মতামত

দাম বাড়ে ওজন কমে

কয়েক বছর আগে বেসরকারি এক স্যাটেলাইট টেলিভিশনের টকশোতে অতিথি হিসেবে বলেছিলাম, এ দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হচ্ছে পরিশ্রমী সৎ মানুষ! যারা সম্মানের কথা ভেবে দিন রাত কাজ করে। সীমিত আয়ে কষ্টে যারা করে জীবন নির্বাহ। আর সে শ্রেণিটা হচ্ছে নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর কাছে জানি না এ ব্যাপারে তথ্য ও উপাত্ত আছে কি না! মোট জনগোষ্ঠীর কত শতাংশ এ শ্রেণির জনগণ, তা আমারও জানা নেই!

Advertisement

বিষয়টি ফের মনে পড়লো দৈনিক বাজার হালচাল ও তদারকি ব্যবস্থাপনার বাস্তবতা উপলব্ধি করে। বাজারে আজকাল যেতে বেশ ভয় করে! কেননা বাজার অনিয়ন্ত্রিত। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অস্থিরতা কমাতে মাঝে মাঝে সরকারের পণ্য সরবরাহ নীতি এবং প্রশাসনের কদাচিৎ তদারকিতেও দীর্ঘমেয়াদি ফল দেয় না। অতি মুনাফালোভী সংঘবদ্ধ ব্যবসায়ী ও বিক্রেতার কাছে আমরা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা অসহায়। ফলে জিনিসপত্রের লাগামহীন মূল্যে শঙ্কা যেমন হয়, তেমন মূল্যস্ফীতিতে ঈপ্সিত পণ্যের অতিরিক্ত দাম মেটাতে গিয়ে আমাদের গা জ্বালা করে।

বাসার কাছেই মহানগরের শান্তিনগর বাজার। বেইলী রোড, মিন্টু রোড, হেয়ার রোড, সিদ্ধেশ্বরী, চামেলীবাগ ও শান্তিনগরের বসবাসকারী বড় বড় সরকারি কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ীরা বেশিরভাগ এ বাজারের ক্রেতা। অনেকেই শান্তিনগর বাজারকে বলেন, বড়লোকের বাজার! সাত বছরে এ এলাকায় বসবাসে নিবিড় পর্যবেক্ষণে আমারও উপলব্ধিও তাই! আমাদের জন্য নয় যেন এ বাজার, তা শুধু বড়লোকের জন্য! বিক্রেতারা অল্প আয়ের ক্রেতাকে ভর্ৎসনা করে! স্বল্প পণ্য বিক্রয় করতে তারা অস্বস্তিবোধ করেন।

ঘরে চাল নেই! অনেক কিছুই নেই। অতিরিক্ত মূল্য প্রদানের যাতনায় বাজারে যেতে ইচ্ছা করে না! তবু খেতে তো হয়! নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে শান্তিনগর বাজার গিয়েছিলাম গতকাল। জিরা নাজিরশাইল চাল খাই বেশ কয়েক বছর ধরে। উৎসব ব্র্যান্ডের চালের বস্তায় পোকা তৈরি হয়। সে বিধায় এখন ২৫-৪০ কেজির চালের বস্তা কিনি না। চার সদস্যের পরিবারে মাসে ৯-১০ কেজি চাল লাগে। চালের দোকানে দাম জানতে গিয়ে তো চক্ষু চড়কগাছ! আড়াই মাস আগে যে চাল কিনেছিলাম ৬৮ টাকায় কেজি, শেরপুর থেকে আসা উৎসবের তৈরি সে জিরা নাজিরশাইলের কেজি এখন ৮২ টাকায় দাঁড়িয়েছে! সামনে নাকি আরও বাড়বে!

Advertisement

দোকানি বললেন, ৮০ করে নিতে পারবেন চাচা! বললাম মানুষের দাম কমে গেছে! মানুষের দামই যদি কমে যায়, তাহলে ক্রেতা পাবেন কীভাবে? ৫ কেজি দিতে বললে বিক্রেতার ঠোঁট বাঁকানো উত্তর -মাত্র! তবে ৮২ টাকার কম দিতে পারবেন না? দেশি লাল চিনি খুঁজতে লাগলাম। পেলাম। এক দাম ১৩০ টাকা। পণ্যের গায়ে দাম পরখ করছি। তাতে লেখা এমআরপি (সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য) ১২০ টাকা। বললাম সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য বা এমআরপির মানে হলো কম রাখা যাবে কিন্তু নির্ধারিত মূল্যের ওপর নয়। বিক্রেতা রীতিমতো শাসিয়ে বললেন, ‘কেউ তো এত কথা কয় না। আমনে নিবেন?’ নামাজের কথা বলে মুদি দোকানি চলে গেলেন। বললাম, দিন। তিনি বললেন ‘অপেক্ষা করেন মসজিদ থেকে আই লই।’

পরে অন্য দোকানে গেলাম। এমআরপির বিষয়ে আমার একই বক্তব্য কাজে দিলো না! দোকানদার ছেলেটা বললো ‘১২০ টাকা এখন দিলাম। নতুন মালে ১৪০ টাকা লাগবো।’ অনুসন্ধিৎসু হয়ে ডিজিটাল পরিমাপক যন্ত্রে ক্রয়কৃত লাল চিনি তুলে দেখি ৯ গ্রাম কম! জানতে চাইলে ছেলেটার স্পষ্ট উত্তর- ‘আই কী এইয়ার মদ্দে হান্দাইচিনি’?

