সিরিয়াল ক্রাইম পেট্রোল দেখে। গ্রেফতারের পর সে যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে বা পত্রিকার ভাষায় যে দম্ভ দেখিয়েছে তার পুরোটাই এই সিরিয়ালের প্রভাব বলেই আমার মনে হয়েছে। কারণ সেই সিরিয়ালে দেখায় কেমন করে খুন করার পরিকল্পনা করতে হয়, কেমন করে লাশ গুম করতে হয়। কেমন করে আলামত লুকিয়ে নিজেকে নিরপরাধ মানুষ বানানো যায়। আবিরও সিরিয়াল থেকেই শিখেছে এবং সে এইটা স্বীকারও করেছে যে সে এই খুনের কোন আলামত রাখেনি। পুলিশ চাইলেও কিছু করতে পারবে না। অর্থাৎ, তার মনোজগতে কোন অপরাধবোধ কাজ করছে না। সে আর নিজের মধ্যে নেই। একটা অবাস্তব জগতের বাসিন্দা হয়ে গেছে আবির। ঠিক একই সিরিয়াল দেখে খুন করার ঘটনার সংবাদ আরও আছে।
ভারতের এই সিরিয়াল অত্যন্ত জনপ্রিয় আমাদের দেশেও। ভারতে এর প্রভাব নিয়ে প্রচুর আলোচনার কথা পড়েছি অনলাইনে। এই সিরিয়ালগুলো বাস্তবে অপরাধ দমন না শিখিয়ে অপরাধকে উস্কে দেয়। এমনভাবে বিষয়গুলো চিত্রায়ন করা হয় যে একজন মানুষের মগজের মধ্যে পরিবর্তন আসা অসম্ভব নয়। সত্য ঘটনার আলোকে তৈরি হলেও এই ধরনের ক্রাইম সিরিয়ালগুলোর প্রভাব সমাজে নেতিবাচকভাবেই পড়ছে। বিশেষ করে কম বয়সীদের মধ্যে এর প্রভাব অত্যন্ত মারাত্মক। এর উপর অনেক গবেষণা হয়েছে। ২০০৬ সালের এক গবেষণা রিপোর্ট বলছে ক্রাইম সিরিয়ালগুলোর প্রভাব কিশোর অপরাধ বৃদ্ধিতে বিশেষ প্রভাব রাখে কারণ তারা সিরিয়ালে দেখানো বিষয়কে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুলভাবে গ্রহণ করে বা বুঝে। ২০১৭ সালে আব্দুল্লাহ নামের একজনের একটি গবেষণাপত্র বলছে এইসব সিরিয়াল মানুষের মধ্যে আচরণগত পরিবর্তন নিয়ে আসে যা নেতিবাচক হয়। ইউনেস্কোর ১৯৯৭ সালের এক রিপোর্টেও একই ধরনের কথাই বলা হয়েছে।
ক্রাইম সিরিয়াল গোটা বিশ্বেই জনপ্রিয় বিষয়। আমাদের দেশে এখনও মানুষ ভারতীয় ক্রাইম সিরিয়ালগুলোই দেখে বেশি। এর মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় হচ্ছে ক্রাইম পেট্রোল যা হিন্দির পাশাপাশি বাংলায় ডাব করেও দেখায় কিছু চ্যানেল।
আয়াতের খুন হওয়ার ধরন ও আবিরের সহজ সাহসী স্বীকারোক্তি আমাদেরকে নিশ্চয়ই ভাবতে শিখাবে নতুন করে। আমাদের দেশে এমনিতেই অপরাধের কমতি নেই। অনেক ধরনের অপরাধ মোকাবিলা করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। খুন প্রতিদিনই হচ্ছে কিন্তু আয়াতের খুন হওয়া যেন আমাদেরকে ভিন্নভাবে বুঝতে বলছে। আমাদের যুবকদের মধ্যে অপরাধ করার প্রবণতা প্রভাবিত হয় এমন সকল কিছু নিয়েই আমাদেরকে ভাবতে হবে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত হবে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যে এ ধরনের নেতিবাচক ক্রাইম সিরিয়াল যা অপরাধ কমানোর পরিবর্তের বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে সেগুলো বন্ধে কোন উদ্যোগ নেয়ার কথা ভাববে কি না।
Advertisement
লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম