লবণ বেগমের অস্থিরতা আমাদের স্পর্শ করছে না। আমরা বাপ-ছেলে কাঁথায় মুখ ঢেকে খলসে মাছের মতো কুটকুট করে হাসছি। বোতল থেকে তেল গড়িয়ে পড়ার মতো 'খলসে-হাসি' কাঁথার ফাঁক গলে বাইরে যেতেই লবণ বেগমের পায়চারি থেমে গেল। জলদ-গম্ভীর স্বরে সে বলল-
Advertisement
: এর মানে কী?শীত-শীত ভোরে শাফিন ভালুকছানার মতো আমার গলা পেঁচিয়ে ধরে শুয়ে আছে। কাঁথার ভেতরে আবছা সবুজ অন্ধকার। অন্ধকার সরিয়ে শাফিনের দু’চোখের পাতায় আঙুলের পরশ বুলিয়ে বললাম-
: আব্বু। চলো, উইঠা পড়ি। শাফিন আরও শক্ত করে আমার গলা পেঁচিয়ে ধরল। ওর চুলে বিলি কেটে জিজ্ঞেস করলাম-: আইজ কী পরীক্ষা?: অংক। : অংকে কত পাবা?: জানি না। : এইটা কী রকম কথা হইল? একটা ধারণা নাই?: আছে। : সেইটাই তো জানতে চাইতেছি। ৯০-এর ওপরে পাবা না?: হুঁ। : হুঁ কী? নিশ্চিত কইরা বলো। নিশ্চয়তা প্রদানের পিঁড়িতে পা না রেখে শাফিন আমার ব্যাপারে কৌতুহলী হয়ে উঠল। জিজ্ঞেস করলো-
: তুমি অংকে কত নম্বর পাইছিলা?পঞ্চম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় অংকে কত নম্বর পেয়েছিলাম, মনে করার চেষ্টা করলাম। আমাদের অংক ক্লাস নিতেন রাজ্জাক স্যার। রাজ্জাক স্যারের কাঁচা-পাকা চুল-দাঁড়ি, পাজামা-পাঞ্জাবি পরা পরিপাটি চেহারা ঘুরেফিরে চোখের সামনে ভাসছে; কিন্তু তিনি আমাকে কত নম্বর দিয়েছিলেন, মনে পড়ছে না। মনে পড়ার কোনো কারণও নেই।
Advertisement
প্রচলিত অর্থে আমি ছিলাম গাধা টাইপের ছাত্র। পরীক্ষার নম্বরের ব্যাপারে গাধা টাইপের ছাত্রদের খুব একটা আগ্রহ থাকে না। আমারও ছিল না। পরীক্ষার পর শরীরে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি-একদিন শুনলাম, অমুক তারিখে রেজাল্ট দেওয়া হবে। নাক মুছতে মুছতে স্কুলের মাঠে হাজির হলাম। হেডস্যার মুখে মুখে রেজাল্ট জানিয়ে দিলেন। আমি প্রাইমারি স্কুলের বারান্দা ছেড়ে পাশের হাইস্কুলের বারান্দায় হাঁটাহাঁটি শুরু করে দিলাম।
আজকাল ব্যাপারটা এত সহজে মিটে না। এখন প্রাথমিক শিক্ষার শেষ ধাপের পরীক্ষায়ও বাবা-মা'রা অস্থির থাকেন গোল্ডেন জিপিএ প্রাপ্ত ছাত্রের গর্বিত অভিভাবক হওয়ার জন্য। এ লক্ষ্যে বছরের শুরুতেই লবণ বেগমের মধ্যে গোল্ডেন জিপিএ-র জন্য অস্থিরতা প্রকাশ পেয়েছিল এবং একদিন খাওয়ার টেবিলে সে বলল-
: আগামীকাল সকালে এক জায়গায় যাবো। তুমি আমার সঙ্গে যাবা। মাসের মাঝামাঝি সময়ে আর্থিক লেনদেনসংশ্লিষ্ট কোনো জায়গায় যাওয়ার ব্যাপার হলে বিপদ। নাভির মাঝখান থেকে প্রবল বেগে ধেয়ে আসা হেঁচকির আত্মপ্রকাশ গলায় পানি ঢেলে রোধ করার পর ভয়ে ভয়ে বললাম-: কোথায়?: গেলেই জানতে পারবা।পরদিন লবণ বেগম আমাকে সঙ্গে নিয়ে একটা কোচিং সেন্টারে হাজির হলো। প্রতিষ্ঠানটির সামনে বিশাল একটা সাইনবোর্ড ঝুলছে। সেখানে লেখা-পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষার্থীদের জন্য শরফুল-হামিদুল-আরিফুল স্যারের ম্যানিব্যাক গ্যারান্টি অফার। ভেতরে ঢোকার পর 'ত্রিরত্নের' একজন আরিফুল স্যারের সঙ্গে পরিচয় হলো। আলাপের শুরুতেই তার কাছে জানতে চাইলাম-
