আন্তর্জাতিক

মেসির ছোটবেলা নিয়ে যা বলছেন প্রতিবেশীরা

আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরের মধ্যে সাজানো গোছানো ছিমছাম একটি এলাকা লা বাজাদা। সেখানকার বাসিন্দা ৭০ বছর বয়সী সুজানা আরাউসের মনে আজও জ্বলজ্বল করে বন্ধুদের সঙ্গে তাস খেলা, রাস্তা দিয়ে ছুটে চলা বাচ্চাদের হট্টগোল, পুলে যাওয়া কিংবা ফুটবল নিয়ে লড়াইয়ের মতো অসংখ্য স্মৃতি। তবে এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে সেই ঘটনা, যখন ছোট্ট এক বালক ছোট এই এলাকাটিকে সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত করে তোলেন। বালকটির নাম লিওনেল মেসি, বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবল খেলোয়াড়।

Advertisement

মেসির ছোটবেলা কেটেছে এই লা বাজাদা এলাকায়। তার সেসময়কার প্রতিবেশী আরাউস বলেন, সে (মেসি) ছিল আর দশটা শিশুর মতোই।

শিশু মেসির সঙ্গে ছোটবেলায় ফুটবল খেলেছেন বারবারা সোসি। তিনি বলেন, সে সবসময় খুব বিনয়ী ছিল। ঠিক এখনকার মতোই। তাকে যেমনটি দেখা যায়, সারাজীবনই সে এমন ছিল।

লা বাজাদার একটি বাড়িতে মেসির ১০ নাম্বার জার্সি আঁকা। ছবি সংগৃহীত

Advertisement

রোজারিওর অন্যতম প্রধান ক্লাব নিওয়েলস ওল্ড বয়েজের কিশোর দলে ছয় বছর খেলেছেন মেসি। গোল করেছেন ৫০০টির বেশি। এই প্রতিভাই তাকে আর্জেন্টিনা থেকে স্পেনে নিয়ে যায়। সেখানে শারীরিক বৃদ্ধি সংক্রান্ত সমস্যার চিকিৎসা নেওয়ার পাশাপাশি বার্সেলোনার হয়ে সুদীর্ঘ ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করেন মেসি।

কাতালান ক্লাবটির হাত ধরেই সুপারস্টার হয়ে ওঠেন এই ফুটবল তারকা। তার দক্ষতায় রেকর্ড ৩৫টি ট্রফি জিতেছে বার্সেলোনা, যার মধ্যে ১০টি লা লিগা, সাতটি কোপা দেল রে এবং চারটি উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা রয়েছে।

বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাতবার ব্যালন ডি’অর জেতার রেকর্ডও লিওনেল মেসির। গত বছর তার নেতৃত্বে কোপা আমেরিকা কাপ ঘরে তুলেছে আর্জেন্টিনা। এবার পঞ্চম ও সম্ভবত নিজের শেষ ফুটবল বিশ্বকাপ খেলতে কাতারে গেছেন তিনি।

লা বাজাদায় পার করা ১৩টি বছর মেসির জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ছাপ ফেলেছে। শুধু বেড়ে ওঠাই নয়, তার প্রতিভা চর্চার সুযোগও করে দিয়েছিল এই শহরটি। লা বাজাদায় আজ সশরীরে না হলেও সুউচ্চ ভাস্কর্য, ছবি, দেওয়ালচিত্র, সর্বোপরি প্রতিবেশীদের স্মৃতিতে ঠিকই রয়েছেন মেসি। তিনি যে হাইস্কুলে পড়তেন, সেখানে তার নানা তথ্যযুক্ত খাতাটি যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছে কর্তৃপক্ষ।

Advertisement

মেসি ও তার পরিবার সম্পর্কে খুঁটিনাটি অনেক কিছু জানিয়েছেন সাবেক প্রতিবেশী ওলগা ডেভিডোভিচ ও আরাউস। তারা মেসির দাদি সেলিয়াকে স্মরণ করেন। মেসিকে অল্প বয়সে খেলায় নেওয়ার জন্য কোচদের উৎসাহিত করেছিলেন তিনিই।

মেসির বয়স যখন ১০ বছর তখন সেলিয়া মারা যান। তাই আজও গোল উদযাপনের সময় প্রায়ই আকাশের দিকে তাকিয়ে দাদির কথা মনে করেন এই ফুটবল তারকা। ডেভিডোভিচের মতে, মেসি খুবই ভালো ছেলে।

সেবাস্তিয়ান মুরুয়া নামে আরেক প্রতিবেশী বলেন, আমি জর্জকে (মেসির বাবা) বলতাম, তোমার কাছে সোনা আছে।

মুরুয়ার চার ছেলে। তাদের মধ্যে একজন যে ফুটবল ক্লাবে খেলে, সেই ক্লাবের নীতিবাক্য হলো ‘লা পেলোতা সিয়েম্প্রে আল ১০’ অর্থাৎ ‘সবসময় ১০ নাম্বারকে বল দাও’।

মুরুয়া হাসতে হাসতে বলেন, আপনি যদি এখানে স্পেসশিপের মতো দেখতে অদ্ভুত কোনো গাড়ি দেখতে পান, বুঝবেন সেই রঙিন জানালার পেছনে লিও (মেসি) বা তার পরিবারের কেউ রয়েছে।

হাইস্কুলে যত্ন করে রাখা মেসির তথ্য সম্বলিত খাতা। ছবি সংগৃহীত

তিনি বলেন, আমি তাদের অভিনন্দন জানাই। তারা একটি পরিবার হিসেবে বেড়ে উঠেছে। আমি তাদের মুদি দোকানে দেখেছি। তারা এমনভাবে ‘হাই’ বলে, যেন আমরা সারা জীবন একসঙ্গে কাটিয়েছি। মেসির পরিবারের কিছু সদস্য এখনো ওই এলাকায় থাকেন।

তবে মাদক যুদ্ধের কারণে রোজারিও শহরটিতে গত এক দশকে সহিংসা বেড়েছে রকেটগতিতে। সেখানে খুন-খারাপির হার জাতীয় গড়ের চেয়ে চারগুণ বেশি। লা বাজাদার পুরোনো বাসিন্দাদের মতে, এলাকাটি আগে শান্তিপূর্ণ থাকলেও আজ সেখানে নিরাপত্তাহীনতার ভয়ংকর অনুভূতি বিরাজমান।

মেসির সাবেক খেলার সঙ্গী সোসি বলেন, আমি সন্ধ্যা ৭টার পর মেয়েকে বাইরে যেতে দেই না। কিছুদিন হলো তাকে একা স্কুল থেকে বাড়িতে আসতে দিচ্ছি, যা মাত্র তিনটি ব্লক দূরে।

মেসির প্রাথমিক বিদ্যালয়। ছবি সংগৃহীত

রাস্তার উল্টো দিকে পৌরসভা ভবনের দিকে ইঙ্গিত করে সোসি বলেন, আগের দিন এর বাইরে সাইকেলে থাকা কেউ গুলি চালিয়েছিল। তখন রাত ছিল এবং কেউ হতাহত হননি।

তিনি বলেন, আমি আমার সন্তানদের বলেছি, গুলির শব্দ শুনলেই মাটিতে শুয়ে পড়বে; এমনকি তা যদি আতশবাজির শব্দও হয়।সোসির কথায়, পুরো এলাকা বদলে গেছে।

তবে একটি জিনিস আজও একই রয়েছে। তা হলো, মেসির প্রতি এলাকাবাসীর ভালোবাসা।

মেসির হাইস্কুলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা সিন্টিয়া ভেগা গর্বিত কণ্ঠে বলেন, সে কখনোই ভুলে যায়নি কোথা থেকে এসেছে। সে কখনোই আর্জেন্টিনার অ্যাকসেন্ট (উচ্চারণের ভঙ্গি) হারায়নি। সে তার দেশ ও শহরকে ভালোবাসে। সে রোজারিনোদের মতোই কথা বলে।

সূত্র: আল জাজিরাকেএএ/