২০০২ সালে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় এশিয়ায়। জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া যৌথভাবে আয়োজন করে বিশ্বকাপ ফুটবলের মেগা আসর।
Advertisement
এশিয়া থেকে শিরোপা জয়ের জন্য বিশ্বকাপ খেলতে আসে আর্জেন্টিনা। সেবারের আর্জেন্টিনা ছিল এক কথায় অপ্রতিরোধ্য। তারায় খচিত টাইটানিক। স্বপ্নের ফানুস উড়িয়ে অনেকটা বিশ্বকাপ জয়ের ঘোষণা দিয়েই তারা আসে জাপানে।
আর্জেন্টিনার দলটি দেখে আমরা সমর্থকরা ছিলাম দারুণ উল্লাসিত। এক যুগ পর লা আলবিসেলেস্তারা ফাইনাল খেলবেই। ম্যারাডোনার পর আবারও শিরোপাও জিতবে বাতিস্তুতা, ভেরনা। শক্তিশালী দলটি দেখে পতাকা পতাকায় পাড়া-মহল্লা ভরিয়ে তোলি আমরা। প্রায়দিনই হয় আগাম আনন্দ মিছিল।
সেবার এতো উন্মাদনার যথেষ্ট কারণও ছিলো। ফিফা র্যাংকিং এ সেবার আর্জেন্টিনা ছিলা ১/২ এ। লাতিন আমেরিকান বাছাই পর্ব চ্যাম্পিয়ন। দ্বিতীয় দল থেকে মিনিমাম ১০ পয়েন্ট এগিয়ে বাছাই পর্ব শেষ করেছে। হেরেছে মাত্র ১টি ম্যাচে।
Advertisement
কবে কিভাবে হারবে আর্জেন্টিনা? বা এই আর্জেন্টিনাকে কে হারাবে? পত্রিকার শিরোনামই ছিল এসব। বাছাই পর্বে ব্রাজিলের অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। কোনোমতে শেষ ম্যাচ জিতে ৩য় বা ৪র্থ হয়ে সেবার বিশ্বকাপে খেলতে আসে তারা। শেষ ম্যাচটি যদি হেরে যেতো, তাহলে প্লে অফ খেলতে হতো ব্রাজিলিয়ানদের। বাছাইয়ে আর্জেন্টিনার পয়েন্ট ব্রাজিলের চেয়ে কম করেও ১৩/১৪ বেশি ছিলো।
আবারও সেবারের আর্জেন্টিনা দলটির দিকে দেখুন! তারায় তারায় খচিত- রবার্তো আয়ালা, হ্যাভিয়ের জেনেত্তি, পাবলো সোরিন, স্যামুয়েল ওয়াটসন, মওরিসিও পচেত্তিনো, পাবলো আইমার (মেসির আইডল), হুয়ান সেবাস্তিয়ান ভেরন, দিয়েগো সিমিওনে, অ্যারিয়েল ওর্তেগা (গরীবের ম্যারাডোনা), গ্যাব্রিয়েল বাসিস্তুতা, হার্নান ক্রেসপো, ক্লদিও লোপেজ- এই নামগুলো তখন বিশ্ব ফুটবলের সেরা। তাদের নাম শুনলেই যেন প্রতিপক্ষের হৃদয় কাঁপে।
ইতালির লিগ মাতিয়ে বেড়ানো খেলোয়াড় তারা। বুড়ো ক্যানিজিয়াকেও রেখেছিল দলে। অধিনায়ক ছিলেন ভেরন। কোচ ছিলেন তখনকার আলোচিত মার্সেলো বিয়েলসা।
প্রথম ম্যাচ নাইজেরিয়ার বিপক্ষে। আমরা আর্জেন্টাইন সমর্থকরা উল্লসিত। হিসেব কষছিলাম, কতো গোলে জিতব এবার আর্জেন্টিনা? ১৯৯৪ এবং ১৯৯৮ সালের পর ২০০২ সালেও বাতিস্তুতা, যাকে ডাকতাম বাতিগোল নামে, হ্যাট্রিক করবে। পরপর তিন বিশ্বকাপে তিন হ্যাট্টিক হবে তার। ওর্তেগা ম্যারাডোনার মতো করে গোল দিবে। কত কি স্বপ্ন আমাদের!
