অর্থনীতি

দাম বেড়েছে বিলাসী সিরামিক পণ্যের, কমেছে ক্রেতা

#বাড়ছে কারখানা, বেড়েছে উৎপাদনও #সিরামিক তৈজসপত্রে নন্দনশৈলীর প্রভাব#যত বেশি ডিজাইন, তত বেশি দাম#ক্রেতাদের ঝোঁক মাঝারি মান-দামের পণ্যে

Advertisement

আশি-নব্বইয়ের দশকেও দেশে তেমন কোনো সিরামিক কারখানা ছিল না। হাতেগোনা দু-তিনটি কারখানায় উৎপাদন হতো এ পণ্য। ফলে অনেকটা আমদানিনির্ভরই ছিল সিরামিক খাত। তবে ২০-২২ বছরে একের পর এক কারখানা গড়ে উঠেছে দেশে। বেড়েছে উৎপাদনও। বর্তমানে বেশ রমরমা সিরামিক পণ্যের বাজার। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশে উৎপাদিত সিরামিক পণ্য। সিরামিকের এসব তৈজসপত্রে নন্দনশৈলী লক্ষণীয়। ক্রেতা টানতে উৎপাদকরা বিভিন্ন ডিজাইনের পণ্য তৈরি করেন। পণ্যের মানের পাশাপাশি ভালো ডিজাইনও সিরামিক তৈজসপত্রের ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যে পণ্যের ডিজাইন যত ভালো, বাজারে তার চাহিদা এবং দামও তত বেশি।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ক্রেতাদের বেশি পছন্দ মাঝারি মান ও দামের সিরামিক তৈজসপত্র। মাঝারি দামের আকর্ষণীয় ডিজাইনের পণ্যে বেশি ঝোঁক তাদের। ক্রেতাদের এমন চাহিদার বিষয় মাথায় রেখে উৎপাদকরাও এ ধরনের পণ্য বেশি বাজারজাত করছেন। তবে বর্তমানে অর্থনৈতিক সংকটে আগের চেয়ে সিরামিক পণ্যের বেচাকেনা অর্ধেকে নেমেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের প্রথম সিরামিক ইন্ডাস্ট্রি ‘তাজমা সিরামিক’। এটি চালু হয় পঞ্চাশের দশকে। আশির দশকে এ খাতে মুন্নু সিরামিক বিপ্লব ঘটায়। এরপর ধীরে ধীরে ফার সিরামিক, সাইনপুকুর সিরামিকস, আরএকে সিরামিকস, ডিবিএল সিরামিক, স্টার সিরামিকস, আকিজ সিরামিকস, প্যারাগন সিরামিকস, প্রতীক সিরামিকস, বান থাই সিরামিক, ফুওয়াং সিরামিকসহ দেশে ৫০টির বেশি কারখানা গড়ে ওঠে। মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও হবিগঞ্জসহ বেশ কয়েক জেলায় রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানের কারখানা। এসব কারখানায় সিরামিকের তৈজসপত্র বা টেবিলওয়্যার, টাইলস ও স্যানিটারি ওয়্যার তৈরি করা হয়।

Advertisement

সিরামিক শিল্পের মূল কাঁচামাল হলো ক্লে বা খনিজ মাটি। আর উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন হয় গ্যাস ও বিদ্যুৎ। তৈজসপত্রের উৎপাদনব্যবস্থা আধুনিক যন্ত্রপাতি ও নন্দনশৈলীর ওপর নির্ভরশীল। পণ্যের মানের চেয়ে এর নান্দনিক মূল্য অনেকাংশে বেশি বিবেচিত হয়। দেশের বাজারে নন্দনশৈলীর সিরামিকের তৈজসপত্রের বিক্রি বেশি। বিদেশে যেসব পণ্য রপ্তানি হয়, সেটাতেও ডিজাইনের বেশি প্রভাব। এর মধ্যে বিভিন্ন আকৃতির প্লেট, গ্লাস, মগ, চায়ের কাপসহ নানা ধরনের জিনিস রয়েছে।

পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় সিরামিকের জমজমাট বাজার। এখানে পাইকারি কেনাবেচা বেশি। তবে খুচরাও বিক্রি হয়। সরেজমিনে দেখা গেছে, দোকানগুলোতে সারি সারি সাজানো সিরামিকের তৈজসপত্র। তাতে বাহারি নন্দনশৈলী। দেশীয় ঐতিহ্য থেকে শুরু করে ফুল, পাতাসহ নানান ধরনের নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বিশ্বকাপ ফুটবলের নন্দনশৈলীও রয়েছে অনেক পণ্যে। কোনোটায় আবার এসবের কিছুই নেই। একেবারে সাদা, কালো, লাল কিংবা একই রঙের। নেই কোনো ডিজাইনও।

মালিক ও দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় বাজারে মধ্যম ও উচ্চমধ্যম আয়ের মানুষের চাহিদার কথা মাথায় রেখে পণ্য তৈরি হয়। তাতে বিভিন্ন ডিজাইন করা হয়। ডিজাইন যত বেশি, দামও তত বেশি। একই মানের পণ্য ভালো ডিজাইনের কারণে দাম বেশি। সাধারণ ডিজাইনের যে পণ্য তিন হাজার টাকা, ভালো ডিজাইন করা একই পণ্য প্রকারভেদে ২০-২৫ হাজার টাকায়ও বিক্রি হয়।

