দেশজুড়ে

ডলার সংকটে কমেছে আমদানি, রপ্তানি শূন্যের কোটায়

ডলার সংকটের অজুহাতে দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে গত কয়েক মাসের তুলনায় ভারতীয় পণ্য আমদানি কিছুটা কমেছে। আর ভারতীয় কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, বন্দরের অব্যবস্থাপনার কারণে দিন দিন বাংলাদেশি বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি শূন্যের কোটায়। বাণিজ্যভিত্তিক এ বন্দর দিয়ে শুধু রপ্তানি খাতেই বছরে কোটি কোটি টাকা আয় করা সম্ভব বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

Advertisement

বন্দর সূত্রে জানা গেছে, ‘ভারত থেকে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো খাদ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বাংলাদেশে ব্যবস্থা থাকলেও ভারতের অভ্যন্তরে রপ্তানি পণ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং পণ্য রাখার সেটের কোনো ব্যবস্থা নেই।

ভারত থেকে যেসব পণ্য বাংলাদেশে আসে

বিভিন্ন ধরনের চাল, পাথর, পেঁয়াজ, জিরা, টিটাগুড়, গমের ভূসি, ভুট্টার বীজ, আদা, রসুন, আতাফল, মিক্সার মেশিন, মাটি খননযন্ত্র ভেকু মেশিন উল্লেখযোগ্য।

Advertisement

ভারতে রপ্তানি যোগ্যপণ্য

বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিযোগ্য পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে-কলা, পেঁয়াজের ফুলকা, আলুসহ সব ধরনের সবজি, পোশাক কারখানার ঝুট কাপড়, পাটের তৈরি বস্তা ইত্যাদি।

বন্দরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়েকদিন আগে বন্দর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ভারতীয় প্রায় ৪০০ ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করলেও এখন তা ২০০’র নিচে নেমে এসেছে। বিশ্ববাজারে ডলারের সংকটের কারণে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বিলাসবহুল পণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহিত করছেন। ফলে বন্দর দিয়ে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ভারত থেকে আমদানি করা হচ্ছে।

হিলি কাস্টমসের তথ্য মতে, গত পাঁচ বছরে ভারত থেকে ৯৫ লাখ ৬৮ হাজার মেট্রিক টন বিভিন্ন পণ্য আমদানি হয়েছে। যার আর্থিক মূল্য ১৩ হাজার ২৮৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকা, যা থেকে রাজস্ব আয় হয়েছে ১ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা। একই সময়ে এ বন্দর দিয়ে বাংলাদেশি বিভিন্ন পণ্য ভারতে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৭৪ হাজার ২ মেট্রিক টন। যার মূল্য ৫০৩ কোটি টাকা।

Advertisement

সরেজমিনে হিলি বন্দরে গিয়ে দেখা যায়, ‘হিলি সীমান্তের শূন্য রেখা দিয়ে ট্রাকবোঝাই ভারতীয় বিভিন্ন ধরনের পণ্য নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন। শূন্য রেখায় দাঁড়িয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা ট্রাকগুলো তল্লাশি ও কাস্টমসের কাজ শেষে অর্ধকিলোমিটার দূরে ভাঙা রাস্তা পেরিয়ে পানামা পোর্টের দুই নম্বর গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছেন।

বর্তমানে পানামা পোর্ট লিমিটেডের ২২ একর জায়গা চারটি গেট নিয়ে অবস্থান। রোববার ভারতীয় বিভিন্ন পণ্য নিয়ে বাংলাদেশে ১৭১টি ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

আমদানি রপ্তানির বিষয়ে জানতে চাইলে হিলি স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানি গ্রুপের সভাপতি হারুন উর রশিদ হারুন জাগো নিউজকে বলেন,‘ কিছুদিন আগের চেয় আমাদের আমদানিতে অনেকটা ছন্দপতন হয়েছে। এখন অনেকটা স্বাভাবিক কমে এসেছে। আবারও আমাদের ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে বিলাসবহুল পণ্য যেগুলো আমাদের এখন দরকার নেই সেই পণ্যগুলো নিরুৎসাহিত করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস যেমন- চাল, পেঁয়াজ, আদা, রসুন কিংবা গো-খাদ্য, মৎস্য খাদ্য এই পণ্যগুলো আমরা শর্তসাপেক্ষে আমদানি করতে পারবো। এরইমধ্যে আমাদের এই শর্তে এলসি চলমান।

