দেশজুড়ে

বছর না যেতেই ফাটল, ঘর ছাড়ছেন সুবিধাভোগীরা

বছর না যেতেই জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে আশ্রয়ণ প্রকল্প ফেস-২ এর অধিকাংশ ঘরে ফাটল দেখা দিয়েছে। এছাড়া সুপেয় পানির সংকট ও সন্ধ্যা নামলেই ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। এতে ঘর ছাড়ছেন উপকারভোগীরা। স্থান নির্বাচন, বসবাসের অনুপযোগী পরিবেশ, এমনকি যাতায়াতের রাস্তা ছাড়াই বাস্তবায়ন দেখানো হয়েছে দুর্গম চরাঞ্চলের এ আশ্রয়ণ প্রকল্প। ফলে জলে যেতে বসেছে সরকারের কোটি টাকা।

Advertisement

সরিষাবাড়ী উপজেলার আওনা ইউনিয়নের যমুনার কোলঘেঁষা দুর্গম ঘুইঞ্চার চর আশ্রয়ণ প্রকল্প ঘুরে এমনই চিত্র দেখা গেছে। তবে বরাদ্দ পাওয়ার পর যারা ঘরে থাকছেন না, তাদের দলিল বাতিল করে নতুনদের বরাদ্দ দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।

প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় উপজেলায় মোট ৩২৩ ঘর নির্মাণ করা হয়। আশ্রয়ণ প্রকল্পের (ফেস ২) অধীনে সরিষাবাড়ী উপজেলায় ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রথম পর্যায়ে ২৯৫ ঘর বরাদ্দ হয়। প্রতিটি ঘরের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় এক লাখ ৭১ হাজার টাকা। দ্বিতীয় পর্যায়ে এক লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মাণ হয় ২৫টি ঘর।

২০২১-২২ অর্থবছরে প্রতিটি দুই লাখ ৫৯ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় আরও তিনটি ঘর। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ঘুইঞ্চার চরে নির্মিত হয়েছে ১৪৬টি ঘর।

Advertisement

সরেজমিনে দেখা যায়, দুটি নদী পার হয়ে এবং প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পথ হেঁটে যেতে হয় এ আশ্রয়ণ প্রকল্পে। যাতায়াতের রাস্তা বলতে ক্ষেতের সরু আইল। আশপাশে নেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার, এমনকি কর্মসংস্থানের কোনো ব্যবস্থা। সন্ধ্যা নামলেই পুরো এলাকায় গা ছমছমে পরিবেশ নেমে আসে। ১৪৬ ঘরের মধ্যে মাত্র ১৫-১৬ ঘরে উপকারভোগীদের থাকতে দেখা গেছে। বাকি ঘরে ঝুলছে তালা। বেশ কয়েকটি ঘরের দেওয়াল ও মেঝেতে ফাটল ধরেছে। দীর্ঘদিন ধরে একটি ঘরের চালসহ সব কিছু মাটিতে পড়ে রয়েছে। টিনের চালে স্ক্রুর বদলে তারকাঁটা ব্যবহার করায় বৃষ্টির পানি পড়ে চুইয়ে। প্রধানমন্ত্রীর উপহার লেখা সম্বলিত সাইনবোর্ডগুলো টানানো হয়নি কোনো ঘরেই। একটি ঘরের মেঝেতে অযত্নে ফেলে রাখা হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, আশ্রয়ণ প্রকল্প ফাঁকা পড়ে থাকায় কৃষকরা প্রখর রোদে ক্ষেতখামারে কাজ করে ক্লান্তি দূর করার উপযোগী স্থান হিসেবেই এটি ব্যবহার করছেন। অধিকাংশ ঘরের বারান্দায় চরাঞ্চলের মানুষ দিনে গরু-ছাগল বেঁধে রাখেন। আগাছায় ভরে গেছে অনেক ঘরের বারান্দা। বসবাসের অনুপযোগী হওয়ায় লোকজন ঘর ছেড়ে যাচ্ছেন, যারা আছেন তারা রাত কাটান আতঙ্কে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে ১৫টি অগভীর নলকূপ দেওয়া হলেও রয়েছে মাত্র একটি। তবে এটির পানিতে প্রচুর আয়রন হওয়ায় ব্যবহার করেন না কেউই। বাকি নলকূপ চুরি হয়ে গেছে।

