তরুণদের ওপর নির্ভর করে এগিয়ে যাচ্ছে চীনের অর্থনীতি। বিশ্বের বুকে দারুণ সম্ভাবনা ময় হিসেবে স্বীকৃত হলেও দেশটির রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সর্বগ্রাসী চেতনায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশটির অর্থনীতি।
Advertisement
চীনে রাজনৈতিক প্রতিবাদ নিষিদ্ধ। চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি) পরিচালিত সরকার, আদালত, সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে যে কোনও বিষয়ে সমালোচনা সহ্য করা হয় না। সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই জেল অথবা গুম হওয়াটা চীনে বেশ স্বাভাবিক ঘটনা। একদলীয় সরকার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের পরিসংখ্যানও গোপন করে রাখে। তবে বেসরকারি সূত্র বলছে, বছরে অন্তত হাজার খানেক মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় কমিউনিস্ট পার্টি শাসিত দেশটিতে।
মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ক্ষেত্রে ইরান, মিশর, ইরাক, সৌদি আরবের সঙ্গেই উচ্চারিত হতে পারে চীনের নাম। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে মৃত্যুদণ্ড বেশি হওয়ায় অনেকেই শরিয়ত আইনের সমালোচনা করে থাকেন। কিন্তু চীনে তো শরিয়ত আইনের বালাই নেই। তবু প্রতি বছর হাজারেরও বেশি মানুষ মৃত্যুদণ্ড ভোগ করেন।
এ বিষয়ে পর্যবেক্ষকদের ধারণা, চীনের সিংহভাগ মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয় পুরোপুরি রাজনৈতিক কারণে। কেউ সমালোচনা করলেই সিসিপি তাকে হত্যা করে। তাই মানুষ প্রতিবাদ করতে ভয় পায়। তবে গোপনে নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করেছেন চীনারা।
Advertisement
সম্প্রতি তারা কেউ কেউ পথে নামতেই চীনা সেনার সাঁজোয়া গাড়ির ভিডিও দেখিয়ে তাদের দাবিয়ে রাখার কৌশল নেয় সিসিপি। তবু 'শূন্য কোভিড' নীতির জন্য প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর বিরুদ্ধে ব্যানার ঝুলতে দেখা যায় চীনে। কিন্তু জনমতকে উপেক্ষা করে মাওয়ের রেকর্ড ভেঙে তৃতীয়বারের মতো পার্টি কংগ্রেস শি’কেই প্রেসিডেন্ট পদে বহাল রেখেছে।
চীনের সর্বগ্রাসী কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ বোঝাতে বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি ব্যানারই যথেষ্ট। একটিতে শি’কে 'একনায়ক' বলে কটাক্ষ করা হয়েছে। অন্যটিতে, 'পিসিআর টেস্ট নয়, খাদ্য চাই। নিয়ন্ত্রণ নয়, চাই স্বাধীনতা। মিথ্যা নয়, চাই শ্রদ্ধা।' এমন স্লোগান লেখা।
চীন সরকার দেওয়াল লিখন মুছতে সবরকম চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন অনুযায়ী, 'ভয়েস অব সিএন জানিয়েছে, শেনজেন, সাংহাই, বেইজিং এবং গুয়াংজু এবং সেই সঙ্গে হংকংসহ অন্তত আটটি চীনা শহরে এই স্লোগানগুলি গোপনে প্রদর্শিত হয়েছে।'
স্পষ্টতই, চীনের নাগরিকরা রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠছেন। অন্যদিকে, সিসিপি সর্বগ্রাসীবাদের পথেই চলছে। সেইসঙ্গে অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি পালনেও তারা ব্যর্থ হচ্ছে।
Advertisement
গত ১০ বছর ধরে চীনে প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস পাচ্ছে, যা ভাবাচ্ছে ক্ষমতাসীন দল ও দেশটির সাধারণ মানুষদের। গত মাসে, বেইজিং প্রবৃদ্ধির হার ৫.৫ শতাংশ দেখালেও বিশ্বব্যাংকের অনুমান, চীনে ২০২২ সালে মাত্র ২.৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে।
তাছাড়াও, তিন দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো, চীনের প্রবৃদ্ধি বাকি এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলির থেকে পিছিয়ে পড়বে। আইএমএফের অনুমান ২০২৩ সালে উন্নয়নশীল এশিয়ার ৪.৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধির বিপরীতে চীনের প্রবৃদ্ধি হবে ৪ শতাংশ।
যুক্তরাজ্যের ক্যাপিটাল ইকোনমিক্সের প্রধান অর্থনীতিবিদ নীল শিয়ারিংয়ের মতে, ‘আমরা বছরের পর বছর ধরে সতর্ক করে আসছি যে, কেন আমরা চলমান, শক্তিশালী চীনা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ঐকমত্যকে ভুল বলে মনে করি এবং কিভাবে এই দশকের শেষ নাগাদ অর্থনীতি মাত্র ২ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে।’ ২৬ সেপ্টেম্বরের একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সম্পত্তি বা নির্মাণ, রপ্তানি এবং দেশীয় ভোক্তা চাহিদা এই তিনটি কারণেই বৃদ্ধির গতি শ্লথ হবে।
