আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কম হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশের একটি অন্যতম আকাঙ্ক্ষা ছিল বিজ্ঞানভিত্তিক একমুখী একটি আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা, যার ওপর ভিত্তি করে আগামীর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে।
Advertisement
কিন্তু কষ্টদায়ক হলেও সত্য যে আমাদের তেমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা স্বাধীনতার পরবর্তী কোনো সরকার দিতে পারেনি। পরীক্ষা পদ্ধতি থেকে পাঠ্যপুস্তক সব জায়গায়ই বিভিন্ন সময় পরিবর্তন আনা হয়েছে কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সেই ফলাফল আর আসেনি।
আমার বেড়ে ওঠাকালীন সর্বপ্রথম যে পরিবর্তনের সম্মুখীন হয়েছিলাম সেটি ছিল প্রশ্নব্যাংক পদ্ধতির প্রশ্নপত্র। ১৯৯২ সালে প্রবর্তিত এসএসসি বোর্ডের পরীক্ষায় ৫০ নম্বর রচনামূলক আর ৫০ নম্বর নৈবৃত্তিক/// বা MCQ যাকে বলা হয় তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো। সেই পদ্ধতিও স্থায়ী হলো না। সৃজনশীলতার প্রথম পদক্ষেপ সম্ভবত সেটিই ছিল। মুখস্থ বিদ্যা থেকে বের করে আনার পদক্ষেপ হিসেবেই সরকার সেই সিদ্ধান্ত নেয়।
পরে আরও এমন অনেক পরিবর্তনই দেখলাম। প্রাইমারি ও জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়া হলো। শুরু হলো পঞ্চম শ্রেণির পিএসসি বা পিইসি ও অষ্টম শ্রেণির জেএসসি/জেডিসি পরীক্ষা।
Advertisement
এই দুটি পরীক্ষা কেন বা কী উদ্দেশ্য নিয়ে চালু করা হয়েছিল সেই ব্যাখ্যাটা কেউ দিতে পারে না। বরং এ দুটি পরীক্ষার মাধ্যমে কোমল বাচ্চাদের এক ধরনের অনৈতিক ও অমানসিক প্রতিযোগিতার দিকে ঠেলে দেওয়া হলো।
অভিভাবকদের মধ্যে শুরু হয়ে গেলো অসম্ভব এক প্রতিযোগিতা। সন্তানকে ভালো ফলাফল করাতেই হবে এমন মনমানসিকতায় তারা প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো ঘটনার সাথেও জড়িয়ে পড়তে থাকল।
প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে গিয়ে উল্টো রমরমা এক বাণিজ্যের দুয়ার খুলে দিল এই পদ্ধতি। সৃজনশীল উপায়েই প্রশ্ন ফাঁসের ব্যবসা শুরু হয়ে গেলো। চলছে এই পরীক্ষাগুলোর যৌক্তিকতা নিয়ে পক্ষে বিপক্ষের আলোচনা।
এসএসসি ও এইচএসসির পরীক্ষা পদ্ধতিরও পরিবর্তন এসেছে ব্যাপক। সৃজনশীল প্রশ্নপত্র সেইসব আলোচিত পরিবর্তনেরই একটি ফলাফল। ব্যাপক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সারাদেশের শিক্ষকদের সৃজনশীল প্রশ্নপত্র তৈরির জন্য প্রস্তুত করতে শুরু করল। স্কুল পর্যায় থেকেই শুরু হলো সৃজনশীলতার চর্চা। সেই ধারাবাহিকতা এখনও চলছে। সৃজনশীল প্রশ্নপত্রের প্রশিক্ষণের নামে রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে ব্যাপক অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছিল। সেই প্রশিক্ষণের সফলতার প্রকৃত উদাহরণ না পেলেও প্রশ্নপত্র কতটা অসৃজনশীল হতে পারে তার প্রমাণ এখন হাতেনাতে পাওয়া যাচ্ছে।
Advertisement
এবছরের এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র যেন আমাদের অবাক থেকে অবাকতর করে তুলছে। লেখক আনিসুল হকের ওপর যে প্রশ্ন করা হয়েছে সেটির উৎস ছিল মূলত তারই করা একটি ফেসবুক পোস্টকেন্দ্রিক আলোচনা।
অবাক বিষয় হচ্ছে একটি বোর্ডের পরীক্ষায় কি কোন ব্যক্তির ব্যক্তিগত মতামতকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া বিতর্ক বিষয় হতে পারে? যতটা জানি, সৃজনশীল প্রশ্নের উৎস থাকবে পাঠ্যপুস্তক। তবে গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে প্রাসঙ্গিক বিষয়ের ওপর ছাত্ররা তাদের ভাবনার জগৎ থেকে প্রশ্নের উত্তর দেবে আর এটাই পদ্ধতি।
ফেসবুকের কল্যাণের এখন আর কিছুই লুকিয়ে থাকে না। এবার এইচএসসি পরীক্ষার ঢাকা বোর্ডের বাংলা প্রশ্নপত্রে সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক প্রশ্নের বিষয়ে তো তদন্ত চলছে এবং সম্পৃক্ত ব্যক্তিদেরও চিহ্নিত করা হয়েছে। তেমনি আরেকটি প্রশ্ন দেখলাম যাত্রাবাড়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজের এ বছরের দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষার জীববিজ্ঞানের সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে। কী আছে সেখানে?
