# রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের ঘাটতি ১১৬৯৬ কোটি# বেসরকারি ব্যাংকের ঘাটতি ৮১৩৭ কোটি# ব্যাংকিং কমিশন গঠনে পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
Advertisement
ঋণ পরিশোধে ব্যবসায়ীদের জন্য বিশেষ ছাড় দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। ছাড়ের মেয়াদ এখনো শেষ হয়নি। ফলে ঋণের কিস্তি পুরোপুরি পরিশোধ না করেও খেলাপি হওয়া থেকে অব্যাহতি পাচ্ছেন গ্রাহকরা। তবুও কমছে না ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ। উল্টো আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩৩ হাজার ৩৯৬ কোটি ১১ লাখ টাকা। ফলে উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে ব্যাংক খাত।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ সহনীয়। সেখানে দেশে খেলাপির হার ৯ শতাংশের বেশি। একইসঙ্গে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ (প্রভিশন) বা শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে অর্থসংস্থানে ব্যর্থ সরকারি-বেসরকারি খাতের অন্তত আটটি ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন তথ্য।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের অ-শ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে শূন্য দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। নিম্ন (সাব-স্ট্যান্ডার্ড) ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ। আর সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ প্রভিশন রাখার নিয়ম রয়েছে। মন্দ বা কুঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হয় শতভাগ (১০০ শতাংশ)।
Advertisement
আরও পড়ুন: খেলাপি ঋণের ৮৮ শতাংশই আদায় অযোগ্য!
সরকারি-বেসরকারিসহ সব ধরনের ব্যাংক যেসব ঋণ বিতরণ করে, তার গুণমান বিবেচনায় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) হিসেবে জমা রাখতে হয়। কোনো ঋণ শেষ পর্যন্ত মন্দঋণে (খেলাপি) পরিণত হলে তাতে ব্যাংক যেন আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে না পড়ে, সেজন্য প্রভিশন রাখার বিধান রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে প্রয়োজনীয় প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে আট ব্যাংক। এসব ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড, বেসিক ব্যাংক লিমিটেড, জনতা ব্যাংক লিমিটেড, রূপালী ব্যাংক লিমিটেড। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেড, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড, ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড। এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকার বেশি।
আরও পড়ুন: খেলাপি ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়লো
Advertisement
তবে বেশ কিছু ব্যাংক প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ প্রভিশন হিসাবে রেখে দেওয়ায় সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কমেছে। এক্ষেত্রে সার্বিকভাবে সেপ্টেম্বর শেষে পুরো ব্যাংক খাতে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ১৩ হাজার ৫২৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এর আগে জুন প্রান্তিক শেষে ৯ ব্যাংক প্রভিশন ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছিল। ওই ৯ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ছিল ১৮ হাজার ৯৩১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।
প্রভিশন ঘাটতিতে থাকা আট ব্যাংকের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ১১ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা। রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি রয়েছে বেসিক ব্যাংকের। সেপ্টেম্বর শেষে চরম নাজুক অবস্থায় থাকা এ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৫৬২ কোটি টাকা। এর পরেই রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড। অগ্রণী ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি তিন হাজার ৫২১ কোটি টাকা। এছাড়া রূপালী ব্যাংক লিমিটেডের প্রভিশন ঘাটতি তিন হাজার ১৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, জনতা ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ৫৯৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।
আরও পড়ুন: ৯ ব্যাংকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঘাটতি ১৮ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা
বেসরকারি খাতের চারটি ব্যাংক প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। এসব ব্যাংকগুলোর ঘাটতির পরিমাণ আট হাজার ১৩৭ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভিশন ঘাটতি ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের। এ ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ সাত হাজার ৪৭৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ঘাটতি ৩৪৪ কোটি ৬৮ লাখ, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ঘাটতি ১৭১ কোটি ১৫ লাখ টাকা, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ১৪৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।
চলতি ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ৮৮ হাজার ৬৮৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা। সেখানে সংরক্ষণ করা হয়েছে ৭৫ হাজার ১৫৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। ফলে সার্বিকভাবে নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি ১৩ হাজার ৫২৯ কোটি টাকা।
চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। সেই হিসাবে তিনমাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৯ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে (সেপ্টেম্বর ২০২১) খেলাপির ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ এক হাজার ১৫০ কোটি টাকা। হিসাব অনুযায়ী- এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৩৩ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন: খেলাপি ঋণ নিয়ে আইএমএফের উদ্বেগ
খেলাপি ঋণ নিয়ে ব্যাংক ও আর্থিকখাতের বিশ্লেষক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অর্থনীতিবিদ ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এখন অনেক ভুল সিদ্ধান্ত আসে। সেসব নীতিমালা ঋণ খেলাপিদের আরও উৎসাহিত করছে। বিপরীতে ভালোমানের গ্রাহকরা ঋণ পরিশোধে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। ব্যাংকগুলোও খেলাপি ঋণ আদায়ে বিমুখ হয়ে পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে এসব নিয়েও জবাবদিহিতা করতে হচ্ছে না।’
সাবেক এ গভর্নর আরও বরেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিগুলো হতে হবে দীর্ঘস্থায়ী। যাতে ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণ, পুনঃতফসিল, প্রভিশন ঘাটতি কমে আসে। এসব সমস্যা সমাধানে ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা উচিত। এর আগেও কমিশনের মাধ্যমে ঋণ খেলাপি সমস্যার সমাধান হয়েছে।’
ইএআর/এএএইচ/এএসএম