কিছু পাগলামির কোনো ওষুধ হয় না। ফুটবলের পাগলামি তেমন একটি বিষয়। বুঝতে শেখার পর থেকে ফুটবলই ছিল আমাদের সবার প্রাণের খেলা। আমাদের দেশে তখন আবাহনী, মোহামেডান যুদ্ধ তুমুলে। ছোটবেলার স্মৃতিতে এখনও আমি আবাহনী আর মোহামেডানের খেলার দিন সারাদেশের অবস্থা দেখি।
Advertisement
তখনকার অনেক পরিবারের মতো আমিও যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি। মনে আছে আমার ভাইদের মধ্যে একদল আবাহনী আর আরেক দল মোহামেডানের পাগলা সমর্থক। আব্বা ও ভাইদের প্ররোচনায় আমিও মোহামেডানের অন্ধ ভক্ত। মোহামেডান, আবাহনীর ফাইনাল খেলা হলে আমাদের বাসায় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হতো। কারণ কী? কারণ হচ্ছে আবাহনী আর মোহামেডানের সমর্থকদের মধ্যে যেন অপ্রীতিকর কিছু না ঘটে। এই অবস্থা কিন্তু সারাদেশেই থাকতো তখন।
তো এমনটাই তো আমাদের বাঙালির ফুটবল আবেগ। সময়ের বিবর্তনে ক্রিকেট হয়তো জায়গা নিয়েছে কিন্তু ফুটবলের সেই আবেগ কোনোদিকেই অতিক্রম করতে পেরেছে বলে আমার মনে হয় না। ক্রিকেট খেলার প্রসার তো সেইদিনের আর বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে নিজেদের জানানও দিয়েছে কিছুদিন হলো মাত্র। আমাদের দেশের ফুটবলের সেই জৌলুস এখন আর নেই। দেশীয় ক্লাব ফুটবল নিয়ে মাতামাতি না থাকলেও আন্তর্জাতিক ফুটবল নিয়ে কম পাগলামি হয় না। অন্য দলগুলোর সমর্থক থাকলেও আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল নিয়েই চলে সব খোঁচাখুঁচি।
এখন আমাদের দেশের একদল মানুষ আছে যারা এই পাগলামিকে সহ্য করতে পারে না। তারা খেলার এই উন্মাদনাকে কটাক্ষ করতেও ছাড়েন না। বাংলাদেশের মানুষের এই ফুটবল ক্রেজ নিয়ে আন্তর্জাতিক মাধ্যমেও সংবাদ হয়েছে। চার বছর পরপর হলেও সুযোগ পেলেই কিন্তু আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলের সমর্থকদের এই খুনসুটি চলে।
Advertisement
হ্যাঁ স্বীকার করছি যে কখনও হয়তো বাড়াবাড়ি কিছু হয়। যেমন পতাকা টানাতে গিয়ে পড়ে মৃত্যুর মতো ঘটনা কারোরই কাম্য নয়। মূলত এগুলো সবই ভালোবাসা থেকেই করে। প্রতিবার বিশ্বকাপ এলেই সংবাদে পড়ি জমি বিক্রি করে প্রিয় দলের পতাকা বানিয়েছে কেউ কেউ। সবচেয়ে লম্বা পতাকা বানানোর মাধ্যমে বিশ্বরেকর্ড করতে চাওয়ার ঘটনাও বিরল নয়।
ক্লাব ফুটবলে মেসি এবং নেইমার একই ক্লাবে খেলেন কিন্তু দেখা যাবে একটা ম্যাচে কে বেশি গোল করলো সেটাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় তর্কাতর্কি। একমাস ধরে চলা বিশ্বকাপের জ্বর কিন্তু শুরু হয়ে যায় তারও আগে থেকে। বলা হয় ভাইরাল ফিভার ওষুধ খেলেও সাতদিনে সেরে যায় আবার না খেলেও সাতদিনেই সারে। কিন্তু ফুটবল বিশ্বকাপের জ্বর শুরু হয় বিশ্বকাপের একমাস আগে আর সারতে সময় লাগে বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার পরে আরও একমাস। কোনো অ্যান্টিবায়োটিকেই এই জ্বর কমে না বরং বেড়েই যায়।
