মতামত

ফুটবলে নেই, উন্মাদনায় সেরা

বছর ১২ আগে একবার যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেখানেই এক অনুষ্ঠানে এক ব্রাজিলিয়ান সুন্দরীর সাথে দেখা। একে তো ব্রাজিলিয়ান, তার ওপর সুন্দরী। একটু স্বভাববিরুদ্ধভাবেই আমি আগ বাড়িয়ে তার সাথে পরিচিত হলাম। ভাববেন না সুন্দরী হলেই আমি আগ বাড়িয়ে কথা বলি।

Advertisement

আসলে একজন ব্রাজিলিয়ানকে সামনে পেয়ে ছেলেবেলা থেকে ব্রাজিলের ফুটবল সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে থাকা আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি। কিন্তু কথা বলতে গিয়ে একটু হতাশই হতে হলো। ফুটবল নিয়ে তার আগ্রহ সামান্যই। অনেক কষ্টে নেইমারের নাম মনে করতে পারলেন। নেইমার তখন মাত্র ফুটছেন। তাকে নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনা। তাই হয়তো নামটি মোটামুটি চেনা।

তাকে যখন বললাম, বিশ্বকাপের সময় বাংলাদেশের চেহারা পাল্টে যায়, ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায় গোটা বাংলাদেশ, এ নিয়ে ঝগড়াঝাটি, এমনকি মারামারি, খুনোখুনিও হয়; শুনে তার চেহারাটা দেখার মতো হয়েছিল। আমি যা বলছিলাম, তার কিছুই তিনি বিশ্বাস করছিলেন না। বাংলাদেশ নামে একটি ছোট্ট দেশ, যে দেশটির নামই তিনি কখনো শোনেননি, সেই দেশে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে এমন যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, সেটা না দেখলে কেইবা বিশ্বাস করবে।

এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের রক্তে মিশে আছে ফুটবল। আশির দশক পর্যন্ত ফুটবলই ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ মানেই গুলিস্তান রণক্ষেত্র। ঢাকার সেই উত্তেজনার রেশ ছড়িয়ে পড়তো গ্রামে-গঞ্জে, আনাচে কানাচে। এখন ফুটবল নেই, আবাহনী-মোহামেডান নেই; আছে শুধু ক্রিকেট। আর ক্রিকেট মানেই জাতীয় দলের খেলা।

Advertisement

ক্রিকেটের এই উন্মাদনা এসেছে সাফল্যের পথ ধরে। বাংলাদেশ কখনো ফুটবল বিশ্বকাপে খেলেনি, কবে খেলবে বা আদৌ খেলবে কি না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সেখানে ক্রিকেটে বাংলাদেশে বৈশ্বিক সব টুর্নামেন্টেই খেলছে এবং সমানে সমানেই খেলছে। আগামী বছর দশেকের মধ্যে বাংলাদেশ ক্রিকেটে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু খেলাধুলায় সাফল্যই শেষ কথা নয়।

বাংলাদেশের মানুষ যতই ক্রিকেট নিয়ে মাতামাতি করুক, তাদের রক্তে মিশে আছে ফুটবল। চার বছর পর বিশ্বকাপ এলেই সেই রক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকে। আর বাংলাদেশ বিভক্ত হয়ে যায় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনায়। বাংলাদেশে অল্পকিছু জার্মানি, ইতালি, ইংল্যান্ড, এমনকি একসময় ক্যামেরুনেরও কিছু সমর্থন ছিল। তবে মোটা দাগে বাংলাদেশের ভাগটা হলো ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা।

পেলের জাদু প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়েছে বলে একসময় বাংলাদেশে শুধু ব্রাজিলেরই সমর্থক ছিল। ১৯৮৬ সালে ম্যারাডোনার ঐন্দ্রজালিক পারফরম্যান্স শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বকেই মুগ্ধ করে। সেই থেকে বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার সমর্থক গোষ্ঠীর বিস্তার। আমি নিজে ব্রাজিল সমর্থক বটে, কিন্তু জানি বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার সমর্থকই বেশি। কিন্তু বাংলাদেশে সমর্থকের সংখ্যা দিয়ে তো আর বিশ্বকাপ জেতা যাবে না, তাই ’৮৬ এর পর আর্জেন্টিনারও আর শিরোপা জেতা হয়নি।

আওয়ামী লীগ-বিএনপি, আবাহনী-মোহামেডানের মতো বাংলাদেশের মানুষ ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা প্রশ্নেও অন্ধ। ব্রাজিল সমর্থকদের চোখে ম্যারাডোনা বা মেসি কোনো খেলোয়াড়ই না। আবার আর্জেন্টিনা সমর্থকরাও পেলে বা নেইমারের শ্রেষ্ঠত্ব মানতে নারাজ। কিন্তু কোনোটাই সত্যি নয়। পেলে যেমন সর্বকালের সেরাদের একজন, ম্যারাডোনাও। বিশ্বকাপ জিততে পারলে মেসি বা নেইমারও সর্বকালের সেরাদের তালিকায় নাম লেখাতে পারবেন।

Advertisement

খেলাধুলাটা করাই হয় আনন্দের জন্য। খেলাধুলায় কিন্তু প্রতিযোগিতা লেখা হয় না, প্রতিদ্বন্দ্বিতা লেখা হয়। কিন্তু আমরা প্রতিযোগিতা আর প্রতিদ্বন্দ্বিতার পার্থক্য ভুলে মেতে উঠি প্রাণঘাতী প্রতিযোগিতায়। বিশ্বকাপ শুরুর আগেই প্রিয় দলের পতাকা লাগাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকজনের মৃত্যুর খবর এসেছে। বিশ্বকাপ শুরুর পর এই উন্মাদনা কোথায় যাবে, অতীত অভিজ্ঞতার কথা ভেবে আমি শিউড়ে উঠি।

