পাবনার চাটমোহর উপজেলায় ‘ডিজিটাল ক্লাস টিচার’ ডিভাইসের ছোঁয়ায় বদলে গেছে প্রাথমিক শিক্ষার শ্রেণি কার্যক্রম। শিক্ষকরা এখন আনন্দময় পরিবেশে পাঠদান করান। এতে শিশু শিক্ষার্থীরা পাঠে মনোযোগী হচ্ছে, শিখনফলও হচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী। আর শ্রেণিকক্ষে আনন্দ পাওয়ায় শিশুদের উপস্থিতি বেড়েছে, বন্ধ হয়েছে ঝড়ে পড়া।
Advertisement
চাটমোহর উপজেলার ১৫৫টি বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য সংযোজন করা হয়েছে ‘ডিজিটাল ক্লাস টিচার’ নামে একটি ডিভাইস। এ ডিভাইসটিতে পাঠ্য বইয়ের পুরো সিলেবাস সন্নিবেশ করা রয়েছে। আর পাঠ্য বইয়ের পুরো অংশ প্রিন্ট করা হয়েছে ওয়াল ক্যালেন্ডার আকারে। ক্যালেন্ডার আকারে মুদ্রিত বইটি শ্রেণিকক্ষের বোর্ডে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। শিক্ষকের এক হাতে থাকে নির্দেশক ডিজিটাল কলম (পেন) আর অন্য হাতে বা প্যান্টে ঝুলিয়ে রাখা হয় মিনি সাউন্ড বক্স। এতে শিক্ষক বইয়ের যে অক্ষরে বা ছবিতে ডিজিটাল কলমটি ধরেন সেটা বক্সে একাধিকবার স্বয়ংক্রিয়ভাবে উচ্চারিত হতে থাকে। এতে পাঠটি শিশুদের আত্মস্থ করতে সুবিধা হয় আর শিক্ষককেও হয়রানি হতে হয় না। এছাড়া পাঠের শুরুতে জাতীয় সংগীত বাজানোর ফলে বিদ্যালয়ে ভর্তির প্রথম বছরেই তাদের জাতীয় সংগীত মুখস্থ হয়ে যায়। আর ক্লাসে একঘেয়েমি দূর করার জন্য মাঝেমধ্যেই শিশুতোষ ও শিক্ষণীয় গান শোনানো হয়।
চাটমোহর উপজেলার ভাদ্রা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দোলং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আফ্রাতপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বোথর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বেশকিছু বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, শিশুরা নেচে-গেয়ে ক্লাস করছে। ডিজিটাল ক্লাস টিচারে জাতীয় সংগীত বেজে উঠতেই শিশুরা সব উঠে দাঁড়িয়ে ঠোঁট মিলিয়ে গাইছে। মিনি সাউন্ড বক্সে কোনো বর্ণমালার নাম উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুরা নির্দেশক কাঠি দিয়ে বোর্ডে সেই অক্ষরের ওপর নিয়ে তা দেখাচ্ছে। আবার সাউন্ড বক্সে শোনা অক্ষরের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে তারা তা বলছে। কিছু সময় ধরে ক্লাস করার পর শিশুদের বিনোদন দেওয়া বা প্রশান্তির জন্য জন্য মিনি সাউন্ড বক্সে বেজে উঠছে শিশুতোষ ছড়া বা গান। তারা শিক্ষক/শিক্ষিকার সঙ্গে নেচে-গেয়ে আবার উদ্দীপ্ত হয়ে উঠছে।
শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাঁচ বছর বয়সী শিশুরা প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিতে ভর্তি হয়। এ শিশুদের পড়ানো, নিয়মকানুন শেখানো অনেক কষ্টের ও ধৈর্যের। সরকারি নির্দেশনা রয়েছে তাদের সুসজ্জিত শ্রেণিকক্ষে বসার ব্যবস্থাসহ আনন্দদায়ক পরিবেশে পাঠদান করাতে হবে। এ কাজটি অনেক সহজ করে দিয়েছে ডিজিটাল ক্লাস টিচার নামে ডিভাইসটি। এর মাধ্যমে শিক্ষককে সহায়তাকারী আরেক শিক্ষক যেন কাজ করেন শ্রেণিতে। ডিভাইসের মাধ্যমে শিক্ষক যেমন অধিক শ্রম থেকে বেঁচে যান তেমনি ক্লাসটি শিশুদের কাছে হয় আনন্দময় ও চিত্তাকর্ষক। সে হিসেবে ডিভাইসটি ‘ডিজিটাল ক্লাস টিচার’ নামে পরিচিতি পায়।