তিনি বলেন, আগে আমাদের যে সব পণ্য বেশি পরিমাণে বাংলাদেশে আসত সেগুলো এখন আসছে না। কারণ অন্যান্য দেশের মতো ভারত বিলাসবহুল পণ্য আমদানিতে নিরুসাহিত করছেন। এরই মধ্যে তারা গম আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে, চিনির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

রপ্তানির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে আমরা বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করতে চাই কিন্তু ভারতীয় ব্যবসায়ীদের অনীহা, সদিচ্ছা ও সেখানে তাদের কর্তৃপক্ষ না থাকা এবং সেখানে সেটের ব্যবস্থা না থাকা ও উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ অফিস না থাকায় আমরা বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করতে পারছি না। আমরা শুধু আমদানি করে যাচ্ছি কিন্তু রপ্তানি এবেবারে নেই বললেই চলে।

তিনি বলেন, যদিও আমাদের হিলিতে একটা পাটকল রয়েছে সেই পাটের বস্তার ব্যাগ ভারতে রপ্তানি হচ্ছে কিন্তু হিলি দিয়ে হচ্ছে না। ট্রাকে মালগুলো বেনাপোল দিয়ে রপ্তানি করতে হচ্ছে, সোনামসজিদ দিয়ে রপ্তানি করতে হচ্ছে এতে আমাদের রপ্তানির খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করা যায় তাহলে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে অনেক ডলার আমরা বাংলাদেশে নিয়ে আসতে পারবো।

রাস্তা কোথাও বেহাল কোথাও সংস্কার শুরু

হিলি বন্দরের পানামা পোর্টের সামনে থেকে চারমাথা হয়ে ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট পর্যন্ত রাস্তাটি সর্বশেষ ২০১০ সালে সংস্কার করা হয়। ১২ বছর পর শূন্যরেখা থেকে পানামা পোটের গেট পর্যন্ত সংস্কার শুরু হয়েছে। প্রতিদিন ওই সড়কটি দিয়ে চার-পাঁচশ ভারতীয় ট্রাক পণ্য নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এছাড়া দেশীয় ট্রাক ও দূরপাল্লার যান চলাচলের মূল সড়ক এটিই।

কয়েকদিন আগে বন্দরের প্রধান সড়কটি নতুন করে চার লেনের কাজ শুরু হলেও চারমাথা থেকে উপজেলা পরিষদের প্রধান ফটকের সামনে দিয়ে রাজধানী মোড় পর্যন্ত একইভাবে এখানো বিছানো আছে ইট। রাস্তায় খানাখন্দের কারণে চারমাথা মোড় থেকে রাজধানী মোড় পর্যন্ত এখন ধুলোর শহরে পরিণত হয়েছে।

হিলি-জয়পুরহাট সড়কের শান্তি মোড়, রাজধানী মোড়, হিলি-দিনাজপুর সড়কের ফকিরপাড়া, হিলি-ঘোড়াঘাট সড়কের ডাঙ্গাপাড়া, জালালপুরসহ অনেক স্থানে ছোট বড় অসংখ্য গর্ত হয়েছে।

এছাড়া চারমাথা পোর্ট থেকে দক্ষিণে রাজধানী মোড় প্রধান সড়ক দিয়ে কোচ, বাসসহ পণ্যবাহী ট্রাক দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের জয়পুরহাট, বগুড়া, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিরাজগঞ্জ, ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামে যাতায়াত করে। বর্ষকালে এসব গর্তে পানি থাকলে বোঝা যায় না এর অবস্থা। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকায় ভয়ভীতি নিয়ে চলাফেরা করছে সব ধরনের যানবাহন। শুষ্ক মৌসুমে কষ্ট করে চলাচল করতে পারলেও বর্ষা মৌসুমে মানুষের ভোগান্তি পৌঁছায় চরমে।

ইজিবাইক চালক আমেদ আলী জাগো নিউজকে বলেন, আমি দীর্ঘদিন থেকে হিলি বাজারে ভ্যানগাড়ি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করি। কয়েক বছর ধরে রাস্তাঘাটের যে অবস্থা তাতে এখন জীবন চলা দায়। কয়দিন পর পর ভ্যানের এক্সেলেটর ভাঙে। যাত্রীরা গাড়িতে চড়তে চায় না। বুকের ব্যথা হয়।’