মেসি আর নেইমার হয়তো একসাথে কফি খাচ্ছেন, আর তাদের পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ রক্তারক্তি করছে। এ উন্মাদনা সত্যি অবিশ্বাস্য। প্রতিদিনই পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে মাতামাতির খবর। কেউ প্রিয় দলের পতাকার রঙে অটোরিকশা রাঙিয়ে ফেলছেন, কেউ গোটা বাড়ির রঙই বদলে দিচ্ছেন। কে কার চেয়ে বড় পতাকা বানাতে পারেন, তাই নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতা সীমা আসলে অসীম।

আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিলে কোনোদিন তাদের দেশের তিন হাজার ফুট পতাকা বানানো হয়েছে? আমি নিশ্চিত হয়নি। বাংলাদেশে অহরহ হচ্ছে। আচ্ছা বাংলাদেশে কোনোদিন তিন হাজার ফুট দীর্ঘ বাংলাদেশের পতাকা বানানো হয়েছে? আমি নিশ্চিত হয়নি। ডিসেম্বর আর মার্চে রাস্তায় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা বিক্রি হয়। এবার বাংলাদেশের সাথে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার পতাকাও বিক্রি হচ্ছে। আমি নিশ্চিত, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকার বিক্রি বেশি।

আমার এক বন্ধু আছে রাজনীতি করেন, পেশায় ব্যবসায়ী। ছেলেবেলা থেকেই ব্রাজিলের সমর্থক। বরাবরই আয়োজন করে খেলা দেখেন। এবারও কর্মীদের নিয়ে দলেবলে খেলা দেখতে প্রজেক্টর কিনেছেন। আগামী একমাস তাকে আর কেউ পাবে না। রাজনীতি-ব্যবসা সব তোলা থাকবে। একমাস তিনি বুঁদ হয়ে থাকবেন বিশ্বকাপে।

শুধু আমার এই বন্ধু নন, বাংলাদেশের কোটি মানুষ আগামী একমাস ফুটবলের নেশায় মেতে থাকবে। নানা আয়োজনে মানুষ খেলা দেখবে। বাংলাদেশের টিভির বিক্রি বেড়েছে। ফুটবল নিয়ে এই মাতামাতিটা আমার ভালোই লাগে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকলে খেলা দেখে মজা নেই। খালি একটা অনুরোধ খেলাকে যেন আমরা খেলা হিসেবেই নেই।

কাল রাতে কাতারের মরুভূমিতে যে জমকালো আয়োজনে বিশ্বকাপের পর্দা উঠলো, ফুটবল মাঠে গড়ানোর আগেই তা পরিণত হয়েছে সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত বিশ্বকাপে। কখনো বিশ্বকাপ না খেলা কাতার বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পেয়েছে আসলে টাকার জোরে। আর এই টাকার জোরটা সবসময় বৈধপথে ছিল না। তাই শুরু থেকেই কাতার বিশ্বকাপ নিয়ে সমালোচনার ঝড়।

সেই ঝড়কে তারা মরুভূমির বালিতে চাপা দিতে চেয়েছে সেও টাকার জোরেই। প্রথমবারের মধ্যপ্রাচ্যে বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে এবং তাপমাত্রাকে সামাল দিতে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ হচ্ছে শীতকালে। আর গরমকে বুড়ু আঙুল দেখাতে কাতার সব স্টেডিয়াম বানিয়েছে কেন্দ্রীয় শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায়। কিন্তু টাকা দিয়ে সবার মুখ বন্ধ করা যায়নি।

বিশ্বকাপের নির্মাণজ্ঞে শ্রমিকদের মৃত্যু, মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। এই যুক্তিতে অনেকে কাতার বিশ্বকাপ বর্জনও করেছেন। শেষ মুহূর্তে এসে স্টেডিয়ামে বিয়ার বা অ্যালকোহল খেতে নিষেধাজ্ঞা, সমকামিতা নিষিদ্ধ থাকা নিয়েও অনেক সমালোচনা হচ্ছে। এমনকি প্রথম ম্যাচে জয় পেতে ইকুয়েডরের খেলোয়াড়দের ঘুস দিয়েছে কুয়েত, এমন অভিযোগও উঠেছে।

তবে একজন ফুটবল অনুরাগী হিসেবে, এইসব বিতর্ক নয়, আমি অপেক্ষায় আছি, ফুটবলের। মরুর বুকে ফুটুক ফুটবল সৌন্দর্যের ফুল। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা তো চিরকালীন ফেবারিট। আছে ফ্রান্স, স্পেন, ইংল্যান্ডের নামও। এক রোনালদোর কারণে পর্তুগালকে বাদ দেওয়া যায় না। ইতালি না থাকায় অনেকেরই মন খারাপ। শেষ মুহূর্তে এবারের ব্যালন ডিঅর জেতা করিম বেনজেমার ছিটকে পড়া বিস্ময় জাগিয়েছে। এবারের বিশ্বকাপ মেসি, রোনালদো এবং নেইমারের শেষ বিশ্বকাপ। নিয়তি কার হাতে তুলে দেবেন শ্রেষ্ঠত্বের বরমাল্য। সে জন্য অপেক্ষা করতে হবে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম