মতামত

ম্যারাডোনা নেই, ম্যারাডোনা আছেন

পৃথিবী তখন এক কঠিন অসুখে নিমগ্ন। প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে দারুণ উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায়। কোভিড আক্রান্ত বিশ্ব তখন বাঁচার উপায় খুঁজছে। দেশে দেশে লকডাউন। মানুষজন ঘরবন্দী। নিকটজন বিদায় নিচ্ছে চিরতরে। দেখারও সুযোগ হচ্ছে না। প্রিয় মানুষকে না দেখেই অশ্রুসজল চোখে চিরবিদায় দিতে হচ্ছে।

Advertisement

অন্যদিকে হাসপাতালে হাসপাতালে চলছে বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রাম। চলছে হাহাকার। পুরো বিশ্ব নিস্তব্ধ। শোকাচ্ছন্ন।

ঠিক এমন এক সময়ে ২৫ নভেম্বর, ২০ বিশ্ব গণমাধ্যমে খবর এলো ফুটবলের জাদুকর ফুটবল ঈশ্বরখ্যাত ম্যারাডোনা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। এ যেন শোকের ছায়াকে আদিগন্ত বিস্তার করে দিলো! একদিকে কোভিডে মানুষ মরছে। অন্যদিকে এ থেকে বাঁচতে জারি আছে কোভিড প্রটোকল। মানুষ জমায়েত নিষিদ্ধ। তবুও বুয়েনস আয়ারসের রাজপথে ফুটবল ঈশ্বরকে চিরবিদায় জানাতে কোভিড প্রটোকল ভেঙে লাখো ভক্তরা অশ্রুসজল নয়নে জড়ো হতে শুরু করলো। একসময় তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিতে পুলিশ রাবার বুলেট ছুড়তে থাকে। নিক্ষেপ করতে থাকে কাঁদানেগ্যাস। ফলে সংঘর্ষ বেধে যায়। রক্তাক্ত হয়ে পড়ে রাজপথ। কিছুক্ষণ পরই দেখা যায় সমবেত জনতার সাথে পুলিশও কাঁদছে। জীবিত ম্যারাডোনা যেমন ছিলেন ব্যাকরণহীন, বন্ধনহীন মরণেও যেন তারই বহিঃপ্রকাশ হলো! আক্রমণকারী এবং আক্রান্তকে এক সুতোয় গেঁথে দিলেন যেন। একসাথে কাঁদছে সবাই। পুলিশ কাঁদছে। কাঁদছে তার ভক্তরা। কাঁদছে পুরো বিশ্ব।

১০ নম্বর জার্সি এবং ম্যারাডোনা যেন সমর্থক। ১৯৮৬ বিশ্বকাপ আর্জেন্টিনা জিতেছিল ম্যারাডোনার এক নৈপুণ্যে। ১৯৯০ এ হলো রানারআপ। যদিও সেবার শুরুটা ভালো হয়নি। কারণ গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে অখ্যাত ক্যামেরুনের কাছে হেরে যায় আর্জেন্টিনা। ১৯৯৪ এ শুরুটাও দারুণ করেছিল। কিন্তু ফিফার পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ মাদক গ্রহণের অভিযোগ উঠলে ডোপ টেস্ট দিতে বলা হয়। আর্জেন্টাইন ফুটবল ফেডারেশন ডোপ টেস্টে না পাঠিয়ে তখন তাকে প্রত্যাহার করে নেয়। অনাকাঙ্ক্ষিত এ ঘটনায় সারাবিশ্বে নিন্দার ঝড় ওঠে। দলের ওপরেও তার প্রভাব পড়ে মারাত্মকভাবে। দ্বিতীয় রাউন্ডেই বিদায় নিতে হয় আর্জেন্টিনাকে। না হলে শুরুটা যেমন হয়েছিল তাতে আর্জেন্টিনার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সমুহ সুযোগ ছিল।

Advertisement

আজ বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার এই যে এত এত সমর্থক এর পেছনে ম্যারাডোনা ম্যাজিকই তো জীয়নকাঠি হিসেবে কাজ করেছে। তার জাদুকরী দক্ষতা যারা দেখেছে তারাই তার গুণমুগ্ধ ভক্ত হয়ে গেছে। ২০০৮ সালে দলের সাথে যোগ দেন কোচ হিসেবে। তখন বিশ্বকাপ কোয়ালিফাই করার জন্য আর্জেন্টিনা কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত। সে সময়ই তাকে কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয় আর্জেন্টাইন ফুটবল ফেডারেশন। যদিও দলকে ট্রফি জেতাতে পারেননি। ২০১০ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে থেকে বিদায় নিতে হয় আর্জেন্টিনাকে। তারপর কোচ হিসেবে অব্যাহতি নেন।

আজ দিবাগত রাত ১টায় আর্জেন্টিনা যখন মেক্সিকোর বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচ খেলতে নামবে তখন তার ভক্তদের মনে ফিরে আসছে ১৯৯০ এর ইতিহাস। প্রথম ম্যাচে হেরে যখন দল খাদের কিনারায় তখন ঘুরে দাঁড়ায় তারা। এবারও তেমনটাই হবে বলে আর্জেন্টাইন সমর্থকদের বিশ্বাস। কারণ কেউই কল্পনা করেনি যে সৌদি আরবের কাছে আর যাই হোক আর্জেন্টিনা হেরে যেতে পারে! যেমন করে অখ্যাত ক্যামেরুনের কাছে হেরে গিয়েছিল ১৯৯০ এ। কিন্তু সেটা ঘটে তো গেছেই। ফলে এখন ‘ডু অর ডাই’ ম্যাচে আর্জেন্টিনাকে জিততেই হবে। তার সাথে গোল ব্যবধানটাও বাড়িয়ে নিতে পারলে ভালো হয়। কারণ চ্যাম্পিয়নশিপের দাবিদার এমন একটা টিমের কাছ প্রত্যাশা বেশি থাকবে- এটাই স্বাভাবিক।

আজকের ম্যাচ নিয়ে মনে তাই অতীত স্মৃতি ঘুরপাক খাচ্ছে। আর্জেন্টিনা টিম কি আজ পারবে ম্যারাডোনার দেখানো পথে ১৯৯০ কে ফিরিয়ে আনতে? তাকে অনুসরণ করে ফাইনাল অবধি চলে যেতে? নাকি অদৃষ্টে অন্য কিছু লেখা আছে? সময়ই তা বলে দেবে। কিন্তু এটা সত্যি যে, আর্জেন্টিনা জিতুক অথবা হারুক ম্যারাডোনা বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল তার কোটি কোটি ভক্তের হৃদয়ে। শোনাবেন শিকল ছেঁড়ার গান। উদ্দাম, বাঁধনহীন, মুক্ত জীবনের নামাবলি কে না গায়ে জড়াতে পছন্দ করেন বলেন? পোষমানা প্রাণীর মতো বেঁচে থাকতেই বা কে চায় বলুন?

দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে ম্যারাডোনা তোমাকে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করছি। জানাচ্ছি অভিবাদন। অনন্তলোকে ভালো থেকো। আশীষ দিও প্রিয় দলের জন্য।

Advertisement

লেখক: চিকিৎসক, শিক্ষক।

এইচআর/এএসএম