ধর্ম

জুমার প্রথম খুতবা : জুমার দিন দোয়া কবুলের সময়

আজ শুক্রবার। জুমার দিন। ১৮ নভেম্বর ২০২২ ইংরেজি, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪২৯ বাংলা, ২৩ রবিউস সানি ১৪৪৪ হিজরি। আজ রবিউস সানি মাসের চতুর্থ ও  শেষ জুমা। আজকের জুমার আলোচ্য বিষয়- জুমার দিন দোয়া কবুলের সময়। এ বিষয়টি কোরআন সুন্নাহর বর্ণনায় বিশেষ স্থান দখল করে আছে।

Advertisement

আলহামদুলিল্লাহ! সব প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি একক, তার কোনো অংশীদার নেই। যিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক। যার পরে আর কোনো নবি নেই। এরপর আল্লাহ তাআলা মানুষের উদ্দেশ্য করে কত চমৎকার ঘোষণাই না দিলেন-

وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُوْنِیْۤ اَسْتَجِبْ لَكُمْ اِنَّ الَّذِیْنَ یَسْتَكْبِرُوْنَ عَنْ عِبَادَتِیْ سَیَدْخُلُوْنَ جَهَنَّمَ دٰخِرِیْنَ.

তোমাদের প্রতিপালক বলেছেন, আমাকে ডাক। আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। নিশ্চয়ই অহংকারবশে যারা আমার ইবাদত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তারা লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। (সুরা মুমিন : আয়াত ৬০)

Advertisement

দোয়ার মাধ্যমে বান্দার ইবাদতের গুণের প্রকাশ ঘটে। আল্লাহর সামনে বান্দার সমর্পণ হলো দোয়া। বান্দার হীনতা ও দীনতার প্রকাশ, আল্লাহমুখিতা এবং আল্লাহ ও বান্দার মাঝে বিশেষ সম্পর্কের উত্তম বহিঃপ্রকাশ। দোয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। হাদিসে পাকে এসেছে-

الدُّعَاءُ هُوَ الْعِبَادَةُ

দোয়াই ইবাদত।

এ হাদিসের সমর্থনে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোরআনুল কারিমের সুরা মুমিনের ৬০ নম্বর আয়াত তেলাওয়াক করেন-

Advertisement

وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُوْنِیْۤ اَسْتَجِبْ لَكُمْ اِنَّ الَّذِیْنَ یَسْتَكْبِرُوْنَ عَنْ عِبَادَتِیْ سَیَدْخُلُوْنَ جَهَنَّمَ دٰخِرِیْنَ.

‘তোমাদের প্রতিপালক বলেছেন, আমাকে ডাক। আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। নিশ্চয়ই অহংকারবশে যারা আমার ইবাদত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তারা লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ (তিরমিজি ২৯৬৯; আবু দাউদ ১৪৭৯; ইবনে মাজাহ ৩৮২৮)

যে দোয়া করে আল্লাহ তার প্রতি খুশি হন, আর যে দোয়া করে না আল্লাহ তার প্রতি নারাজ হন। হাদিসে পাকে এসেছে-

مَنْ لَمْ يَسْأَلِ اللهَ يَغْضَبْ عَلَيْهِ

যে আল্লাহর কাছে চায় না, আল্লাহ তাআলা তার প্রতি অসন্তুষ্ট হন। (তিরমিজি ৩৩৭৩)

তাইতো হজরত ইবনে আবদুল বার রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন-

وَالدّعَاءُ رَأْسُ الْعِبَادَةِ وَاللهُ يُحِبُّ أَنْ يُسْأَلَ،وَقَدْ أَمَرَ أَنْ يُسْأَلَ مِنْ فَضْلِهِ لِقَوْلِهِ عَزّ وَجَلّ وَسْـَٔلُوا اللهَ مِنْ فَضْلِهٖ.

‘দোয়া ইবাদতের মূল। আল্লাহ তাআলা তাঁর কাছে প্রার্থনা করা পছন্দ করেন। তাই তিনি (আল্লাহ) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর কাছে তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা করো (সুরা নিসা : আয়াত ৩২)।’ (আলইসতিযকার ৮/১৪৪)

যদি বান্দার রিজিক হালাল হয় এবং গুনাহ বা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার দোয়া না করা হয়, তাহলে সে দোয়া অবশ্যই কবুল হয়। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা এভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন-

وَاِذَا سَاَلَكَ عِبَادِیْ عَنِّیْ فَاِنِّیْ قَرِیْبٌ اُجِیْبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ اِذَا دَعَانِ فَلْیَسْتَجِیْبُوْا لِیْ وَ لْیُؤْمِنُوْا بِیْ لَعَلَّهُمْ یَرْشُدُوْنَ.