প্রশ্নে বলা হয়েছে, ‘রহমান সাহেবের বয়স ৫০ বছর। তিনি সবসময়েই তার ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড নিয়ে টেনশনে থাকেন। একদিন হঠাৎ তার বুকের মাঝখানে কিছুটা বামদিকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করেন এবং প্রচুর ঘামতে থাকেন। দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিলে ডাক্তার তাকে ইসিজি করাতে বলেন এবং আপাতত বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা দেখা থেকে বিরত থাকতে বলেন।’ এই প্রশ্নের মাঝে জানতে চাওয়া হয়েছে-
ক. স্ট্রোক কী
খ. ধমনী ও শিরার মধ্যে ৪টি পার্থক্য লিখো
গ. রহমান সাহেবের বুকে এমন ব্যথা হওয়ার সম্ভাব্য কারণ ব্যাখ্যা করো।
ঘ. “প্রতিকার অপেক্ষা প্রতিরোধ উত্তম” – রহমান সাহেবের সমস্যার আলোকে বিশ্লেষণ কর।
আমি পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে গোটা প্রশ্নটিই তুলে দিলাম। এখন কথা হচ্ছে যে ঘটনার মাধ্যমে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বলা হচ্ছে তার সাথে স্ট্রোকের সম্পর্ক কতটা পরিষ্কার এবং প্রতিকার বা প্রতিরোধ হিসেবে বাংলাদেশ ক্রিকেট খেলা দেখার সম্পর্ক কতটা বৈজ্ঞানিক? এখানে সৃজনশীল চিন্তার অবকাশ কোথায়? একজন শিক্ষার্থীর মাথায় এমন উদ্ভট চিন্তা ঢুকিয়ে দেওয়া কতটা নৈতিক?
আসলে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। কিন্তু কেন জানি না কোনোভাবেই এর মান উন্নত করা যাচ্ছে না বরং দিনে দিনে গতি নিম্নমুখী।
২০২৩ সাল থেকে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতিকে ভিত্তি রেখে সাজানো হচ্ছে পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচি। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত থাকবে না কোন পরীক্ষা। প্রাক প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত আনা হচ্ছে এক বিশাল পরিবর্তন।
ধাপে ধাপে এই পরিবর্তন কার্যকর করা হলেও এই পরিবর্তন অনেক চ্যালেঞ্জিং হবে এটা পরিষ্কার। সেই পরিবর্তনকে সফল করতে দরকার একদল অভিজ্ঞ, পেশাদার ও নিবেদিত শিক্ষক। কিন্তু অতীতের সব পরিবর্তনের বাস্তবায়নের ধারা বলছে আমাদের শিক্ষকরা তৈরি নয় অথবা তারা যথেষ্ট যোগ্য ও মোটিভেটেড নয়। শিক্ষকরাই হচ্ছে পরিবর্তনের প্রধান বাস্তবায়নকারী। এই জায়গায় যদি যথেষ্ট যোগ্য শিক্ষক তৈরি করার সব প্রকার আয়োজন করা না যায় তাহলে হয়তো কাঙ্ক্ষিত ফল নাও আসতে পারে।
লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, কলামিস্ট।
এইচআর/এএসএম