আমেদ আলী বলেন, শূন্যরেখা থেকে পানামা পোর্টের গেট পর্যন্ত রাস্তার কাজ শুরু হয়েছে। শেষ হলে অনেকটা ভোগান্তি কমে যাবে। জানতে চাইলে আমদানিকারক শাহিনুর রহমান শাহিন জাগো নিউজকে বলেন, হিলি স্থলবন্দর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর স্থলবন্দর। আমরা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অধিক পরিমাণে রাজস্ব দিয়ে থাকি। বর্তমানে বৈশ্বিক মন্দার কারণে আমাদের আমদানি অনেকটাই কমে গেছে। বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্য প্রয়োজনীয় পণ্যছাড়া ব্যাংকগুলো এলসি দিচ্ছে না। পাশাপাশি বিগত সময়ে এই বন্দর দিয়ে ফল আমদানি হতো কিন্তু এখন আমদানি শূন্যের কোটায়। এর মূল কারণ এনবিআর থেকে আমাদের একটি মার্ক করে দেওয়া আছে যে ছয় চাকার গাড়িতে ১৪ মেট্রিক টন এবং বারো চাকায় ১৮ মেট্রিক টন ফল আমদানি করতে হবে। এ রকম আমাদের ব্যারিয়ার তৈরি করে দিয়েছেন, যা আমদানির বিষয়ে এটি পরিপন্থি বলে মনে করছি। কারণ যারা ছোট আমদানিকারক ছয় চাকায় ৫ টন মাল আমদানি করতে পারেন এটি তাদের অধিকার, সেটাকে ব্যাহত করার কারণে এই তাজা ফল এই বন্দর দিয়ে আমদানি হচ্ছে না।

শহিনুর রহমান বলেন, উত্তরবঙ্গের মধ্যে হিলিতে মোটরসাইকেলের পার্সের একটি বাজার। এখানে ছোটবড় শতাধিক দোকান রয়েছে। এখানকার ১৫ জন আমদানিকারক রয়েছেন, যারা বেনাপোল দিয়ে মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশ আমদানি করছেন। বেনাপোলে যন্ত্রাংশগুলো আমদানি হচ্ছে কেজি হিসেবে। হিলিতে প্রতিটি যন্ত্রাংশ একেকটা কোট দিয়ে কাস্টমসের জটিলতার কারণে আমদানিকারকরা হয়রানির কারণে মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশ হিলি বন্দর দিয়ে আমদানি হচ্ছে না।

ভারতের বাজারে বাংলাদেশি অনেক পণ্যের চাহিদা রয়েছে। তবে ভারতের ওপারে কাস্টমসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা না থাকায় পণ্য রপ্তানির পরে ছাড় করতে অনেক বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। এ কারণেই মূলত বাংলাদেশি বিভিন্ন পণ্য রপ্তানিতে ব্যবসায়ীরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।

আমদানি কম হওয়ার কারণ জানতে চাইলে আমদানিকারক মাহাবুব আলম জাগো নিউজকে বলেন, ব্যাংক আপাতত শুধু খাদ্যপণ্যের ওপর এলসি দিচ্ছে। অন্য আইটেমগুলোতে এলসি দিচ্ছে না ডলার সংকটের কারণে। আমদানি কমাতে আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋণ করে ব্যবসার কাজে লাগিয়েছি। এতে আয় না আসায় আমাদের ব্যাংকের সুদের বোঝা টানতে হচ্ছে, লোকসান গুনতে হচ্ছে।

পণ্য খালাসে বন্দরের অভ্যন্তরীণ বিষয়টি জানতে চাইলে পানামা পোর্টের জনসংযোগ কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন প্রতাব মল্লিক জাগো নিউজকে বলেন, পানামা পোর্টের ভেতর আমদানি করা পণ্যগুলো খালাসের বিষয়ে কিছুদিন আগে আমরা একটু জটিলতায় ছিলাম। আগে ১০ একর জায়গা ছিল এখন ২২ একর জায়গায় অবস্থান করছি। নতুন করে একটা আলাদা স্থাপনা এবং একটি গেট তৈরি করেছি। চারটি গেটের মধ্যে একদিক দিয়ে ভারতীয় গাড়ি ঢোকে অন্যদিক দিয়ে বের হয়। একইভাবে বাংলাদেশি ট্রাকগুলো প্রবেশ ও বাহির হয়। এতে বন্দরের ভেতরের ট্রাকের জটের সমস্যা সমাধান হয়েছে।

পানামা পোর্টের কাঁচামালের ক্ষেত্রে ১৬টি সেট রয়েছে যাতে বৃষ্টির ভেতরেও এই সেটে কাজের কোনো সমস্যা না হয়। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০০ শ্রমিক কাস্টমসের ভেতর কাজ করেন। কাস্টমাররা দ্রুত পণ্য খালাস করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করতে পারে সেসব ব্যবস্থা পানামা পোর্ট নিয়ে রেখেছে।এসএইচএস/এএসএম