ছোটবেলায় ‘চীন দেশের রাজকুমারী’সহ অনেক বইতে চীনের বিভিন্ন রূপকথা, উপকথার মধ্যে বেশকিছু জাদুর গল্পও পড়েছিলাম। ‘চায়নিজ ম্যাজিক’ নিয়ে বড়বেলায়ও কিছু সিনেমা দেখেছি গল্প পড়েছি। চীনা সংস্কৃতিতে জাদুর খেলা দেখানোর পদ্ধতি পাশ্চাত্যের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। চীনা জাদুর খেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাদের হাজার হাজার বছরের সংস্কৃতি। এটা হলো প্রাচ্য সংস্কৃতি। ওরিয়েন্টাল শিল্প। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
Advertisement
এখন দুনিয়াকে অন্য রকম ম্যাজিক দেখাচ্ছে চীন। কোভিড-১৯ মহামারির পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে প্রায় সারা বিশ্বের অর্থনীতিই এখন বিপর্যস্ত। ইউরোপের অনেক দেশেই সাধারণ নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য দ্রুতগতিতে বেড়ে যাওয়ায় রীতিমতো সংকটে পড়েছে সাধারণ মানুষ। বিশ্বব্যাপী একটা দুর্ভিক্ষ যেন কড়া নাড়ছে দুয়ারে।
এরই মধ্যে চীনের উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি রীতিমতো অবাক করছে বিশ্ববাসীকে। তাদের কৃষিক্ষেত্রে ঘটছে বাম্পার ফলন। অন্যদিকে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটছে। পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায়ও তারা সোচ্চার। ‘গ্রিন ডেভেলপমেন্ট’ এখন চীনের সর্বত্র চোখে পড়ছে। জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি না করে তারা গড়ে তুলছে ইকো ট্যুরিজম। গত বছর চীন তাদের পুরো জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্য সীমার ওপরে তুলে এনেছে। দারিদ্র্য থেকে মুক্তি ঘটেছে তাদের।
এই চীনা ম্যাজিকটা কি? প্রশ্নটা করেছিলাম বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিংকে। মৃদু হেসে বললেন, ম্যাজিক তো কিছু নেই, তবে আপনি যদি চীনের উন্নয়নকে ম্যাজিক বলেই অভিহিত করতে চান তাহলে বলবো সেই ম্যাজিকটা হচ্ছে ‘সমাজতন্ত্র, মার্ক্সবাদ।’
Advertisement
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হলো চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম জাতীয় কংগ্রেস। অনেকেই জানেন যে চীনের ক্ষমতায় রয়েছে সিপিসি, কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না। ১৯২১ সালে দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে দেশ গঠনে তারা অনেক সংগ্রাম করে এগিয়ে গেছে। সিপিসির ন্যাশনাল কংগ্রেস পাঁচ বছর পর পর অনুষ্ঠিত হয়। দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে এটা হলো তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম। আগামী পাঁচ বছর চীনদেশ কারা চালাবেন, চীনের নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি কি হবে সব কিছুই নির্ভর করে সিপিসির ওপর।
চীনের সমাজতন্ত্রকে বলা হয় ‘চীনা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সমাজতন্ত্র’। এখানে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ যেমন আছে তেমনি আছে ব্যক্তি উদ্যোগ। কিন্তু ব্যক্তি উদ্যোগ থাকলেও শ্রমিক যেন শোষণের শিকার না হয় সেদিকে কড়া নজর রাখা হয়। মানুষের যে পাঁচটি মৌলিক অধিকার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা এটি নিশ্চিতের দায়িত্ব রাষ্ট্রের।
২০তম জাতীয় কংগ্রেসে সি চিনপিং আবার দলের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। কারণ, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা মনে করেছেন সি চিনপিংয়ের নেতৃত্ব বর্তমানে দেশ গঠনে তাদের প্রয়োজন। সি শুধু বলিষ্ঠ নেতাই নন, তিনি একজন তাত্ত্বিকও। সমাজতন্ত্র বিষয়ে তার বিশাল রচনাসমগ্র রয়েছে। ছাত্র বয়স থেকেই লেখালেখি করেন তিনি। চীনা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সমাজতন্ত্রের ধারণায় সি’র অবদান অনেক।