: স্যার, মানিব্যাক গ্যারান্টির অফারটা কী রকম?শব্দহীন হাসি উপহার দিয়ে আরিকুল স্যার বললেন-: স্টুডেন্ট গরু হোক, গাধা হোক, কোনো সমস্যা নাই। আমরা জিপিএ-৫ পাওয়ার ১০০ ভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে তাকে আমাদের কোচিং হোমে ভর্তি করি। পরীক্ষার পরে যদি দেখা যায়, কোনো স্টুডেন্ট জিপিএ-৫ পায় নাই, তাহলে সম্পূর্ণ টাকা ফেরত। এইটাই মানিব্যাক গ্যারান্টি অফার।
Advertisement
ব্যবস্থা দেখে লবণ বেগম অভিভূত হয়ে গেল। পাশের কক্ষে একজন অফিস সহকারী বসেছিলেন। আরিফুল স্যারের সঙ্গে কথা শেষ করে তার সামনে দাঁড়াতেই মিষ্টি হাসিমিশ্রিত সালাম পেলাম। তিনি জানতে চাইলেন-: আজকেই ভর্তি করাবেন?লবণ বেগমের মুখ থেকে হ্যাঁ-সূচক ধ্বনি নির্গত হওয়ার আগেই বলে উঠলাম-: আপনাদের কাগজপত্র কী-কী আছে দেন, দেখি। দেখার পর একটু চিন্তা-ভাবনা করি। তারপর আসব।
কপালে ভাঁজ ফেলে লবণ বেগম আমার দিকে তাকাল। হাতের ইশারায় তাকে ধৈর্য ধারণ করতে বললাম। অফিস সহকারী লবণ বেগমের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল-: কোন স্কুলের স্টুডেন্ট?লবণ বেগম ছেলের স্কুলের নাম বলল। পরামর্শ দেওয়ার ভঙ্গিতে ফিসফিস করে লবণ বেগমের উদ্দেশে অফিস সহকারী বলল-
: সামনের রাস্তা দিয়া কিছুদূর গেলেই হাতের ডানপাশে দেখবেন ইসমাইল স্যারের কোচিং সেন্টার। রাইফেলের গুলি মিস হওয়ার রেকর্ড আছে; কিন্তু এখন পর্যন্ত ইসমাইল স্যারের টার্গেট মিস হওয়ার কোনো রেকর্ড নাই। আপনারা একবার ইসমাইল স্যারের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারেন।
আরে! এতো দেখছি ঘরের শত্রু বিভীষণ! শরফুল স্যার গং কি দুধ-কলা দিয়ে সাপ পুষছেন? রোগীকে নির্ধারিত ক্লিনিকে পাঠানোর জন্য কিংবা কোনো শহরে নতুন আসা লোকজনকে আবাসিক হোটলে তোলার জন্য দালাল পোষা হয়। তেমনি ইসমাইল স্যারও কি একে পুষছেন? আমাদের একজন লেবু দা আছেন। তিনি থাকেন এক দেশে, গুণগান করে বেড়ান অন্য দেশের। এই লোকও দেখছি লেবু দা’র মতো নেমকহারাম। খাচ্ছেন এক জায়গায়, নাম জপছেন অন্য জায়গার! লবণ বেগমকে এখান থেকে ফস্কানোর অস্ত্র খুঁজছিলাম। অফিস সহকারীর বিশ্বাসঘাতকতার অস্ত্র কাজে লাগল। লবণ বেগমকে বললাম-
: চলো, ইসমাইল স্যারের ওখানে যাই। দেখি, উনি কী সিস্টেম চালু করছেন!দেখলাম, ইসমাইল স্যারও বিফলে মূল্য ফেরত সিস্টেম চালু করেছেন। ইসমাইল স্যার তখন কোচিং সেন্টারে ছিলেন না। তার সহকর্মী জানাল, তিনি স্কুলে ক্লাস নিচ্ছেন, দুপুরের পর আসবেন। কথা বলার এক পর্যায়ে সহকর্মীকে বললাম-: বিফলে মূল্য ফেরত সংক্রান্ত কথাবার্তা মঘা-ছগা জাতীয় দাওয়াখানার ওষুধ বিতরণের সময় বলা হয়। আপনারা জ্ঞান বিতরণের মতো মহৎ একটা কাজকে মঘা-ছগার পর্যায়ভুক্ত কইরা ফেলছেন!