Advertisement
মিছিল শেষ করে এসে খেলা দেখতে বসলাম। হায় আল্লাহ! নাইজেরিয়ার ডিফেন্স কোনো ভাবেই ভাঙ্গবে না। অবস্থাটা এমন যেন, তারা ভাঙবে তবু মচকাবে না। কোনোমতে বাতিগোলের (বাতিস্তুতা) ১টা গোলে অনেক কষ্টসাধ্য জয় পেলো আর্জেন্টিনা।
আমাদের অনুভূতি, ‘ব্যাপার না, পরের ম্যাচে ইংল্যন্ডকে উড়িয়ে দিব- টাইপের।’
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার ম্যাচ মানেই যুদ্ধ, ফকল্যান্ড যুদ্ধের দগদগে ক্ষত সামনে নিয়ে আসা এবং ব্রিটিশ মিডিয়া উন্মাদনা। ৮২’র ফকল্যান্ড যুদ্ধ, ৮৬ সালের নাকানিচুবানি বা ৯৮ সালে বেকহাম এর লালকার্ড কাণ্ড- সব চলে আসে এই ম্যাচের আগে। যথারীতি ম্যাচ শুরু। আমরাও টিভির সামনে দলবেধে বসে পড়লাম; কিন্তু কোথায় সেই আর্জেন্টিনা? বেকহামের একমাত্র পেলান্টি গোলে হেরে গেলো আমাদের প্রিয় আর্জেন্টিনা।
শেষ ম্যাচ সুইডেনের বিপক্ষে। জয়ছাড়া অন্য কোন ফল মানেই প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায়। ১২ জুন ২০০২- আমার এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। কম্পিউটার ২য় পত্র। সম্ভবত খেলাটা শুরু হয়েছিলো দুপুর ১২.৪৫ মিনিটে। আমি ১১.৩০ মিনিটে খাতা জমা দিব, স্যার নিবেন না জমা। বললাম, স্যার আর্জেন্টিনার খেলা আছে, বাঁচামরার লড়াই। আমি চললাম, আপনি যা খুশি করেন।
দ্রুতই বাসায় এসে ব্রাজিল আর্জেন্টিনা সমর্থকরা সবাই মিলে টিভির সামনে বসলাম। সুইডেনের বড় তারকা হেনরিক লারসন, ইব্রা (ইব্রাহিমোভিচ) তখন উঠতি তারকা। আর কোন তারকা নেই, সুতরাং জিতবেই আর্জেন্টিনা।
৬০ মিনিটে কোন এক সন (আন্দ্রেস স্ভেনসন) এর গোলে পিছিয়ে আর্জেন্টিনা। এরপর ১০ জনই ডিফেন্সে নিয়ে এসে সুইডেন আক্রমণ ঠেকাচ্ছে। যাকে বলে বাস পার্ক ডিফেন্স। আর্জেন্টিনার মুহুর্মুহু আক্রমণ, হার্নান ক্রেসপো, ওর্তেগা, বাতিস্তুতা, আয়ালা, সোরিনরা আক্রমণ করতে করতে ক্লান্ত; কিন্তু সুইডেনের ডিফেন্স ভাংগতে পারেনি। খেলার উত্তেজনা এতোই তুংগে ছিলো যে ক্যানিজিয়া মাঠের বাইরে থেকেও লাল কার্ড পেয়ে বসেন।
৮৮ মিনিটে পেলান্টি পেল আর্জেন্টিনা। ওর্তেগা মিস করলেও ফিরতি বলে ক্রেসপো গোল করে ১-১ গোলে সমতায় আনেন। শেষ কয়েক মিনিটে আর গোল হলো না। ম্যাচ ড্র হলো। বিদায় নিলো আর্জেন্টিনা। আমাদের প্রিয়, স্বপ্নের আর্জেন্টিনা।
টেন্ট ধরে বাতিস্তুতার কান্নার সাথে আমাদের কান্না একাকার হয়ে গেলো সেদিন। কান্নার রেশের মধ্যেই আমাদের বিশ্বকাপ অভিযান শেষ হলো প্রথম রাউন্ড থেকে। আর্জেন্টিনার সমর্থকরা সেদিন এতো কষ্ট পেয়েছিলাম যে, কোন ব্রাজিল সমর্থক পর্যন্ত আমাদের আর বিদ্রুপ করেননি।
২০০২ সালে আগের বিশ্বকাপ ও ইউরোজয়ী, ফিফা নাম্বার ওয়ান দল জিনেদিন জিদানের ফ্রান্স প্রথম ম্যাচে সেনেগালের কাছে হেরে আর ব্যাক করতে পারেনি। জিদান প্রথম ম্যাচ খেলতে পারেননি। ফিফা র্যাংকিং ১ ও ২ নাম্বার দল বিদায় নেয় প্রথম রাউন্ড থেকেই।
অন্যদিকে, অনেক কষ্টে বাছাইপর্ব উৎরে আসা ব্রাজিল চ্যাল চ্যালায়া আমাদের সামনে দিয়ে শিরোপা জয় করে এশিয়া ত্যাগ করলো।
২০ বছর পর আবার এশিয়ায় বিশ্বকাপ। আর্জেন্টিনা এবারও অনেক ভালো দল। ফেবারিট। এশিয়া কি সেই দুঃস্বপ্ন ফিরিয়ে দিবে? নাকি এই গ্রহের সেরা ফুটবলার লিওনেল মেসিকে বিশ্বকাপ উপহার দিয়ে ইতিহাস হয়ে থাকবে?
লেখক: নুরুল করিম, সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, নীলফামারি সরকারী কলেজ।
আইএইচএস/