মিটফোর্ডের এই বাজারে জাম্মু, স্কয়ার, নেসকোপিসহ বিভিন্ন ডিজাইনের মগ রয়েছে। টেন মিট, নাইন মিট, সেভেন মিট, নাইন স্যুপসহ বেশকিছু ভালো ডিজাইনের মগ এখানে বিক্রি হচ্ছে। প্লেট, চায়ের কাপসহ সিরামিকের তৈজসপত্রে আরও নানা ধরনের নন্দনশৈলী। ডিজাইনের ডিনার সেটগুলো সব দোকানে ক্রেতাদের মনও কাড়বে। সাধারণ ডিজাইনের ডিনার সেট যেখানে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকায় কেনা যায়, সেখানে ডিজাইনের কারণে একই ডিনার সেটের দাম ২০-২৫ হাজার টাকা।

Advertisement

যেমন- পুরো সেটে বাহারি নন্দনশৈলীর হাসন রাজা ডিনার সেটের দাম ২২ হাজার টাকা। তবে ৫২ পিসের সাধারণ ডিজাইনের একই মানের ডিনার সেটের দাম ছয় হাজার টাকা। বিভিন্ন ধরনের ডিজাইনের সঙ্গে দামের পার্থক্যের বিষয়ে ফারুক এন্টারপ্রাইজের মালিক বদরুল আলম সমাপ্ত জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডিজাইনের ওপর দাম নির্ভর করে। পণ্যে জেনারেল ডেকোরেশন হলে দাম কম হবে। আর বর্ডার ডেকোরেশন হলে দাম বেশি হবে।’

ক্রেতাদের আগ্রহ বেশি ডিজাইন করা পণ্যের প্রতি। তবে যে পণ্যের নন্দনশৈলী যত বেশি, সেই পণ্যের দাম বেশি হওয়ায় সামর্থ্যের মধ্যেই পণ্য কেনেন তারা। সেক্ষেত্রে আড়াই হাজার থেকে ছয় হাজার টাকা দামের মধ্যে থাকা ডিনার সেটই বেশি বিক্রি হচ্ছে।

আরও পড়ুন: নির্মাণসামগ্রীর অস্বাভাবিক দামে টালমাটাল দেশের আবাসনখাত

ডিনার সেট কিনতে আসা কবির হোসাইন নামের এক ক্রেতা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগের চেয়ে দাম অনেক বেড়েছে। তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকার জিনিসের দাম এখন চাওয়া হচ্ছে পাঁচ হাজার টাকা। বাধ্য হয়েই হালকা ডিজাইনের ডিনার সেট কিনতে হচ্ছে।’

জাহিদ ক্রোকারিজের মালিক জাহিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘কম ডিজাইনের দুই হাজার ৫০০ টাকার ডিনার সেট বেশি চলছে। তবে অনেকে পছন্দের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ডিনার সেটও সাড়ে ৫০০ টাকায় কিনছেন।’

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বিলাসীপণ্যের বেচাকেনা আগের চেয়ে অনেকটাই কমেছে। অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে এমনটা হয়েছে বলে মনে করেন সিরামিক দোকানিরা।

আরও পড়ুন>> টালমাটাল বাজার: অর্ধেকে নেমেছে টাইলস বিক্রি

সগির প্লাস স্টোরের দোকানি মো. শামীম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগে কাস্টমার বেশি আসতো। এখন একেবারেই কমে গেছে। আগে যে পণ্য এক হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার ২০০ টাকায় কিনতাম, তা এখন পাইকারিতে দুই হাজার ৮০০ টাকা। বাধ্য হয়ে সীমিত লাভে বিক্রি করছি। সিরামিকের ভাত খাওয়ার প্লেট আগে যেখানে ৯০০ টাকা বিক্রি করতাম, এখন তা কিনতে হচ্ছে দেড় হাজার থেকে এক হাজার ৬০০ টাকায়।’

শাহনাজ ট্রেডার্সের মালিক বোরহান উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘মানুষের হাতে টাকা নেই। পণ্য বিক্রি হচ্ছে খুবই কম। সব খরচ বাদ দিলে আগের মতো আর লাভ থাকে না। একেবারে সীমিত লাভে কোনোরকম টিকে আছি।’

অর্থনৈতিক মন্দা, গ্যাস, বিদ্যুৎ সংকটের কারণে সিরামিক পণ্য উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। একদিকে উৎপাদন খরচ বেড়েছে, অন্যদিকে বাজারে বিক্রি কমেছে। আবার সিরামিক পণ্য উৎপাদন ও ডিজাইনের জন্য গ্যাসের চাপ অধিক থাকতে হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে কারখানায় গ্যাসের চাপ কম থাকছে। এতে উৎপাদিত পণ্য অল্প সময়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলেও জানান দোকানিরা।

আরও পড়ুন: গ্যাস সংকটে বড় ক্ষতির মুখে সিরামিক খাত 

বাংলাদেশ ক্রোকারিজ মার্সেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি মো. সগীর জাগো নিউজকে বলেন, ‘চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস না পাওয়ায় কারখানায় উৎপাদন কমেছে। যেসব পণ্য উৎপাদন হচ্ছে, তাতে খরচ পড়ছে বেশি। উৎপাদন খরচ বাড়ায় দামও বাড়ানো হয়েছে। তবে কারখানায় গ্যাসের চাপ কম থাকায় উৎপাদিত অনেক পণ্যের রং দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে বাড়তি লোকসান গুনতে হচ্ছে।’

আরএসএম/এএএইচ/এসএইচএস/জিকেএস