৩৬২ কোটি টাকাসহ এক বছর মেয়াদ বাড়ছে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপন প্রকল্প। প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয়বৃদ্ধির প্রস্তাব জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা অনুমোদন দিয়েছে।
Advertisement
এটিসহ চার হাজার ৮২৬ কোটি ২১ লাখ টাকা ব্যয়ে আটটি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ২ হাজার ৩৪১ কোটি ২ লাখ টাকা, বৈদেশিক অর্থায়ন ২ হাজার ২০৭ কোটি টাকা এবং সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন ২৭৮ কোটি ১৯ লাখ টাকা।
মঙ্গলবার (২২ নভেম্বর) রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত একনেক সভায় এসব প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সভা শেষে বিস্তারিত তুলে ধরেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। এসময় পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
Advertisement
প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিসিএল)। মূল প্রকল্পের ব্যয় ছিল ৬৯৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এখন প্রকল্পের ব্যয় প্রস্তাব করা হবে ১ হাজার ৫৫ কোটি ২৩ লাখ টাকা। ফলে প্রকল্পের ব্যয় বাড়বে ৩৬২ কোটি টাকা। জানুয়ারি ২০২১ থেকে জুন ২০২৪ মেয়াদে প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হওয়ার কথা থাকলে তা বেড়ে জুন ২০২৫ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য: বাংলাদেশের জন্য নির্ভরযোগ্য ও কার্যকরী আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো হিসেবে তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল সিস্টেম স্থাপন।
বিএসসিসিএল জানায়, নানা কারণে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে সাবমেরিন ক্যাবল নেটওয়ার্ক দেশের অন্যতম প্রধান অবকাঠামো হিসেবে বিবেচিত হয়। ইন্টারন্যাশনাল লংডিস্টেন্স টেলিকমিউনিকেশন্স সার্ভিস (আইএলডিটিএস) পলিসি ও আইসিটি নীতিমালার আলোকে দেশের উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট কার্যক্রম বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিসিএল) অন্যতম শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। বিটিআরসি হতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ইন্টারন্যাশনাল টেরেস্ট্রিয়াল কেবল (আইটিসি) সার্ভিসেস অপারেটররা একই কার্যক্রম পরিচালনা করলেও দেশের ইন্টারনেট চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ ব্যান্ডউইথ বিএসসিসিএল এককভাবে সরবরাহ করছে।
আরও পড়ুন: তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবলে বাড়ছে আরও ৩৬২ কোটি
Advertisement
দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় কোম্পানি হিসেবে বিএসসিসিএল সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে ব্যান্ডউইথ সেবা দিয়ে আসছে। কক্সবাজার ও কুয়াকাটায় ল্যান্ডিং স্টেশন স্থাপন করে সাবমেরিন ক্যাবল দুটির মাধ্যমে বর্তমানে বিএসসিসিএল বহির্বিশ্বের সঙ্গে দেশের সংযোগের জন্য ব্যান্ডউইথ সেবা দিচ্ছে। গত কয়েক বছরে দেশের বিএসসিসিএল ও আইটিসি ব্যান্ডউইথ ব্যবহার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বার্ষিক ব্যান্ডউইথ ব্যবহার বৃদ্ধির হার প্রায় ৭০ শতাংশ।
২০১৬ সালের শুরু থেকে বিএসসিসিএল এর ব্যান্ডউইথ বিক্রয়ের মার্কেট শেয়ার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করে এবং বর্তমানে বিএসসিসিএল এর মার্কেট শেয়ার প্রায় ৬০ শতাংশ। বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, ব্যান্ডউইথ এর এই ঊর্ধ্বমুখী ব্যবহারের প্রবণতা পরবর্তী কয়েক বছরের জন্য অব্যাহত থাকবে। ফাইভ-জি সেবা বৃহৎ পরিসরে চালু হলে দেশে ব্যান্ডউইথ এর চাহিদা আরও বৃদ্ধি পাবে।
