বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি (সারদা) থেকে এক বছর মেয়াদী মৌলিক প্রশিক্ষণ শেষে ২০২০ সালে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স ঢাকায় যোগদান করেন মোহাম্মদ আলী। তার শৈশব ও বেড়ে ওঠা মানিকগঞ্জের মেঠোপথের এক কৃষক পরিবারে। তার বাবা মো. ছবেদ আলী ও মা আছমা আক্তার। তিনি ২০১১ সালে সিংজুরী ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পাস করেন। ঘিওর সরকারি কলেজ থেকে ২০১৩ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পান। এরপর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
Advertisement
সম্প্রতি তার পুলিশের এসআই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও সফলতার গল্প শুনিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. ইসরাফিল হোসাইন—
জাগো নিউজ: আপনার শৈশব ও পড়াশোনা সম্পর্কে জানতে চাই—মোহাম্মদ আলী: মানিকগঞ্জের মেঠোপথের ছোট এক কুটিরের কৃষক পরিবারে আমার বেড়ে ওঠা। আমার শিক্ষাজীবন শুরু হয় প্রশিকা স্কুলের মাধ্যমে। সেখানে আমি তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করি। এরপর বাংলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হই। পঞ্চম শ্রেণিতে আমি প্রথম স্থান অধিকার করি। প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় আমি আমার থানায় ট্যালেন্টপুলে নবম স্থান অধিকার করি। এরপর আমি সিংজুরী ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই। অষ্টম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষায় অষ্টম স্থান অধিকার করি। ২০১১ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে আমি এসএসসি পাস করি। উচ্চ মাধ্যমিকে ঘিওর সরকারি কলেজে ভর্তি হই। ২০১৩ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ ও ঢাকা বোর্ডে বৃত্তি পাই। ২০১৩-২০১৪ সেশনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগে ভর্তির সুযোগ পাই। ২০১৭ সালে অনার্স ও ২০১৮ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন করি। অনার্স ও মাস্টার্সে যথাক্রমে পঞ্চম ও তৃতীয় স্থান অর্জন করি।
জাগো নিউজ: পুলিশ সদস্য হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?মোহাম্মদ আলী: বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই আমি বিসিএস পুলিশ হওয়ার স্বপ্ন দেখি। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে অনার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার পর পরই ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুলিশের এসআই পদের সার্কুলার পাই। মাস্টার্স চলমান অবস্থায় ২০১৮ সালে আমি ওই পদে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হই।
Advertisement
জাগো নিউজ: এসআই হিসেবে যাত্রার গল্প শুনতে চাই, প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছেন?মোহাম্মদ আলী: অনার্স শেষ হওয়ার পর পরই ২০১৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শারীরিক মাপ ও শারীরিক পরীক্ষায় টিকে যাই। সার্কুলারটি মাস্টার্স চলমান অবস্থায় হওয়ায় একাডেমিক ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে বা শেষে সেমিনার ও লাইব্রেরিতে টপিক ধরে ধরে পড়াশোনা করতাম। এরপর টিউশন শেষে বাসায় এসেও পড়াশোনার জন্য টেবিলে বসে পড়তাম। এভাবেই আমি প্রথমে লিখিত ও পরে মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যাই। স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পুলিশ ভেরিফিকেশনের পর ২০১৯ সালে বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি (সারদা) রাজশাহী থেকে এক বছর মেয়াদী মৌলিক প্রশিক্ষণ শেষ করি। এরপর ২০২০ সালে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স ঢাকায় যোগদান করি।
জাগো নিউজ: আড়াল থেকে কেউ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন?মোহাম্মদ আলী: আমার সফলতার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান মা-বাবা ও ছোট চাচার। তারা সব সময়ই আমাকে একজন সফল মানুষ হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। সেজন্য কখনোই বাড়ি থেকে চাকরি বা কোনো কাজের জন্য আমাকে চাপ দেওয়া হতো না। এ ছাড়াও শিক্ষক, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজন নানাভাবে অনুপ্রেরণা ও সাহস দিয়েছেন।
