হাসান আজিজুল হক (২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯-১৫ নভেম্বর ২০২১) বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিক। ষাটের দশকে আবির্ভুত এ কথাসাহিত্যিক ঝরঝরে গদ্য এবং মর্মস্পর্শী বর্ণনাভঙ্গির জন্য প্রসিদ্ধ। দেশভাগের পরিণতি ও মানুষের জীবনসংগ্রাম ইত্যাদি তাঁর গল্প-উপন্যাসের অন্যতম অনুষঙ্গ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে তাঁর জন্ম। ম্যাট্রিকুলেশন পর্যন্ত বর্ধমানেই পড়াশোনা করেছেন। এরপর ছাত্রাবস্থাতেই রাজনীতিতে যোগ দেন, পাইকস্তানি সেনার হাতে নির্যাতিতও হয়েছেন তিনি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের (পরবর্তীতে অধ্যাপক) পূর্বে দর্শন নিয়ে স্নাতকোত্তর পাস করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মানসূচক ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
Advertisement
বাংলা ছোটগল্পের ‘রাজপুত্র’ হাসান আজিজুল হকের প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে। নিয়মিত বহু পত্র-পত্রিকায় তাঁর ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য (১৯৬৪)’, ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ (১৯৬৭)’, ‘জীবন ঘষে আগুন’র (১৯৭৩) মতো গ্রন্থের গল্পগুলো বোদ্ধা পাঠকের মনযোগ কেড়ে নিচ্ছে। তাঁর লেখা আরও উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ হচ্ছে: ‘নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৫)’, ‘পাতালে হাসপাতালে (১৯৮১)’, ‘আমরা অপেক্ষা করছি (১৯৮৮)’, ‘রাঢ়বঙ্গের গল্প (১৯৯১)’, ‘রোদে যাবো (১৯৯৫)’, ‘মা মেয়ের সংসার (১৯৯৭)’, ‘বিধবাদের কথা ও অন্যান্য গল্প (২০০৭)’ ইত্যাদি। হাসান আজিজুল হকের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গল্পসমূহকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়।
দেশভাগের পর কাঁটাতার হয়েছে। কিন্তু হাসান আজিজুল হক কাঁটাতার ছিঁড়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। ছোটগল্প ও উপন্যাস দিয়ে বাঙালির হৃদয় দখল করতে সক্ষম হয়েছেন। দেশভাগ নিয়ে বড় একটি অংশ দখল করেছে তাঁর সাহিত্যে। তার পরে তিনি ভাষা আন্দোলন দেখলেন, দেখলেন মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ ও তার আগে-পরের বিভিন্ন ঘটনা। দুই বাংলা মিলে হাসান আজিজুল হকের মতো সাহিত্য খুব কম জনই রচনা করেছেন। দেশভাগ নিয়ে হাসান আজিজুল হকের তিনটি ছোট গল্প ‘খাঁচা’, মুক্তিযুদ্ধের গল্প ‘বিধবাদের কথা’ ও ‘উত্তর বসন্তে’ নিয়ে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা আকরাম খান চলচ্চিত্রে রূপদান করেছেন। তিনি শক্তিমান আজিজুল হক সম্পর্কে বলেন, ‘সাহিত্যে হাসান আজিজুল হকের পরিমিতিবোধ, তার ধ্বনিতত্ত্বের ব্যবহার এবং সমাজের বিশাল বিশাল ক্ষতগুলোকে সহজ ভাষায় পাঠকের কাছে উপস্থাপনের ক্ষমতা তাকে তার জায়গা আলাদা করে দিয়েছে।’
তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘আগুন পাখি (২০০৬)’। রাঢ়বঙ্গের প্রেক্ষাপটে এ উপন্যাস লিখেছিলেন। এ ছাড়া ‘সাবিত্রী উপাখ্যান (২০১৩)’, ‘শামুক (২০১৫)’ উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। তাঁর ‘ফিরে যাই, ফিরে আসি (১ম অংশ, ২০০৯)’, ‘উঁকি দিয়ে দিগন্ত’ (২য় অংশ, ২০১১)’, ‘টান (২০১২)’ প্রভৃতির মতো আত্মজৈবনিক গ্রন্থগুলোয় দেশভাগ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
Advertisement
হাসান আজিজুল হক নিজেই দেশভাগের শিকার হয়েছেন। দেশভাগের কারণে ভিটেমাটি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি এটি মেনে নিতে পারেননি। বহু সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন এ কথা। কাজেই তাঁর সাহিত্যে দেশভাগ একটি বড় অধ্যায়। পরবর্তীতে যখন তিনি একাত্তর দেখলেন, একাত্তর দ্বারা প্রভাবিত হলেন। লিখলেন ‘নামহীন গোত্রহীন’ এবং ‘বিধবাদের কথা’র মতো মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রান্তিক মানুষের কথা নিয়ে অসংখ্যবার লিখেছেন। লেখার ক্ষেত্র মানবতাই মুখ্য বিষয়; দেশ বা গোত্র গৌণ। এ কারণেই দু’বাংলার কাঁটাতার তাঁর মনকে ভাগ করতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধকালীন গল্প ‘ভূষণের একদিন’, ‘নামহীন গোত্রহীন’, ‘কৃষ্ণপক্ষের দিন’। এ গল্পগুলোয় মুক্তিযুদ্ধকালীন থমথমে পরিস্থিতি, পরিণতি, নির্যাতন ইত্যাদির চিত্র পাওয়া যায়। আর ‘আটক’, ‘কেউ আসেনি’, ‘ফেরা’, ‘ঘরগেরস্থি’ গল্পে যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। ‘নামহীন গোত্রহীন’ গল্পগ্রন্থটির প্রথম প্রকাশ ঘটে ১৯৭৫ সালে। সাতটি গল্পে সমন্বিত মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত গ্রন্থটির গল্পগুলোয় মানুষের বিপর্যয়ের চরম দুর্দশার চিত্রটি অঙ্কন করা হয়েছে।
হাসান আজিজুল হকের প্রথম উল্লেখযোগ্য পুরস্কার আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৭)। তিনি ১৯৭০ সালে ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ লাভ করেন। ‘আগুন পাখি (২০০৬)’ উপন্যাস গ্রন্থের জন্য ২০০৮ সালে ওপারের মর্যাদাপূর্ণ ‘আনন্দ পুরস্কার’ লাভ করেন। ১৯৯৯ সালে দেশের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ ‘একুশে পদক’ পান। ২০১২ সালে তিনি আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং ২০১৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সন্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রি লাভ করেন। তাকে ২০১৯ সালে দেশের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ ‘স্বাধীনতা পুরস্কারে’ ভূষিত করা হয়।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কালজয়ী লেখক হাসান আজিজুল হকের প্রয়াণে শোকবার্তা দিয়েছিলেন। শোকবার্তা দিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। দু’বাংলার বিশিষ্টজনরাও শোকবার্তা দিয়েছেন। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করছেন। ওপারেও লেখালেখি হচ্ছে তাঁকে নিয়ে। পত্রপত্রিকাগুলোর একটি অংশ এখন হাসান আজিজুল হক নিয়ে। এতেই বোঝা যায়, দু’বাংলায় তাঁর জনপ্রিয়তা কেমন। ‘জীবন ঘষে আগুন’ বের করে মানুষকে আলোকিত করায় ব্রতী হয়েছিলেন তিনি।
এসইউ/জিকেএস
Advertisement