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল এই বিশ্বকাপ জ্বরে আক্রান্ত থাকে। যে শিশুটি খেলার মাথামুন্ডু বোঝে না সেও মেসি, নেইমারের নাম জানে এই সময়টাতে। আর্জেন্টিনা এর আগে দুবার বিশ্বকাপ জিতেছিল। অপরদিকে ব্রাজিল জিতেছে পাঁচবার। ছয় নম্বর কাপের লড়াইয়ে এবার মাঠে নামছে নেইমারের দল।
চেনা নাই জানা নাই এমন মানুষগুলোকে নিয়ে যে কাণ্ডটা শুরু হয় সেটার পেছনে আসলে কারণ কী হতে পারে? আসলে কিছু বিষয়ের কারণ খুঁজতে নেই। কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। ভালোবাসা সেটা একপাক্ষিক হোক আর দুইপাক্ষিক সেখানে কোনো কারণ থাকে না। তাই আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিলের সমর্থকদের এই মধুর মারামারির সম্পর্কেরও কোনো কারণ খুঁজতে যাওয়া বৃথা। সেখানে সঠিক বেঠিক বিবেচনা করতে গেলেই বরং সমস্যা।
Advertisement
সব পাগলামি কিন্তু ক্ষতিকারক হয় না। এই পাগলামি দেশের ও বিশ্বের অর্থনীতিতেও একটা বড় ভূমিকা রাখে। এক বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে চার বছর পরপর পতাকার যে রমরমা ব্যবসা গড়ে ওঠে সেটাকে অস্বীকার করা মানে বোকামি। এই একমাস প্রিয় দলের পতাকা আর জার্সি কেনার ধুম পড়ে যায়। যে হয়তো তিনবেলা খাবার গোগাড় করতে হিমশিম খায় সেও পয়সা বাঁচিয়ে প্রিয় দলের পতাকা বা জার্সি কেনে। অর্থনৈতিক এই লেনদেন কিন্তু আমাদের দেশেই থাকে। বাইরে চলে যায় না। ফুটবলের এই অর্থনৈতিক বাণিজ্যের দিকটা আমরা অনেকেই বুঝতে পারি না।
বিশ্বকাপের একমাস আর তার আগে পরের দুইমাস মিলে প্রায় তিনমাস এই জাতি নিজেদের মধ্যকার বিদ্বেষকে ভুলে থাকে কেবল ফুটবল উন্মাদনায়। আর্জেন্টিনা না ব্রাজিল এই একটা প্রশ্নের উত্তরই কেবল কমন থাকে সবার পাঠ্যপুস্তকে। মেসির দল আর্জেন্টিনা কাপ পায় না ৩৬ বছর ধরে তারপরেও তাদের সমর্থকদের ধৈর্য আর ভালোবাসার কাছে হার মানে ইতিহাসের পাতার সব স্মরণীয় প্রেমের কাহিনি।
আর্জেন্টিনার সমর্থকদের মতো ধৈর্য যদি প্রতিটা মানুষের সব ক্ষেত্রে থাকতো তাহলে আমাদের দেশের অনেক সমস্যার সমাধান আমরা পেতাম। অস্থির এই জাতির জন্য আর্জেন্টিনার সমর্থকদের কাছ থেকে শেখার আছে অনেক কিছু। শোনা যাচ্ছে এবারই নাকি মেসির শেষ বিশ্বকাপ। মেসি একজন মহাতারকা এ নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই। কিন্তু ওই যে! একজন মহাতারকার জীবনে ফুটবলের সর্বোচ্চ শিরোপাটাই যদি না থাকে তাহলে কি মানায়? জানিনা এবার কী হবে। ইতিমধ্যে এবার বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় অঘটন করে ফেলেছে সৌদি আরব। বিশ্বকাপের হট ফেভারিট আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে দিয়েছে।
দেখা যাক ব্রাজিল কী করে। ছন্দ আর গতির খেলার জন্য নন্দিত দল ব্রাজিল কি পারবে আর্জেন্টাইন দর্শকদের ‘সেভেন আপ’ স্লোগানের হাত থেকে মুক্ত হতে? দেখা যাক। দিনশেষে ছন্দ ও গতির খেলা ফুটবলের জয় হোক।
লেখক : অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/এএসএম