মতামত

ব্যাংকখাতের সংস্কারে জোর দিতে হবে

 

বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতি বিভিন্ন সূচকে সংকটাপন্ন। বৈশ্বিক মন্দার কবলে বাংলাদেশের অর্থনীতি। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা প্রায় সব দ্রব্যমূল্যে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ভারত, ইন্দোনেশিয়া এবং ভিয়েতনাম থেকে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ অনেকটা বেশি।

Advertisement

অক্টোবর মাসে যেখানে ভারতের মূল্যস্ফীতির পরিমাণ ৭ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ায় ৪.৯৫ শতাংশ, ভিয়েতনামে ২.৮৯ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ একই সময়ে ৯.৫২ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির ফলে এই মুহূর্তে বাজারে প্রত্যেকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। সুখবর নেই প্রবাসী আয়েও। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে যেখানে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ছিল ১.৬৪ বিলিয়ন ডলার সেখানে ২০২২ সালের একই সময়ে তা বেশ খানিকটা কমে ১.৫২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

প্রবাসী-আয় কমে যাওয়ার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বড় ধরনের টান পড়েছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও টাকার মূল্যমান কমে যাওয়ার ফলে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে আমদানি ব্যয় যেখানে ছিল ১৬৪ কোটি ডলার, সেখানে ২০২২ সালের একই সময়ে আমদানি ব্যয় বেড়ে তা দাঁড়িয়েছে ৭১৯ কোটি ডলার। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ বেশ খানিকটা কমে গেছে।

বাংলাদেশ আমদানি করে বেশি কিন্তু সে তুলনায় রপ্তানি করে অনেক কম। এদিকে গত দুই মাসে দেশে রপ্তানি আয় অনেকটা কমে গেছে। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে যেখানে রপ্তানি আয় ছিল ৪৭২ কোটি ডলার, সেখানে ২০২২ সালের একই সময়ে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৩৫ কোটি ডলার। যেহেতু আয় কমেছে কিন্তু ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে, ফলে চলতি হিসাবের ঘাটতিও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

Advertisement

চলতি হিসাবের ঘাটতি যেখানে ২০২০-২১ (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আর্থিক বছরে ছিল ২৫৪.৫০ কোটি ডলার, সেখানে ২০২১-২২ আর্থিক বছরের একই সময়ে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬১ কোটি ডলার। এদিকে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এফডিআই বা সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ তলানিতে ঠেকেছে। বাংলাদেশে এফডিআই’র পরিমাণ জিডিপির মাত্র ০.৫৮ শতাংশ অথচ তা ভিয়েতনামে ৪.৮৮ শতাংশ।

এদিকে নভেম্বর মাসে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী কমে দাঁড়িয়েছে ৩৪.৪৭ বিলিয়ন ডলারে। অথচ গত জুনে তা ছিল ৪১.৮২ বিলিয়ন ডলার। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব অনুযায়ী রিজার্ভের পরিমাণ আরও ৮ বিলিয়ন ডলার কম। আইএমএফের হিসেবে প্রকৃত রিজার্ভের পরিমাণ প্রায় ২৬.২৩ বিলিয়ন ডলার। ফলে বিদ্যমান রিজার্ভ দিয়ে ৩.৫ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

এদিকে বাজারে ডলারের সংকট সমাধানে গত ১৫ মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক ১৩ বিলিয়ন ডলার বাজারে ছেড়েছে। ডলার সংকট ও আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে ব্যাংকে ঋণপত্র খোলা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। গত অক্টোবর মাসে ঋণপত্র খোলা কমে দাঁড়িয়েছে ৪.৭৪ বিলিয়ন ডলারে, যা গত বছরের অক্টোবর মাসের চেয়ে ৩৮ শতাংশ কম। অথচ গত সেপ্টেম্বর মাসেও প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের ঋণপত্র খোলা হয়েছিল। সে অনুসারে মাত্র এক মাসের ব্যবধানে ঋণপত্র খোলার পরিমাণ অর্ধেকে নেমে এসেছে।

অন্যদিকে বিদেশি ঋণের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৫-১৬ সালে মোট বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪১.১৬, বিলিয়ন ডলার, ২০১৬-১৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫. ৮১, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৫৬.০১ বিলিয়ন ডলার, ২০১৮-১৯ এ দাঁড়ায় ৬২.৬৩ বিলিয়ন ডলার, ২০১৯-২০ এ তা দাঁড়ায় ৬৮.৫৯ বিলিয়ন ডলার, ২০২০-২১ অর্থবছরে দাঁড়ায় ৮১.৫৭ বিলিয়ন ডলার, ২০২১-২২ এ তা আরও বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৯৫.৮৬ মিলিয়ন ডলারে।

Advertisement

অর্থাৎ বিদেশি ঋণের পরিমাণের ধারা ঊর্ধ্বমুখী। আইএমএফের কাছ থেকে প্রস্তাবিত ৪.৫০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পাওয়া গেলে অর্থনীতি নিয়ে সরকার হয়তো সাময়িক স্বস্তিতে থাকবে সত্য, তবে জনগণের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ আরও খানিকটা বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের কর জিডিপি হার বিশ্বের মধ্যে নিচের দিক থেকে দ্বিতীয়। শুধু আফগানিস্তানের ওপরে। ফলে বছর বছর বাজেটের আকার যেমন বাড়ছে তেমনি বাজেট ঘাটতির পরিমাণও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।

স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন পার হলেও কর জিডিপির হার এখনো ১০ শতাংশের ঘরেই ঘুরপাক খাচ্ছে, যদিও তা ১৪-১৫ শতাংশ হওয়া যুক্তিযুক্ত ছিল। কিন্তু কর কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে তা স্বাধীনতার পর কখনোই ১০ শতাংশের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। অর্থনীতির আকার বেড়েছে কিন্তু করদাতার সংখ্যা সে অনুপাতে বেড়েনি।

দেশে কোটিপতির সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনি কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে। যেহেতু আয় কম কিন্তু ব্যয়ের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে তাই এই বর্ধিত ব্যয় মেটাতে সরকারকে প্রতি বছর দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ করে বাজেটীয় ব্যয় নির্বাহ করতে হচ্ছে। এতে করে একদিকে ঋণের চাপ যেমন বাড়ছে অন্যদিকে সুদসহ ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে রিজার্ভের ওপর প্রতি বছরই একটি বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হচ্ছে ।

এই মুহূর্তে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হলে মূলত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ বৃদ্ধির পাশাপাশি পতন ঠেকানো জরুরি। তা করা না গেলে সবার আত্মবিশ্বাস কমে যাবে। এছাড়া স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি রাজস্বখাত ও ব্যাংকিংখাতের সংস্কার করতে হবে। দেশে মূল্যস্ফীতি গত মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর ব্যাপকভাবে পড়েছে।

খাবারের তালিকা থেকে অনেককেই মাছ ও মাংস বাদ দিতে হচ্ছে, তাছাড়া ঊচ্চমূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষ প্রতিনিয়ত নতুন করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের খাদ্যনিরাপত্তা সূচক নিম্নমুখী।

ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি তেল ও গ্যাস আমদানি করতে না পারায় বিদ্যুৎ পরিস্থিতি অনেকটা শোচনীয়। রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ না করার কারণে একদিকে যেমন উৎপাদনের পরিমাণ কমেছে অন্যদিকে কারখানাগুলোতে উচ্চমূল্যের জ্বালানি ব্যবহার করায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে অনেকগুণ।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের তথ্যমতে, বর্তমান অর্থনীতির বড় সংকট হচ্ছে খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকি। এই সংকট নিরসনে সামাজিক সুরক্ষার পরিধি বাড়ানোর পাশাপাশি এখাতের অনিয়ম-দুর্নীতি কমিয়ে আনতে হবে। কৃষি পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্যশস্য আমদানির নতুন নতুন উৎস অনুসন্ধান করা খুব জরুরি।

বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে ব্যাংকের সুদহার ও ডলারের বিনিময় হার ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট পক্ষদের সমন্বয়ে একটি কমিশন গঠন করে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা না গেলে অর্থনীতির সংকট আরও ঘনীভূত হতে পারে। রিজার্ভ থেকে প্রতি মাসে যে পরিমাণ ডলার কমছে তার গতি থামাতে না পারলে সামনে আরও বড় ধরনের সংকট তৈরি হতে পারে।

আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। রিজার্ভকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যেতে হবে, যাতে তা দিয়ে অন্তত দশ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যায়। এটা সত্য যে, অবৈধ হুন্ডির কারণে প্রবাসী আয় বাড়ানো যাচ্ছে না। হুন্ডি বন্ধ করতে হলে ডলারের বিনিময় হার ঠিক করতে হবে। একই সঙ্গে দেশ থেকে টাকা পাচার বন্ধ করতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত অর্থ পাচার বন্ধ করা যাচ্ছে না, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনোভাবেই দেশের জন্য ক্ষতিকর হুন্ডি বন্ধ করা যাবে না। এজন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। ব্যাংকখাতের সংস্কারের ওপর জোর দিতে হবে। ব্যাংকখাতে সুশাসন না থাকায় অর্থনীতিতে নানারকম সমস্যা তৈরি হয়েছে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা অসম্ভব প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।

বর্তমান অর্থমন্ত্রী দায়িত্ব নেওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় খেলাপি ঋণকে আর বাড়তে না দেওয়ার ঘোষণা দিলেও বাস্তবে খেলাপি ঋণ আরও প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যাংকের পাশাপাশি রাজস্ব খাতের সংস্কারেও হাত দিতে হবে। বাংলাদেশের কর জিডিপির অনুপাত বর্তমানের তুলনায় দ্বিগুণ হওয়ার দরকার ছিল, তাতে আমাদের খরচের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেত, যা হয়নি। অনেকটা সময় চলে গেলেও আর কালবিলম্ব না করে সমস্যা কোথায় তা চিহ্নিত করে আশুব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।

লেখক: আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। drhasnat77@gmail.com

এইচআর/ফারুক/এমএস