‘(হে নবী!) আমার বান্দাগণ যখন আপনার কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে তখন (আপনি তাদেরকে বলুন,) আমি এত কাছাকাছি যে, কেউ  যখন  আমাকে  ডাকে  আমি  তার  ডাক শুনি। সুতরাং তারাও আমার কথা অন্তর দিয়ে গ্রহণ করুক এবং আমার প্রতি ঈমান আনুক, যাতে তারা সঠিক পথে এসে যায়।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৬)

দোয়া কবুলের ওয়াদা ও সময়

আল্লাহ তাআলা বান্দার দোয়া কবুল করার ওয়াদা করেছেন। সব সময় সব হালতেই তিনি দোয়া কবুল করেন। তবে হাদিসে পাকে বিশেষভাবে জুমার দিনের একটি সময়ের কথা বলা হয়েছে, বান্দা তখন আল্লাহর কাছে যা চাইবে আল্লাহ তাআলা অবশ্যই তা দান করবেন। হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন-

أَنّ رَسُولَ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ ذَكَرَ يَوْمَ الجُمُعَةِ، فَقَالَ: >فِيهِ سَاعَةٌ، لاَ يُوَافِقُهَا عَبْدٌ مُسْلِمٌ، وَهُوَ قَائِمٌ يُصَلِّي، يَسْأَلُ اللهَ تَعَالَى شَيْئًا، إِلّا أَعْطَاهُ إِيّاهُ وَأَشَارَ بِيَدِهِ يُقَلِّلُهَا.

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন জুমার দিনের আলোচনা করলেন। তিনি বললেন, এইদিন একটা সময় আছে তখন কোনো মুসলিম নামাজরত অবস্থায় আল্লাহর কাছে যা চাইবে আল্লাহ তাকে অবশ্যই তা দেবেন।

(হজরত আবু হুরায়রা বলেন) এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাত দিয়ে ইশারা করেছেন, ঐ মুহূর্তটা অতি অল্প সময়।’ (বুখারি ৯৩৫; মুসলিম ৮৫২)

এ সময় সম্পর্কে হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থ সহিহ মুসলিমের এক বর্ণনায় সুস্পষ্টভাবে এসেছে-

وَهِيَ سَاعَةٌ خَفِيفَةٌ.

সে মুহূর্তটি খুব সামান্য সময়। (মুসলিম ৮৫২)

হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

يَوْمُ الْجُمُعَةِ اثْنَتَا عَشْرَةَ سَاعَةً، وَلَا يُوجَدُ عَبْدٌ مُسْلِمٌ يَسْأَلُ اللهَ شَيْئًا إِلّا آتَاهُ اللهُ، فَالْتَمِسُوهَا آخِرَ السّاعَةِ بَعْدَ الْعَصْرِ.

জুমার দিন বারো ভাগ। (এর মধ্যে একটি সময় আছে, যাতে) কোনো মুসলিম বান্দা আল্লাহ তাআলার কাছে যা প্রার্থনা করবে আল্লাহ তাআলা নিশ্চয়ই তা দান করবেন। সে সময়টি তোমরা অনুসন্ধান কর আসরের পর দিনের শেষ অংশটিতে।’ (মুস্তাদরাকে হাকেম ১০৩২; আবু দাউদ ১০৪৮; নাসাঈ ১৩৮৯১)

সেই মুহূর্ত কোনটি?

হাদিসের আলোকে জানা গেল- জুমার দিন একটি সময় বান্দার দোয়া অবশ্যই কবুল হয়। সেই ফজিলতপূর্ণ সময়টা কখন? জুমার দিনের যে সময়টিতে দোয়া কবুলের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে সেটা কোন্ সময়? এ সম্পর্কে সাহাবা, তাবেঈন ও পরবর্তী উলামায়ে কেরামের একাধিক বক্তব্য পাওয়া যায়। তাহলো-

হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি লেখেন-

وَلَا شَكّ أَنّ أَرْجَحَ الْأَقْوَالِ الْمَذْكُورَةِ حَدِيثُ أَبِي مُوسَى وَحَدِيثُ عَبْدِ اللهِ بْنِ سَلَامٍ.

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এসব মতের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগণ্য মত হল- আবু মুসা আশআরি ও আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমার হাদিসে উল্লেখিত দুটি মত। (ফাতহুল বারী ২/৪৮৮)

১. জুমার দিনের দোয়া কবুলের সময় হলো- খতিব (খুতবার জন্য) মিম্বরে বসার পর থেকে নামাজ শেষ করা পর্যন্ত।

২. দোয়া কবুলের বিশেষ সময়টি হলো- আসরের পর সূর্য অস্তমিত হওয়া পর্যন্ত।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন-

وَفِيهِ سَاعَةٌ لاَ يُصَادِفُهَا عَبْدٌ مُسْلِمٌ وَهُوَ يُصَلِّي، يَسْأَلُ اللهَ شَيْئًا، إِلاّ أَعْطَاهُ إِيّاهُ.

