মতামত

শুধু শেষবার তুমি ভেবে দেখ

একফালি জোছনা জানালার ফাঁক গলে বিছানায় ঘুমন্ত আমার ছোট্টসোনার মায়ামাখা মুখে পড়েছে। যেন দেবশিশু। অথচ জন্মের বছর না ঘুরতেই বাবুর বাবা বেছে নিয়েছে অন্য জীবন। সে আমাদের সাথে প্রতারণা করেনি বরং স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে তার জীবনে আমরা অপ্রয়োজনীয়। স্বামী পরিত্যক্তা আমি ফিরে আসি বাবার বাড়ি।বাবামায়ের সংসারে ভাই ভাবী দিব্যি আছেন কিন্তু আমাদের উপস্থিতি যেন ক্রমশই অনাকাঙ্খিত ঠেকল ভাবীর কাছে। আমার কলেজের চাকরি, টিউশনির উপার্জন, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার তকমা কোনোকিছুই আমায় স্বনির্ভর করতে পারল না। কারণ আমি বাবা মায়ের সংসারে, সেখানেতো মেয়ের কোনো স্থান নেই!গত বছর দুয়েকে এক রকম ভাগ্যকে মেনে নিয়ে সব গঞ্জনা মুখ বুঝে সয়ে নিতে শিখে গিয়েছিলাম। এখন জীবনের একটাই লক্ষ্য বাবুসোনাকে মানুষ করা। কিন্তু হঠাৎ যেন বাজ পড়ল আমার ওপর। একা নারীকে এ সমাজ কোনোদিনই মেনে নিতে চায়নি আর যদি সে হয় তালাকপ্রাপ্ত শিক্ষিত কর্মজীবী নারী তবেতো মেনে নেবার প্রশ্নই ওঠে না। প্রতিনিয়ত হাজারো প্রশ্নবানে ক্ষতবিক্ষত হই আমি। কর্মক্ষেত্রে, পরিবার পরিসরে। জীবনকে আজকাল বড্ড ভারী মনে হয়। প্রতি মুহূর্ত যেন কাটে অতি আকাঙ্খিত মৃত্যুর অপেক্ষায়। দেহ থেকে আত্মার মুক্তিই যেন দিতে পারে আমায় এক চিলতে সুখ। কিন্তু বাবু?বহুবার ভেবেছি আত্মহত্যাই আমার একমাত্র মুক্তির পথ। কিন্তু এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আমার বাবুসোনার যে কোনো ঠাঁই নেই, নেই আশ্রয়, নেই নিরাপত্তা। বাবুর জন্যই আমাকে দৃঢ়চিত্তে এ জগৎ সংসার মোকাবেলা করতে হবে। সংগ্রাম করতে হবে নিজের সম্মান প্রতিষ্ঠায়। সতীত্বের প্রমাণ দেবো না আমি বরং আজ পুরুষতান্ত্রিকতার বীজের ফসল তথাকথিত আধুনিক সমাজ দেবে তার সততার প্রমাণ। কুৎসিত জগৎ সংসারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আমায় বলতেই হবে, এ জীবন আমার তাই এর নির্মাতাও আমি। আমার সন্তান শুধুই আমার, তার অস্তিত্বও আমি।নীরা জীবন সংগ্রামের এক অদম্য সৈনিক সন্দেহ নেই। জয়কে ছিনিয়ে আনতে পারবে কিনা জানি না কিন্তু কখনোই আর পরাজয় মেনে নিবে না। কিন্তু সবাইতো নীরা নয়। তাইতো একের পর এক হত্যা আত্মহত্যার ঘটনায় আন্দোলিত হই আমরা। ঘটনা-১  ৩০ আগস্ট ২০১৫: পীরগঞ্জে পিতা আবেদন আলি দুই শিশু সন্তানকে মেয়ে অনা (৬) ছেলে আপন (২) বিষ খাইয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে নিজে গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যা করেন। কারণ: স্ত্রী সংসার করতে অপারগতা প্রকাশ করে এবং বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। ঘটনা-২৯ নভেম্বর ২০১৫: পাবনায় এক শিশু জোবায়েরকে (১০মাস) গলা টিপে হত্যার পর মা পলি খাতুনের গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা। হত্যা ও আত্মহত্যার কারণ অপ্রাশিত। ঘটনা-৩৬ ডিসেম্বর ২০১৫: নীলফামারীতে ৮ ও ৪ বছরের ২ মেয়েকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর মা ফেন্সির (৩০) আত্মহত্যা। কারণ: দাম্পত্য কলহের জের। ঘটনা-৪১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬: ভালুকায় ১৫ মাস বয়সী কন্যাশিশু রাবেয়া আক্তারকে ছুরি দিয়ে গলা কেটে হত্যা। পরে নিজ বুকে ছুরিকাঘাত ও বিষপানে পিতা জামিল হোসেনের (৪০) আত্মহত্যা। কারণ: হতাশা, ঋণগ্রস্ততা ও চরম দরিদ্রতা।