আইএমএফের মতে, যে সম্পত্তি খাত চীনের জিডিপিতে ২৯ শতাংশ অবদান রাখে সেটিও ধসে পড়ছে। ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, সংস্কারের অভাব এই ব্যর্থতার মূল কারণ। চীন রিয়েল এস্টেটের বাজারে কৃত্রিম আস্ফালনের মাধ্যমে কয়েক দশক ধরে জিডিপির হার বাড়িয়ে দেখিয়ে নাগরিকদের সঞ্চয়ে আঘাত হেনেছে।
রিয়েল এস্টেট ডেভেলপাররা অতি-সস্তা ব্যাংকের অর্থায়নে আনন্দিত হয়েছে। স্থানীয় সরকারগুলি, যা মূলত সিসিপির স্থানীয় ইউনিট, জমি বিক্রি থেকে অর্থ উপার্জন করতে পেরে খুশি ছিল। নাগরিকরাও তাদের অর্থ বৃদ্ধি দেখে খুশি হয়েছিল। সিসিপির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব নয়া-ঔপনিবেশিক রাজনৈতিক স্বপ্ন অনুসরণ করে স্ফীত জিডিপিতেই আনন্দিত হয়েছে।
এশিয়া ও আফ্রিকার বহু দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) প্রকল্পে অর্থের লোভ সামলাতে পারেনি। প্রকল্পগুলি বেশি খরচে বাস্তবায়িত হয়েছে। এর মাধ্যমে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো বাড়তি মুনাফা নিয়ে দেশে ফিরে গেছে। দেশটির রাজনীতিবিদরাও এ থেকে অর্থ উপার্জন করেছেন। কিন্তু দরিদ্র দেশগুলো ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে চীনের এই লোভ বাস্তবায়নের জন্য। সেইসঙ্গে অনেক দেশ নিজেদের বন্দর, রেললাইন ইত্যাদির ওপর সার্বভৌম অধিকারও হারিয়েছে। মহামারি পরবর্তীতে এই দেশগুলির অর্থনীতি অনেকটা দেউলিয়া হয়ে যায়। চীনও এই বিনিয়োগ থেকে তাদের অর্থ ফেরত পাবে না।
সম্পত্তি খাতে চীনা অর্থনীতির পতন ব্যাংকগুলোকেও বিপাকে ফেলছে। নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে বসেছে নাগরিকদের সঞ্চয়। বেসরকারি সূত্রে জানা গেছে, সেপ্টেম্বর মাস থেকে গাড়ি বিক্রিও কমছে চীনে। তাই উদ্বিগ্ন চীন সেপ্টেম্বরের জন্য শিল্প উৎপাদন, খুচরা বিক্রয়, স্থায়ী সম্পদ বিনিয়োগ ইত্যাদির মাসিক তথ্য প্রকাশ পিছিয়ে দিয়েছে।
অন্যদিকে, চীনের মত সর্বগ্রাসী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চেতনা নিয়ে না এগিয়ে বেশ নিরাপদে রয়েছে ভারত। দেশটিতে কোনো অশান্তি নেই। ভারতে সরকার স্থিতিশীল, অর্থনীতিও স্থিতিশীল। খুচরা ব্যবসা ২০১৯ সালে প্রাক-কোভিড স্তরের তুলনায় সেপ্টেম্বরে ২১ শতাংশ বেড়েছে। আন্তঃরাজ্য পণ্য স্থানান্তরের জন্য ইলেকট্রনিক পারমিট সেপ্টেম্বরে রেকর্ড করেছে।
সেপ্টেম্বরে ভারতে যাত্রীবাহী গাড়ির বিক্রি বেড়েছে ১০ লক্ষ ইউনিট। ভারতীয় আইটি সংস্থা ইনফোসিস সেপ্টেম্বরে প্রত্যাশিতের চেয়েও ভাল মুনাফা রিপোর্ট করেছে। আইএমএফ ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, ভারতে ২০২২ সালে ৬.৮ শতাংশ এবং ২০২৩ সালে ৬.১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে। ২০২৭-২৮ অর্থবছরের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের পরে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে ভারত।
আসলে কোন বিষয়টি আলাদা করছে ভারত ও চীনকে। দু’দেশের রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যেই এর উত্তর রয়েছে। বাজার অর্থনীতি মূলত গণতান্ত্রিক নীতির উপর চলে। প্রাইভেট খাতকে স্বাধীনভাবে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্র নিয়ামক হিসেবে কাজ করে তথ্য অবাধে প্রবাহিত হওয়া। চীন এই নীতিকে অস্বীকার করেছে। ১৯৭৮ সালে সিসিপি একটি 'সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি' তৈরি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বাস্তবে, পুঁজিবাদের একটি নিষ্ঠুরতম রূপের প্রবর্তন করে তারা। যেখানে ক্ষমতা ছিল কেন্দ্রীভূত। ওপর থেকে যা সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, স্থানীয় সিসিপি নেতারা যন্ত্রের মতোই তাই বাস্তবায়িত করেছে।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বহুদলীয় গণতন্ত্রে স্বাভাবিকভাবেই, ভারতের প্রবৃদ্ধি কর্মক্ষমতা অপ্রতুল ছিল। তাই এখন আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা কাঠামোগত সংস্কারের জন্য ভারতের মহামারী পরবর্তী বৃদ্ধির কর্মক্ষমতাকে কৃতিত্ব দিয়েছেন।
নিয়ন্ত্রণ ও গণতন্ত্রের মধ্যে মূল পার্থক্যটি অবশ্য জবাবদিহিতার। ভারতীয় নাগরিকরা তাদের সরকারকে ব্যর্থতার জন্য শাস্তি দিতে পারেন। দুর্নীতির অভিযোগে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারকে ভারতীয়রা ২০১৪ সালে ভোটে হারাতে পেরেছিলেন। কিন্তু সিসিপি সার্বিকভাবে ব্যর্থ হলেও শি জিনপিংকে গদিচ্যুত করার ক্ষমতা চীনা নাগরিকদের নেই। তিনি চাইলেই আজীবন চীনের রাষ্ট্রপতি থাকতে পারেন। সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত, লোভী, সর্বগ্রাসী যাই হোক না কেনো, তা বদলের ক্ষমতা চীনাদের হাতে নেই।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
এইচআর/জিকেএস