জুমার দিন একটি সময় আছে, কোনো মুসলিম নামাজরত অবস্থায় তখন আল্লাহর নিকট যা চাইবে আল্লাহ অবশ্যই তা দান করবেন।

হজরত কাব আহবার রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বললেন-

ذَلِكَ فِي كُلِّ سَنَةٍ يَوْمٌ

এই দিনটি প্রতি বছর এক দিন।

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি বললাম-

بَلْ فِي كُلِّ جُمُعَةٍ

না, বরং প্রত্যেক জুমার দিন।

তখন তিনি তাওরাত খুলেছেন এবং তা দেখার পর বলেছেন-

صَدَقَ رَسُولُ اللهِ صَلى الله عَلَيهِ وَسَلمَ.

হ্যাঁ, আল্লাহর রাসুল সত্য বলেছেন।

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এরপর একদিন আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রাদিয়াল্লাহু আনহুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তাকে কাব আহবারের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয় এবং তাকে যে হাদিস শুনিয়েছি এর বিবরণ দিই। তখন আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন-

قَدْ عَلِمْتُ أَيّةَ سَاعَةٍ هِيَ.

সে সময়টা কখন, তা আমি জানি।

আবু হুরায়রা বলেন, আমি বললাম, আমাকে বলুন, আমার সাথে কৃপণতা করবেন না।

আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন-

هِيَ آخِرُ سَاعَةٍ فِي يَوْمِ الْجُمُعَةِ.

সময়টি হল, জুমার দিনের শেষ সময়।

আবু হুরায়রা রা বলেন, আমি বললাম, ঐ সময় কীভাবে হবে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মুসলিম বান্দা ঐ সময় নামাজরত থাকবে! আর আছরের পর তো নামাজ পড়া যায় না?

আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রাদিয়াল্লাহু আনহু উত্তর দিয়েছেন-

أَلَمْ يَقُلْ رَسُولُ اللهِ صَلى الله عَلَيهِ وَسَلمَ: مَنْ جَلَسَ مَجْلِسًا يَنْتَظِرُ الصّلاَةَ فَهُوَ فِي صَلاَةٍ حَتّى يُصَلِّيَ؟

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি বলেননি, কোনো ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত নামাজের অপেক্ষায় বসে থাকবে, ততক্ষণ  সে নামাযে আছে?

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি বললাম, হাঁ।

আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন-

فَهُوَ ذَلِكَ.

হাদিসে (নামাযরত বলার দ্বারা) এটাই উদ্দেশ্য। (মুয়াত্তা মালেক ২৯১; মুসনাদে আহমাদ ২৩৭৮৫; আবু দাউদ ১০৪৬; তিরমিজি ৪৯১)

অর্থাৎ দোয়া কবুলের হাদিসটিতে যে বলা হয়েছে, নামাজরত অবস্থায় দোয়া করবে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, দিনের শেষ সময়ে বসে মাগরিবের নামাজের অপেক্ষায় থাকবে এবং দোয়া করতে থাকবে। আর যে ব্যক্তি নামাজের অপেক্ষায় থাকে সে নামাজেই থাকে।

যাই হোক আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, হাদিসটিতে জুমার দিনের যে সময় দোয়া কবুলের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে সে সময়টি হল, দিনটির শেষ অংশ।

সুতরাং আমরা জুমার দিন এই দুই সময় দোয়ার সন্ধান করবো। তাহলে ইনশাআল্লাহ আমাদের ঐ বিশেষ সময়ের ফযীলত লাভ হবে এবং আমাদের দোয়া আল্লাহ কবুল করবেন। এ কারণেই ইমাম আবু উমর ইবনে আবদুল বার রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন-

والذي ينبغي لكل مسلم الاجتهادُ في الدعاء للدين والدنيا في الوقتين المذكورين رجاءَ الإجابة، فإنه لا يخيب إن شاء الله.

প্রত্যেক মুসলিমের উচিত, কবুলের আশা নিয়ে তার দ্বীন-দুনিয়ার যাবতীয় বিষয়ের জন্য এই দুই সময়ে গুরুত্বের সাথে দোয়া করা। তাহলে ইনশাআল্লাহ, তার দোয়া বৃথা যাবে না। (আত-তামহীদ ১৯/২৪)

এমএমএস/জেআইএম