কীভাবে বাবা বা মা তার নিজের সন্তানকে হত্যা করতে পারে? প্রশ্নটি করা যত কঠিন তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন প্রশ্নের প্রশ্ন খোঁজা। একজন পিতা বা মা জীবনের কোন পর্যায়ে দাঁড়িয়ে সন্তানকে হত্যা করে বেছে নেয় আত্মহননের পথ? প্রায় প্রতিটি ঘটনারই একটি মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তাহলো পারিবারিক কলহ, সম্পর্কে দূরত্ব সৃষ্টি, দারিদ্র অথবা প্রিয়জনের দূরে সরে যাওয়া। নিষ্ঠুর জীবনের বাস্তবতায় যারা এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হন, তারা নিঃসন্দেহে জীবনের কাছে নিজেকে পরাজিত বলে ভাবেন। অথচ একটিবারও কি ভেবে দেখেছেন আপনাকে হারিয়ে দেয়ার অধিকার বা ক্ষমতা আদৌ কারো আছে কিনা?জীবনের এমন সংকটপূর্ণ অধ্যায়ে কেবল তারাই হার মানে যারা নিজেকে ভালোবাসতে শিখেনি। আর যে ব্যক্তি নিজেকে ভালোবাসতে পারে না তার কাছে অন্যের জন্য ভালোবাসা আশা করাই বৃথা। তাই যতোই খারাপ সময় আসুক না কেন ব্যক্তিকে অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে জীবন একটাই আর এ জীবনের মালিক নিজেই। একে পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ অথবা প্রভাবিত করার অধিকার কাউকে দেয়া যাবে না।ব্যক্তিত্বের মাঝে এমন উপদানকে জাগিয়ে তুলতে হবে যা ব্যক্তির জীবনের সকল হতাশা, অভাব অভিযোগ, অপ্রাপ্তি, অপূর্ণতার সামনে ঢাল হিসেবে দাঁড়াতে পারে। নিজের ভালোলাগার একটি মনোজগৎ হতে পারে এর রক্ষাকবচ। জরাজীর্ণ জীবন থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে আপন ভুবনে ডুব দেয়ার মতো। কেউ কেউ একে বাস্তবতা থেকে পালানোর ছুঁতো বললেও এই মনের ঘরই পারে আপনার জীবনী শক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করতে। কখনোই নিজের চেয়ে কাউকে বেশি মূল্য দিবেন না। তবে সন্তানের ক্ষেত্রে বিষয়টি একেবারেই খাটবে না। এটি সহজাত। আর তা্ই সন্তানের অমঙ্গল বা ক্ষতি আপনার চিন্তায় কোনোভাবেই ঠাঁই দিবেন না। সন্তানের সৃষ্টির দায় আপনার, কিন্তু বিনাশের নয়। নিজ ব্যক্তিত্বের মাঝে সাহসকে জাগিয়ে তুলুন। প্রতিদিন বারবার করে নিজেকে বলুন আপনি পারেন না বা পারবেন না এমন কিছু নেই। পাশাপাশি সন্তানটিকেও বৈরি পরিবেশ মোকাবেলার শিক্ষা দিন, জীবনের মূল্য বোঝান। সর্বোপরি যখন নিজে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছেন না ক্রমশই ভেঙ্গে পড়ছেন তখন অবশ্যই একজন আস্থাভাজন পরামর্শকের সাহায্য নিন। যদি তিনি সাহায্য করতে নাও পারেন তবু বিষয়টি শেয়ার করার কারণে আপনি হাল্কাবোধ করবেন। এবং ইতিবাচক সান্ত্বনাও হয়তো আপনার শক্তি যোগাবে। আর যা না বললেই নয়, আলোচিত কেস স্টাডির ঘটনাগুলোকে অত্যন্ত দুঃখজনক দুর্ঘটনা ভাবার পাশাপাশি নিজেকে সচেতন করে তুলুন। মুক্তির পথ মৃত্যুতে নয়, মুক্তির স্বাদ জীবনে। লেখক : শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়এইচআর/এমএস

Advertisement