দেশের প্রথম সাবমেরিন ক্যাবল ২০০৫ সালে এবং দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবল ২০১৭ সালে চালু হয়। প্রথম সাবমেরিন ক্যাবলের আয়ু আনুমানিক ২০ বছর বিবেচনায় আগামী ২০২৫ সালে এর কার্যক্ষমতা শেষ হয়ে যাবে। এছাড়া সাবমেরিন ক্যাবলটি প্রায় ১৫ বছরের পুরোনো হওয়ায় এর রক্ষণাবেক্ষণের কারণে সেবা বিঘ্নিত হওয়ার হার বেশি এবং তুলনামূলক পুরোনো প্রযুক্তির কারণে এই ক্যাবলের সংযোগ গ্রহণে ব্যবহারকারীরা কম আগ্রহী।
প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম: বৈদ্যুতিক ও অন্যান্য সরঞ্জাম সংগ্রহ, সাবমেরিন ক্যাবল ও সংশ্লিষ্ট সরঞ্জাম সংগ্রহ, অনাবাসিক ভবন (ফাংশনাল বিল্ডিং) ও অন্যান্য ভবন নির্মাণ।
প্রকল্প এলাকা: সিঙ্গাপুর হতে ফ্রান্স পর্যন্ত সংযুক্ত। সাবমেরিন ক্যাবলটি ভারত মহাসাগর, আরব সাগর, লোহিত সাগর হয়ে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। ক্যাবলটির কোর ল্যান্ডিং স্টেশন হবে সিঙ্গাপুর, ভারত, জিবুতি, মিশর ও ফ্রান্সে। বাংলাদেশের ব্রাঞ্চটি বঙ্গোপসাগর হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশন পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। কেবল রুটটি একদিকে সিঙ্গাপুর ও অন্যদিকে ফ্রান্স পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। কক্সবাজার ল্যান্ডিং স্টেশন থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ইন্টারনেট সেবা দেওয়া হবে।
প্রকল্প সংশোধনের কারণসমূহ: প্রকল্পের আওতায় ব্যান্ডউইথ ক্যাপাসিটি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে কোর অংশে আট জোড়া ফাইবার ক্যাবল স্থাপনের পরিকল্পনা থাকলেও পরে খরচের সুবিধা বিবেচনায় মোট ১০ জোড়া ফাইবার স্থাপনের বিষয়ে কনসোর্টিয়ামে সিদ্ধান্ত হয়। বর্তমানে ডলারের মূল্য বেড়েছে, ফলে বাড়ছে প্রকল্পের ব্যয়। প্রকল্প গ্রহণের সময় এক মার্কিন ডলার সমান ৮৪ টাকা ছিল, এখন বেড়ে হয়েছে ১০৬ টাকা ৭৫ পয়সা। মূল প্রকল্পে বৈদেশিক খাতে ব্যয় বাড়ছে।
অনুমোদিত প্রকল্পগুলো হলো- সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের ৩টি প্রকল্প যথাক্রমে ‘কুমিল্লা সড়ক বিভাগাধীন ৪টি জেলা মহাসড়ক যথাযথমান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ’ প্রকল্প; ‘লেবুখালী-বাউফল-গলাচিপা-আমড়াগাছিয়া জেলা মহাসড়কের (জেড-৮৮০৬) ৭০তম কিলোমিটারে রাবনাবাদ নদীর ওপর গলাচিপা সেতু নির্মাণ’ প্রকল্প, ‘ট্রান্সপোর্ট মাস্টার প্ল্যান অ্যান্ড প্রিলিমিনারি ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি ফর আরবান মেট্রোরেল ট্রানজিট কন্সট্রাকশন অব চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এরিয়া (সিএমএ) প্রকল্প; স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের ‘উপকূলীয় শহর জলবায়ু সহিষ্ণু’ প্রকল্প।
আরও পড়ুন: তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল সংযোগে আরও ১৫ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ
এছাড়াও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘কারা নিরাপত্তা আধুনিকায়ন, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম বিভাগ (প্রথম সংশোধিত)’ (৫ম বার মেয়াদ বৃদ্ধি) প্রকল্প; তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের ‘জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অবকাঠামো উন্নয়ন (ইনফো-সরকার ৩য় পর্যায়) (৩য় সংশোধিত)’ প্রকল্প এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের ‘কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা জোরদারকরণ’ প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয় একনেকের বৈঠকে।
বৈঠকে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরা অংশ নেন।
এছাড়াও মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব, এসডিজি’র মুখ্য সমন্বয়ক, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যরা, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহের সিনিয়র সচিব ও সচিব এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এমওএস/ইএ/জেআইএম