জাগো নিউজ: এসআই হতে চাইলে কীভাবে প্রস্তুতি নিতে হয়?মোহাম্মদ আলী: এসআইয়ের জন্য শারীরিক মাপ ও শারীরিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর লিখিত ২২৫ মার্কসের জন্য যে কোনো সিরিজের একটি গাইড বই কিনে নিতে পারেন। এরপর দেখতে হবে, বিগত সালের পরীক্ষাগুলোয় কোন টপিকস থেকে প্রশ্ন বেশি আসে। যে টপিকসগুলো থেকে প্রশ্ন বেশি আসে; সে বিষয়গুলো ভালোভাবে আয়ত্ত করতে হবে।লিখিত পরীক্ষা হবে তিনটি ধাপে। প্রথম ধাপে ১০০ নম্বরের ইংরেজি, বাংলা রচনা ও কম্পোজিশন, দ্বিতীয় ধাপে ১০০ নম্বরের সাধারণ জ্ঞান ও পাটিগণিত, তৃতীয় ধাপে ২৫ নম্বরের মনোস্তত্ত্ব পরীক্ষা নেওয়া হবে।
লিখিত পরীক্ষার ইংরেজি, বাংলা রচনা ও কম্পোজিশন বিষয়ে সাধারণত ইংরেজিতে ৫০ ও বাংলায় ৫০ মোট ১০০ নম্বরের প্রশ্ন থাকে। ইংরেজিতে সমসাময়িক বিষয়ের ওপর একটি রচনা, লেটার বা আবেদনপত্র, অনুবাদ, ফিল ইন দ্য ব্ল্যাংকস (প্রিপজিশন, ইডিয়ম অ্যান্ড ফ্রেজ) থাকতে পারে। বাংলা রচনা ও কম্পোজিশন বিষয়ে সমসাময়িক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক একটি রচনা, একটি ভাবসম্প্রসারণ, পত্র লিখন, অনুবাদ, বাগধারা, বাক্য সংকোচনও থাকতে পারে।
Advertisement
সাধারণ জ্ঞানে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের ওপর ৫০ নম্বরের প্রশ্ন থাকে। এ বিষয়ে ভালো করতে হলে নিয়মিত পত্রিকা ও কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স পড়তে পারেন। বাংলাদেশ অংশে বাংলাদেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, আয়তন, জলবায়ু, খেলাধুলা, অর্থনীতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখতে হবে। এ ছাড়া বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি ও পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা রাখতে পারেন। আন্তর্জাতিক অংশের জন্য রাজধানী, মুদ্রা, দিবস, পুরস্কার ও সম্মাননা, বিভিন্ন সংস্থার পূর্ণরূপ, সাম্প্রতিক বিষয় সম্পর্কে জানা জরুরি।
গণিতে ৫০ নম্বরের জন্য ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির গণিত বইগুলো চর্চা করতে পারেন। এ ছাড়া পাটিগণিত; বিশেষ করে ল.সা.গু, গ.সা.গু, ঐকিক নিয়ম, শতকরা, সুদ, লাভ-ক্ষতি, অনুপাত-সমানুপাত এসব অধ্যায় ভালোভাবে চর্চা করতে পারেন। মনোস্তত্ত্ব বিষয়ে ২৫ নম্বরের জন্য সংখ্যা চিহ্নিতকরণ, ধারা সমস্যার সমাধান, পূর্ণরূপ, বানান শুদ্ধিকরণ, সংক্ষিপ্ত টিকা, দিক ও দূরত্ব বিষয়ে দেখতে পারেন। ৩৯তম এসআই পদে লিখিত অংশের সিলেবাস ও পূর্ণমানে কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছে।
লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর মৌখিক পরীক্ষার জন্য স্নাতক পর্যায়ে যে বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন; ওই বিষয়গুলো থেকে প্রশ্ন হতে পারে। এ ছাড়া নিজ জেলা, উপজেলা, এলাকার বিখ্যাত ব্যক্তির নাম, জেলা কেন বিখ্যাত, আয়তন, জনসংখ্যা, ইতিহাস, ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা, মুক্তিযুদ্ধ, সাম্প্রতিক ঘটনা ইত্যাদি ভালো করে জেনে নিতে পারেন। এ ছাড়াও মার্জিত পোশাক, সুন্দর বাচনভঙ্গির দিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।
জাগো নিউজ: পেশা হিসেবে সুযোগ-সুবিধা কেমন?মোহাম্মদ আলী: ১০ম গ্রেডের অন্যান্য চাকরির চেয়ে এ চাকরির সুযোগ-সুবিধা কোনো অংশে কম নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে বেশি। এখানে আছে রেশন ও চিকিৎসা সুবিধা। আছে পুলিশ সদস্যদের জন্য মিশনে যাওয়ার সুযোগ। পোস্টিং অনুযায়ী বিভিন্ন ভাতা ও তদন্ত বিল পাওয়ার সুযোগও আছে।
জাগো নিউজ: পুলিশ হিসেবে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?মোহাম্মদ আলী: সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালনের মাধ্যমে দেশ ও জনগণের সেবা করতে চাই।
এমআইএইচ/এসইউ/জেআইএম