সপ্তাহ দুই আগে বাসার কাছে মনিহারি দোকান থেকে ২ কেজি দেশি পেঁয়াজ কিনেছি ১০০ টাকায়। এবার কিনলাম ১২০ টাকায়। বাতাসে ডিজিটাল পরিমাপক যন্ত্র ০ সংখ্যার স্থানে ২১ উঠে আছে। দোকানিকে বললাম শূন্যে আনুন মেশিন। উত্তরে বললো, ‘ও কিছু না! ওটা বলের মাপ। আপনি অন্য জায়গায় গিয়ে মেপে দেখুন।

সাবানের প্যাকেটজাত গুঁড়া কিনে দু’ হাতে ভারী বোঝা নিয়ে বাজার ত্যাগ করি। বাসার কাছে এসে পাউরুটি কেনার সময় দোকানির ওজন মেশিনে মেপে দেখি পেঁয়াজ ৪৭ গ্রাম কম। এক কেজির সাবানের গুঁড়ার দু’ প্যাকেটেই ১১ ও ৯ গ্রাম কম! ঘর্মাক্ত আমি। ফের বাজারে যাব? ভাবলাম এতো নতুন কিছু নয়! কষ্ট আর নীরবের মনদ্রোহ আমাদের নিত্যসঙ্গী। কে দেখে আমাদের নিত্য বেদনার অদৃশ্য চোখের জল? কোথায় আমাদের ক্রমবর্ধমান বাজারে ক্রয়ের ক্ষমতা? সত্যি কি আছে আমাদের মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্তদের ভোক্তা অধিকার?

Advertisement

দুর্মূল্যের বাজারে মাছ মাংস কেনা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি। মাসে ৩-৪ দিন সকালে উড়াল সড়কের নিচে ভাসমান কাঁচাবাজার থেকে মাছ, মাংস ও তরকারি কিনি। জিনিসের দাম বেশি অথচ ওজন দেখি কম। ওজনে প্রায়ই প্রতারণার শিকার হই। সকালে চায়ের সঙ্গে বিস্কুট খাই। দশ টাকা মূল্যের বিস্কুটের প্যাকেট আর নেই। দাম বেড়ে হয়েছে ১৫-২০ টাকা। কিন্তু আগের পরিমাণের চেয়ে সে পণ্যের ওজন কমে গেছে! ৩০০ গ্রাম ওজনের পাউরুটি ৩০ টাকা থেকে বেড়ে এখন ৪৫ টাকা।

‘দাম বাড়ে ওজন কমে’ সেই নিরীক্ষার ধারাবাহিকতায় সকালে ন্যাশনাল ফুড প্রোডাক্টসের স্বঘোষিত প্রকৃত ওজনের পাউরুটির পরিমাণ পরীক্ষা করি। প্যাকেটের প্লাস্টিক গায়ে লেখা ‘নেট ওজন’ ৩০০ গ্রাম। ১ নভেম্বর দোকানে আসা আঠাযুক্ত লেবেলে পণ্য মেয়াদের সময় রয়েছে ১১/১১/২০২২ এবং এমআরপি ৪৫ টাকা। ৩টি রুটি দোকানিকে দিয়ে পরীক্ষা করালাম। তাতে ৩০২, ২৯০ ও ২৯২ গ্রাম ওজন পাওয়া গেলো। ৩০২ গ্রামের পাউরুটিটি খরিদ করলাম। পাউরুটিসহ অন্যান্য দ্রব্যের মূল্য পরিশোধের সময় ১৬৫ টাকার স্থলে দোকানদার রাখলেন ১৬০ টাকা! বললাম ‘দাম বাড়ে কিন্তু ওজন কমে।’

আজকাল ঊর্ধ্বগতির পণ্য বাজারে খুচরা টাকা বা পয়সা নেই এ অজুহাতে অনেক বিক্রেতাই ৯৫, ১৯৫ টাকার দামে পাঁচ টাকা ফেরত দিতে চান না! ১০০ ও ২০০ টাকাই রাখেন। আগে খুচরা টাকা-পয়সার বিনিময়ে চকলেট দেওয়া হতো!

