বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। এমন এক সময় আসবে যখন এই শাড়ির অনেক দাম থাকবে কিন্তু শাড়ি তৈরি জন্য তাঁতি পাওয়া যাবে না। তখন হয়তো জামদানি শাড়ি তৈরির যন্ত্রপাতিগুলো জাদুঘরে পড়ে থাকবে। কেউ এখন এটাকে পেশা হিসেবে নিতে চান না। আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বলছিলেন সোনারগাঁয়ের আফজাল জামদানি হাউজের মালিক আফজাল হোসেন।
Advertisement
তিনি বলেন, ২০ বছর ধরে এই কাজ করছি। আমরা যারা এই শাড়ি তৈরি করি কেউই সঠিক মজুরি পাই না। তবে আমাদের কাছ থেকে কিনে যারা বিক্রি করছেন তারা ঠিকই লাভবান হচ্ছেন। ৫০০ টাকার একটি শাড়ি তৈরি করতে আমাদের এক সপ্তাহ লেগে যায়। এই দামের শাড়ি প্রতিমাসে সর্বোচ্চ চারটা তৈরি করা সম্ভব হয়। আর ২০ হাজার টাকার শাড়ি তৈরি করতে গেলে ৩ সপ্তাহ চলে যায়। বর্তমানে সঠিক মজুরি না পাওয়ায় অনেকেই ছেড়ে দিয়েছেন এ পেশা। জীবিকার তাগিদে ছোটবেলা থেকে আমি এই কাজ করে আসছি। বর্তমানে যারা এই পেশার সঙ্গে জড়িত তারা প্রত্যেকেই দীর্ঘদিন ধরে এই কাজ করে আসছেন। তাদের অন্য কোনো কাজের অভিজ্ঞতা নেই। এই শিল্পের খারাপ সময় যাওয়া সত্ত্বেও অনেকেই মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যাওয়ায় এই পেশা ছাড়তে পাচ্ছে না।
সোমবার (১৪ নভেম্বর) সকালে প্রাচীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁয়ের বিভিন্ন জামদানি হাউজে গিয়ে জানা যায় তাঁতিদের এমন দুর্দশার কথা।
জামদানী শাড়ি একসময় গর্বের বস্তু ছিল। এই শাড়ি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হয়। তাঁতিদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় শাড়িতে ফুটে উঠে বাংলার প্রাকৃতি, ফুল, লতা-পাতা, বিভিন্ন প্রাণীর দৃশ্যসহ বাহারি সব নকশা। জামদানি শাড়ির প্রতি নারীদের অন্যরকম ভালোবাসা আছে। বাংলার এক অনবদ্য সাংস্কৃতিক নিদর্শন এই জামদানি শিল্প।
Advertisement
ইউনেস্কো ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর জামদানিকে বাংলাদেশের ভৌগলিক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তবে এই শিল্পের কারিগররা ভালো নেই। একদিকে ন্যায্যমূল্য না পাওয়া অন্যদিকে নতুন করে এই পেশায় জড়িত না হওয়ায় কমছে জামদানি হাউজের সংখ্যা। ফলে সোনারগাঁয়ের ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প হারাতে বসেছে।
বাবুল প্রধান জামদানি হাউজের কারিগর ইব্রাহীম বলেন, ২৫ বছর ধরে এই কাজ করছি। মামা, খালাদের দেখে এই পেশায় এসেছি। বর্তমানে এখানে ১৪ জন কারিগর আছেন। যারা সবাই দীর্ঘদিন ধরে এ কাজের সঙ্গে জড়িত। আগে তাদের যে পারিশ্রমিক দেওয়া হতো তা দিয়ে সংসার চললেও এখন তা দিয়ে চলতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বেশিরভাগ কারিগররা আগের প্রজন্ম থেকে এই কাজ শিখলেও এখনকার প্রজন্মের কেউই এই কাজ শিখতে আগ্রহী নয়।
সোনারগাঁয়ের স্থানীয় বাসিন্দা শাহাদাৎ হোসেন শুভ বলেন, ৩-৪ বছর আগেও জামদানি শিল্পের অবস্থা তুলনামূলক ভালো ছিল। তখন জামদানি শাড়ির চাহিদা ও দাম দুটোই ভালো ছিল। কিন্তু করোনা ভাইরাসের সময় জামদানি শিল্পের খারাপ অবস্থা হয়। ওই সময় তারা কোনো শাড়ি বিক্রি করতে না পারায় বেশিরভাগ কারিগররা এই পেশা ছেড়ে বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়েছে। আবার সুতার দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় শাড়ীর দাম বেড়েছে। এর ফলে শাড়ীর চাহিদা অনেকটা কমে গেছে। কিন্তু এতকিছুর মধ্যেও বাড়েনি কারিগরদের মজুরি । এছাড়া এই কাজটা করতে অনেক ধৈর্য্য ও দক্ষ হতে হয়। যা সবার পক্ষে সম্ভব না। অন্যসব পেশায় সর্বোচ্চ ৮-১০ ঘণ্টা কাজ করতে হয় কিন্তু এই পেশায় কারিগরদের ১৪-১৫ ঘণ্টা একটানা কাজ করে যেতে হয়।
তিনি আরও বলেন, আগে আমাদের এলাকার ঘরে ঘরে এই জামদানি শাড়ির কাজ চলতো। তখন পরিবারের সবাই একসঙ্গে আনন্দের সঙ্গে এই কাজটি করতো। কিন্তু এটি হারাতে বসেছে। ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে ধরে রাখতে হলে সরকারের কিছু উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। কৃষির জন্য সরকার লোন দিলেও জামদানি শিল্পের জন্য এখনো কোনো লোনের সিস্টেম চালু করেনি। এটি করলে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের উপকার হবে।
Advertisement
সোনারগাঁয়ের সাহিত্যিক, লেখক ও ছড়াকার হাসান মাহমুদ রিপন বলেন, সোনারগাঁ একসময় জামদানি শাড়ির জন্য বিখ্যাত ছিল। বর্তমানে বিদেশি বিভিন্ন পোশাক এদেশে সহজলভ্য হয়ে যাওয়ায় জামদানি শাড়ির চাহিদা কমে গেছে। সরকারের উচিত এই পেশায় জড়িতদের স্বল্পমূল্যে লোন এবং সঠিক মজুরির ব্যবস্থা করে দেওয়া।
বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের সিনিয়র গাইড লেকচারার একেএম মুজাম্মিল হক মাসুদ বলেন, জামদানি শিল্পের মূল সমস্যা হচ্ছে কারিগর সংকট। এই পেশায় সারাদিন কাজ করে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা পাওয়া যায় আর অন্য পেশায় কাজ করলে আরও বেশি টাকা পাওয়া যায়। জামদানি শিল্প বিলুপ্ত হওয়ার অন্যতম কারণ এটি। মহাজনরা এই ব্যবসা করে ঠিকই লাভবান হচ্ছেন কিন্তু কারিগররা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। এই শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রাখতে ও আগামী প্রজন্মকে এই পেশায় উৎসাহিত করার জন্য আমরা সোনারগাঁয়ে একটি বিপণন কেন্দ্র চালু করেছি। এছাড়া এখানে একটি কারুপল্লী রয়েছে যেখানে উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সোনারগাঁয়ের বিখ্যাত মসলিন কাপড়ের ধারাবাহিকতায় বর্তমানে জামদানি শিল্পটা টিকে আছে। আমরা এই শিল্পটা ধরে রাখার চেষ্টা করছি।
রাশেদুল ইসলাম রাজু/জেএস/জিকেএস