চীনা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সমাজতন্ত্র হলো সমাজতন্ত্রের ভিত্তিকে ধারণ করে তাকে দেশ, ইতিহাস, সময় ও সমাজের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রয়োগ করা। চীনা বিপ্লবের জনক চেয়ারম্যান মাও সেতুংয়ের আদর্শকে ধারণ করে চীনকে নতুন শতকে এগিয়ে নিতে চান সি।
Advertisement
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় শতবর্ষের লক্ষ্য হচ্ছে সর্বোতভাবে চীনকে একটি আধুনিক সমৃদ্ধ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা, চীনের স্বকীয় আধুনিকায়নের পথ বেয়ে জাতির মহান পুনর্জাগরণের পথে সর্বক্ষেত্রে জাতিকে পরিচালিত করা। গত পাঁচ বছরে সির নেতৃত্বে চরম দারিদ্র্য দূর হয়েছে।
এখন লক্ষ্য হলো ‘সিয়াওখাং সোসাইটি’ গঠন। এর মানে হলো মাঝারি ধরনের সমৃদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। অন্য দেশের আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে চীনের আধুনিকায়নের কিছু মিল ও অমিল রয়েছে। চীনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি একটি শান্তিপূর্ণ আধুনিকায়ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে। এটি প্রকৃতির সঙ্গে ভারসাম্য রেখে সবার জন্য বস্তুগত, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক উন্নতি সাধন করে। এর সঙ্গে চীনের প্রাচীন জীবন দর্শনও জড়িয়ে আছে। প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান চীনের প্রাচীন সংস্কৃতি ও লোকজ দর্শনের অন্তর্গত।
এখানেই হলো প্রাচ্য দর্শনের অবদান। লেখার শুরুতেই যে কথা বলেছিলাম। পাশ্চাত্য সভ্যতা মানুষকে এরই মধ্যে দুটি বিশ্বযুদ্ধ উপহার দিয়ে তৃতীয়টির পথে গুটি গুটি পায়ে এগোচ্ছে। পাশ্চাত্যের সমাজভাবনায়ও মানুষ শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই নিয়ে নিঃসঙ্গ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়।
এ কারণেই এখন মনোযোগ ফেরানো দরকার প্রাচ্যের দিকে। চীনের সমাজে দেখেছি ‘কমিউনিটি’ ভাবনা। সেখানে একেকটি পাড়া-মহল্লায় রয়েছে কমিউনিটি। যারা সবাই সবাইকে চেনে। কমিউনিটির কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বৃদ্ধ ও অসুস্থদের খোঁজখবর নেয়। যাদের হাসপাতালে চিকিৎসা প্রয়োজন তাদের সেই চিকিৎসা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হয়। এটা হলো সমাজকেন্দ্রিক ভাবনা, যা ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার বিপরীতে অবস্থান করে।
চীনের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সমাজতন্ত্র হলো ‘পিপল ওরিয়েন্টেড’ বা জনগণকেন্দ্রিক। সিপিসি তার সব নীতি, পরিকল্পনা ও কাজ পরিচালনা করে জনকল্যাণকে কেন্দ্র করে। এটাই তাদের সমাজতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্য। এটাই চীনা ম্যাজিক।
বাংলাদেশেরও নিজস্ব লোকপ্রজ্ঞা ও সংস্কৃতি রয়েছে। আমাদেরও নীতিনৈতিকতার ভিতরে জনসেবার ধারণা রয়েছে। আমরাও তো উন্নয়নের পথে দেশকে নিতে চাই। আমরা কি আমাদের ‘বাংলা ম্যাজিক’কে কাজে লাগিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে পারি না?
বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী একটা বন্ধুত্ব রয়েছে, যা হাজার বছরেরও বেশি পুরোনো। দেশের উন্নয়নে চীনের সহযোগিতা গ্রহণ করে আমরা তো বিশ্বের উন্নয়নেও ভূমিকা রাখতে পারি।
পাশ্চাত্যের উন্নয়ন মডেল অন্ধভাবে অনুসরণের পরিবর্তে এখন দরকার প্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে নিজস্ব ঐক্য গড়ে তুলে, নিজেদের উন্নয়ন মডেল সৃষ্টি করা। দরকার ‘প্রাচ্য ম্যাজিক’ দেখিয়ে বিশ্বকে তাক লাগানো।
লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/এএসএম