ক’দিন আগে বাজারে গিয়ে রীতিমতো হোঁচট খেলেন একটি তৈরি পোশাক কারখানার ব্যবস্থাপক পদে চাকরি করা আমার একজন নিকট প্রতিবেশী। সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানীর শান্তিনগর বাজারে গিয়ে তিনি দেখলেন চাল, মসুর ডাল থেকে শুরু করে আটা, ময়দা, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল, চিনি সব কিছুর দামই বাড়তি।

বাজার করার জন্য হিসাব করে যে টাকা নিয়ে এসেছেন তিনি, তা দিয়ে তার কাছে থাকা তালিকার সব পণ্য কিনতে পারলেন না। পরে তিনি সেই তালিকা কাটছাঁট করে অতি জরুরি পণ্যগুলো কিনলেন। প্রতিবেশীর মতো সীমিত আয়ের মানুষ হিসেবে আমারও এমন অবস্থা প্রায়ই ঘটে। বাবার কথা মনে পড়ে যায়, ‘পাত্র ভরে টাকা নাও, পকেট পুরে জিনিস আনো।’

আমাদের মতো চাকরিজীবীদের তো আয় বাড়েনি। কিন্তু বিভিন্ন পণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে তো আর কুলিয়ে উঠতে পারছি না। শুধু আমি নই, আমার মতো স্বল্প আয়ের মানুষেরা কেউই আজ ভালো নেই। ক্রয়ক্ষমতা বাড়েনি সৎ মানুষের। দেশের নীতিনির্ধারকদের বলতে ইচ্ছে করে- তাহলে কি দেশে অসৎ লোক বেড়ে গেছে?

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে শুধু খাদ্যপণ্যই নয়, খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দামও বেড়েছে লাগামহীনভাবে। আগস্ট ও সেপ্টেম্বর দু’মাসে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে সেপ্টেম্বর মাসে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত দুই ধরনের পণ্যেই মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের বেশি হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, আগস্ট মাসে গত ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। এর আগে ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ২০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সম্প্রতি তাদের এক গবেষণায় জানিয়েছে, দেশে মূল্যস্ফীতি লাগামহীন, শিগগির সমাধানের লক্ষণ নেই। পাশাপাশি অনেকেই খাদ্য ব্যয় কমিয়ে আনতে খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিচ্ছেন মাছ, মাংসসহ বিভিন্ন আমিষ। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, বর্তমানে রাজধানীতে বসবাসরত চার সদস্যের একটি পরিবারের মাসে খাদ্য ব্যয় ২২ হাজার ৪২১ টাকা। মাছ-মাংস বাদ দিলেও খাদ্যের জন্য ব্যয় হচ্ছে ৯ হাজার ৫৯ টাকা।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত এটা বড় উদ্বেগের বিষয়। সব কিছুর মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় স্বল্প আয়ের মানুষ কষ্টে আছে। তারা মধ্যবিত্তকেও এখন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনার কথা বলেছেন।

সিপিডি সত্যিটাই বলেছে! চার সদস্যের নিজ পরিবারে এখন আমিষ খাবার রীতিমতো নাগালের বাইরে। আমার মতো অনেকেই বাজারে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। সঞ্চয় ভেঙে বা ঋণ করে অতি কষ্টে কোন রকমে জীবন চালাচ্ছেন! প্রতিটি জিনিসের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির গতি দেখে আমরা মধ্যবিত্তরাও থমকে যাই! পণ্যমূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বৈশ্বিক সমস্যাই কি একমাত্র অজুহাত?

বাজারের সুষম ব্যবস্থাপনা কি ঠিকমতো হচ্ছে? দেশে বাজার অস্থিরতার জন্য দায়ী অতি মুনাফালোভী বড় বড় দেশি উৎপাদক ও ব্যবসায়ী কাউকে কি দোষী প্রমাণের পর কারাগারে ঢুকানো হয়েছে কোন কালে? অস্বাভাবিক ও অন্যায্য পণ্যমূল্য যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, বাজার তদারকির নামে ক্রেতা অধিকার ক্ষুণ্নের জন্য নিয়োজিত সংস্থাগুলোর কিই বা প্রয়োজন?

প্রতারণার মূল্য দিয়ে যেতেই হবে ক্রেতা বা ভোক্তাকেই? দাম বাড়বে আর ওজন কমবে এটা কি আমাদের মতো আয়করদাতাদেরও মেনে নিতে হবে? আর আমাদের করে পরিচালিত মাথা ভারী প্রশাসন টেবিলে মাথা রেখে ঘুমাবেন আর বলবেন-বৈশ্বিক সমস্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ! এসব নিয়ে নিদারুণ কষ্টে থাকা আমি ভাবছি, আমার মতো অসহায়রাও শুধু ভাবছেন। কিন্তু দায়িত্বরতরা কি তা ভাবছে?

লেখক: কথাসাহিত্যিক, কবি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।reporterpranab@gmail.com

এইচআর/এএসএম