Advertisement
প্রাক-প্রাথমিকের ছোট্ট শিশুরাও এখন ক্লাসে খুব মজা পায় বলে জানায়। আফ্রাতপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ফারজানা আলম জান্নাতুল (৫) নামে এক শিশু বললো, এখন ক্লাস করতে আমার অনেক ভালো লাগে। ম্যাডাম, এখন অক্ষর শেখানোর পাশাপাশি গান শোনান, ছবি দেখান।
আবদুল্লাহ আল নোমান নামে আরেক শিশু শিক্ষার্থী জানায়, অক্ষর শেখার পাশাপাশি তার কবিতা, গান ভালো লাগে। সাদিয়া ইসলাম তোয়া বললো, আমরা এখন সুরে সুরে পড়ি। ক্লাসে আমরা পড়ি, গান গাই, নাচি। এখন ক্লাসে খুব মজা লাগে।
শ্রেণি শিক্ষকরাও ডিভাইসটি ব্যবহার করে ক্লাস নিয়ে আনন্দ পান বলে জানান। আফ্রাতপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিতে ক্লাস নিচ্ছিলেন সৈয়দা দিল আফরোজা। তিনি জানান, একেবারে ছোট এসব শিশুকে পাঠ দেওয়া ও তাদের পাঠে মনোযোগী করা বেশ কঠিন। তবে ক্লাসটিকে আনন্দমুখর করতে পারলে তাদের শিক্ষা দেওয়া সহজ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ডিজিটাল ক্লাস টিচার একটি সফল প্রযুক্তি। তার ক্লাসে এখন উপস্থিতির হার বেশি। এছাড়া কোনো শিশু আর ঝড়ে পড়ছে না।
ভাদ্রা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিতে ক্লাস নিচ্ছিলেন সরোয়ার জাহান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ডিজিটাল ক্লাস টিচারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা এখন অনেক মনোযোগী। তারা সহজে শিখতে পারছে ও আত্মস্থ করতে পারছে। আমাদের কথা ছাড়াও ডিভাইসের মাধ্যমে শিশুরা অনেক কিছু শিখতে পারে ও ধরে রাখতে পারে। সর্বোপরি ক্লাসটি তাদের কাছে আকর্ষণীয় ও আনন্দদায়ক হয়ে উঠছে। আগের চেয়ে পাঠদান প্রক্রিয়া অনেক সহজ ও ফলপ্রসূ।
Advertisement
আফ্রাতপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সামিনুল ইসলাম বলেন, ডিজিটাল ক্লাস টিচারের মাধ্যমে পাঠদান করায় শিশুরা আনন্দের সঙ্গে পাঠ নিচ্ছে। এটা শিশুদের জন্য মজাদার, আনন্দদায়ক। তারা ছড়া, গান, কবিতা, নাচ-গানের মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করছে। এতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, শিশুরা কিন্তু আর ক্লাসে বিরক্তি প্রকাশ করে না। তাদের একঘেয়েমি কেটে যাওয়ায় পাঠে অধিক মনোযোগী হচ্ছে।
চাটমোহর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা খন্দকার মাহবুবুর রহমান বলেন, প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের শিক্ষাকে টেকসই ও মানসম্মত পর্যায়ে পৌঁছে দিতে সহায়তা করছে। এমনই একটি প্রযুক্তি ডিজিটাল ক্লাস টিচার। গুরুত্ব উপলব্ধি করে চাটমোহর উপজেলায় এর সফল সংযোজন ঘটানো হয়েছে। এর সুফল এরইমধ্যে পাওয়া শুরু হয়েছে।
তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীরা আনন্দের সঙ্গে শিখছে। তাদের শিখনফল দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। স্কুলে আসার প্রতি তাদের আগ্রহও বেড়েছে। সর্বোপরি প্রাক শিক্ষাকে টেকসই ও মানসম্মত পর্যায়ে পৌঁছে দিতে সহায়তা করছে ডিজিটাল ক্লাস টিচার। এর ফলে উপজেলার সব স্কুলে শিশুরা বিদ্যালয়ে এসে আনন্দের সঙ্গে পড়ছে, উপস্থিতির হারও বাড়ছে।
এমআরআর/জেআইএম