ভদ্রলোক আমার সঙ্গে সহমত পোষণ করে বললেন-: কী করব বলুন! অনেক টাকা-পয়সার ব্যাপার তো! অভিভাবকরা রেজাল্টের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চায়। তাছাড়া...: তাছাড়া কী?: চারপাশে তুমুল প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতার মধ্যে টিকতে হলে সবকিছু কমার্শিয়াল ফরমেটে সাজাইতে হয়।
শিক্ষাগুরু সক্রেটিস থেকে শুরু করে নিকট-অতীতের টোলপণ্ডিতরা জ্ঞান বিতরণের কাজকে ঐশ্বরিক দায়িত্ব মনে করতেন। যুগ পরিবর্তনের হাওয়ায় জ্ঞান বিতরণের কাজটি যে এখন বাণিজ্যের প্রধান উপকরণে পরিণত হয়েছে, ইসমাইল কোচিং সেন্টারের এই ভদ্রলোক আরও একবার আমাকে বুঝিয়ে দিলেন। তাকে বললাম-
: এখানে ভর্তির নিয়ম-কানুন কী?ভদ্রলোক নিয়ম-কানুন বিষয়ক ছাপানো কাগজপত্র আমার হাতে দিলেন। আমরা দুই-একদিন পরে আসব বলে তার কাছ থেকে বিদায় নিলাম।
ইসমাইল স্যারের কোচিং সেন্টারের বিপরীত দিকে আরও একটি কোচিং সেন্টারের সাইনবোর্ড নজরে এলো। শহরে হোটেল-শপিং সেন্টারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কোচিং সেন্টার গড়ে উঠছে। এর মানে কী? স্কুলে শিক্ষকরা তাহলে কী পড়ান, মাথায় ঢুকছে না। সামনের কোচিং সেন্টারে পণ্ডিতের সংখ্যা দু’জন। আবজল স্যার ও মাবজল স্যার। তারা পরীক্ষার্থীদের গোল্ডেন জিপিএ লাভের ম্যাজিক পদ্ধতির উদ্ভাবক। লবণ বেগমকে বললাম-
: চলো, ম্যাজিসিয়ান স্যারদের ওখানেও একটা চক্কর দিয়া যাই।ধৈর্যের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে লবণ বেগম গজরাতে গজরাতে বলল-: শুধু শুধু চক্কর মাইরা তো লাভ নাই। আগে ঠিক করতে হবে, তুমি তোমার ছেলের পিছনে টাকা খরচ করতে রাজি আছ কিনা?
: ছেলেমেয়ের জন্য কোন বাবা-মা টাকা খরচ করতে রাজি থাকে না, কও আমারে? কিন্তু এইসব আগাছার মধ্যে টাকা ঢালার কোনো মানে হয় না।: তাইলে যারা তাদের ছেলেমেয়ের কোচিং সেন্টারে পড়াইতেছে, সবাই আগাছার মধ্যে টাকা ঢালতেছে?
: ঢালুক বা না ঢালুক, তুমি ওই পথে যাবা কেন? তুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেইকা পাস করা ছাত্রী। তোমার ছেলেরে তুমি যেভাবে পড়াবা, তার চাইতে ভালো কইরা পড়ানোর ক্ষমতা কোনো কোচিং সেন্টারের আছে?: শাফিনরে পড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব না। ঘাড়ের ওপরে দাঁইড়াইয়া না থাকলে এই ছেলে একটা অক্ষরও পড়ে না।
: কোচিং সেন্টারের লোকজন ছাত্রছাত্রীদের ঘাড়ের ওপর দাঁড়াইয়া পাঠদান করে নাকি? ওরা পাইকারি হারে ফটোকপি করা শিট সবার হাতে ধরাইয়া দেয় আর পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করার তালে থাকে। ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র হাতে আসার পর সেইগুলার উত্তর কবুতরের বাচ্চারে খুঁদ খাওয়ানোর স্টাইলে পরীক্ষার্থীদের খাওয়ানো হয়। এইটাই হইল তাদের গোপন ম্যাজিক।
: ম্যাজিক-ফ্যাজিক বুঝি না; তুমি তোমার ছেলেরে কোচিংয়ে দিবা কিনা কও?: কোচিং-কোচিং কইরা এত পাগল হইতেছ কেন? স্কুলে তো বিশেষ কোচিংয়ের ব্যবস্থা আছেই। এর পাশাপাশি তুমি একটু দেখাইয়া দিলেই হবে।: যদি না হয়?
: না হইলে সমস্যা কী? ছেলের ওজন আগে বাড়তে দেও। ওজন বাড়ার আগেই ওর হাতে ওজনদার সার্টিফিকেট তুইলা দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নাই। স্কুল কোচিংয়ের কথা বলে লবণ বেগমকে বাণিজ্যিক ধারার কোচিং সেন্টার থেকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলাম। তবে স্কুলে বিশেষ কোচিংয়ের নামে যা হয়েছে, সে সম্পর্কে কিছু বলতে চাচ্ছি না। ছেলের শিক্ষক, আমারও শিক্ষক। স্কুল কোচিং সম্পর্কে বলতে গেলে গুরুনিন্দা হবে।
লেখক: সাংবাদিক, রম্যলেখক।
এইচআর/জিকেএস