সুবিধাভোগী শাহীনুর বেগম (৪৫) এসেছেন দৌলতপুর থেকে। তিনি জানান, সরকার অনেক টাকা খরচ করে ঘর দিয়েছে, অথচ কর্মসংস্থানের কোনো সুযোগ নেই। এমনকি দরিদ্রদের জন্য সরকারি কোনো রিলিফ, ভাতা বা আর্থিক সহায়তা করা হয় না। ফলে এখানে থাকার পরিবেশ নেই, তাই প্রথমদিকে এটি পরিপূর্ণ থাকলেও একে একে সবাই চলে যাচ্ছেন।

Advertisement

সত্তরোর্ধ্ব মফিজ উদ্দিন জানান, তারাকান্দি থেকে বড় আশা নিয়ে এসেছিলাম। অথচ এখানে গরু-ছাগল চরানোর পরিবেশও নেই। যাতায়াতের রাস্তা না থাকায় কোনো ব্যবসা-বাণিজ্যও করা যায় না। কর্মহীন থাকতে হয় বিধায় কষ্টে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। চোরের কারণে রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমানো যায় না বলে জানান তিনি।

প্রতিবন্ধী আনোয়ার হোসেন জানান, সরকার ঘর দিলেও, কর্মসংস্থানের কোনো সুযোগ রাখেনি। এমন জায়গায় থাকতে দিয়েছে যে, ভিক্ষা করারও উপায় নেই।

গৃহবধূ রেহানা বেগম জানান, ১৫টার মধ্যে একটা নলকূপ আছে, বাকিগুলো চুরি হয়ে গেছে। যে নলকূপটি আছে, তার পানিতে আয়রন এবং দুর্গন্ধ। ব্যবহারের অনুপযোগী বলে দেড়-দুই মাইল দূর থেকে পানি এনে ব্যবহার করতে হয়।

শিক্ষার্থী শাকিল মিয়া জানায়, আশপাশে কোথাও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই, তাই প্রতিদিন ৫-৬ মাইল হেঁটে দৌলতপুরের একটি মাদরাসায় যেতে হয়। অনেক কষ্ট হওয়ায় প্রায় দিনই মাদরাসায় অনুপস্থিত থাকি।

উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের নামে উপজেলায় মোট ৩৭টি অগভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। এরমধ্যে ঘুইঞ্চার চরে রয়েছে ১৫টি। প্রতিটি নলকূপের খরচ পড়েছে প্রায় ২৫ হাজার টাকা। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি নলকূপের গভীরতা ৬১ মিটার, ফলে পানিতে আয়রন হলেও কিছু করার নেই। এছাড়া মালিকানা হস্তান্তরের পর চুরি প্রতিরোধে উপকারভোগীদেরই সজাগ থাকতে হবে বলে জানান তিনি।

এদিকে ঘর ছেড়ে লোকজন চলে যাওয়ায় বিল বকেয়া পড়ছে পল্লীবিদ্যুতের। লোক না থাকলেও প্রতি মাসে বিল ধার্য হচ্ছে প্রতিটি হিসাব নম্বরের বিপরীতে। বিলের কপি পড়ে থাকছে ঘরের দরজার ফাঁকে।

এ ব্যাপারে সরিষাবাড়ী পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) নুরুল হুদা বলেন, অনেক ঘরে লোক না থাকায় বিল বকেয়া পড়ছে। এর মধ্যে কিছু কিছু গ্রাহকের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে।

আওনা ইউপি চেয়ারম্যান বেল্লাল হোসেন মোবাইলে জাগো নিউজকে বলেন, ঘরগুলো করেছেন পিআইও এবং তৎকালীন ইউএনও। ঘর করার সময় আমাদের জানানো হয়নি। মূলত কর্মসংস্থানের অভাবে এখানে উপকারভোগীরা থাকছেন না।

আশ্রয়ণ প্রকল্পের এমন বেহাল দশা নিয়ে কথা হয় সরিষাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উপমা ফারিসার সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি যোগদানের আগে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো করা হয়েছে। শুরুতে ঘর নেওয়ার জন্য অনেকের আগ্রহ ছিল বলে শুনেছি। ঘুইঞ্চার চরের ঘরগুলো বসবাসের উপযোগী করতে প্রশাসন চেষ্টা করছে। যাতায়াতের রাস্তা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

এএইচ/এসএইচএস/এসআর/জেআইএম