# ৮০-১০০ আসন দিয়ে বিরোধী দল হবে বিএনপি# সমঝোতাকারীদের বিরুদ্ধে বিএনপির ‘স্পষ্ট বার্তা’# সমঝোতা ছাড়া পথ নেই, বলছেন বিশ্লেষকরা
Advertisement
টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। ২০০৮ সালে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে দলটি। মাত্র ৩০ আসনে জিতে সেবার জাতীয় সংসদে বিরোধীদলের আসনে বসে বিএনপি। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আন্দোলন-সংগ্রামে ব্যর্থ বিএনপি ভোট বর্জন করলে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলেও বিএনপির ভরাডুবি হয়। টানা ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির নেতাকর্মী-সমর্থকরাও হতে থাকে নিষ্ক্রিয়। দীর্ঘদিন পর সম্প্রতি একটু চাঙা ভাব ফিরেছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোটের মাঠে শক্ত অবস্থান গড়তে যখন মরিয়া তখন দলটির বিরুদ্ধে উঠেছে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সমঝোতার গুঞ্জন। ছড়িয়েছে সমঝোতার পাঁচ দফাও।
‘ঈদের পর আন্দোলন’ নিয়ে কম সমালোচনার শিকার হতে হয়নি বিএনপির। যুগপৎ আন্দোলন নিয়েও তাই। সব আড়ষ্টতা ভেঙে ২০২৩ সালের অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে মাঠের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন পর সক্রিয় হয়েছে দলটি। চলমান বিভাগীয় গণসমাবেশে বেড়েছে কর্মীদের অংশগ্রহণ। চাঙা হয়ে উঠেছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও। দলটির নেতাকর্মীদের মনে বিশ্বাস জন্মেছে—আন্দোলনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরানো সম্ভব। আর সেটা করা গেলেই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচনে জিতে সরকার গঠনও করবে বিএনপি।
বিএনপির হাইকমান্ড থেকে তৃণমূল পর্যন্ত যখন এমন আশার বাণী ঘুরপাক খাচ্ছে, ঠিক তখনই গুঞ্জন ছড়িয়েছে সরকারের সঙ্গে গোপন ‘সমঝোতার’। শোনা যাচ্ছে, দলের শীর্ষ দুই নেতা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। তারা সরকারের পক্ষ থেকে সমঝোতার প্রস্তাব পৌঁছে দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে। লন্ডনে গিয়ে তারেকের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন মধ্যস্থতাকারী ওই দুই নেতা। এ নিয়ে খোদ দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
Advertisement
তবে এ নিয়ে আপাতত ‘টু-শব্দ’ না করার নির্দেশ দিয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। দলের দায়িত্বশীল নেতারা গণমাধ্যমে এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি। তবে প্রকাশ্যে বক্তব্য-বিবৃতিতে তারা বলছেন, সমঝোতার প্রশ্নই আসে না। রাজপথে আন্দোলন চলছে, রাজপথেই ফয়সালা হবে।
আরও পড়ুন: ১০ ডিসেম্বরের পর খালেদার কথায় দেশ চলবে: আমান
সূত্রমতে, গত সেপ্টেম্বরে লন্ডনে যান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এবং আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। সেখানে তারেক রহমানের সঙ্গে তারা বৈঠক করেন। বৈঠকে সরকারের পক্ষ থেকে সমঝোতার প্রস্তাব বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে উপস্থাপন করেন তারা। দুই দফা বৈঠকে আলোচনার পর পাঁচ দফার একটি প্রস্তাব তৈরি করা হয়।
‘সমঝোতা’ প্রস্তাবের পাঁচ দফা হলো—>> শেখ হাসিনাকে প্রধান রেখে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন।
Advertisement
>> সংসদের প্রতিনিধিত্বকারী সব দলের সমন্বয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন।
>> বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি।
>> দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৮০-১০০ আসনে ছাড় দিয়ে বিএনপিকে জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধীদলে রাখা।
>> সারাদেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে করা রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার।
সমঝোতার প্রস্তাব দেওয়া দুই নেতাকে ‘স্পষ্ট বার্তা’দলের স্থায়ী কমিটির দুই নেতা সমঝোতার প্রস্তাব চালাচালি করলেও ‘পথ খোলা নেই’ বলে বার্তা দিচ্ছেন বিএনপির শীর্ষ প্রভাবশালী নেতারা। দলের হাইকমান্ড থেকে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে এ ব্যাপারে স্পষ্ট বার্তাও দেওয়া হয়েছে। বিএনপির একটি বিশ্বস্ত সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
আরও পড়ুন: খালেদার কথায় দেশ তো দূরের কথা, বিএনপিই চলে না!
সমঝোতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় জাগো নিউজকে বলেন, ‘সমঝোতা বিষয় নয়, বিষয় হচ্ছে নিরপেক্ষ নির্বাচন। সরকার যদি সেই উদ্যোগ নেয়, নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করে, তারা পদত্যাগ করে, সংসদ বিলুপ্ত করে, তাহলে তো সেটা খোলা মাঠে করতে পারে। এখানে আলোচনা বা সমঝোতার মতো কিছু লাগে না।’
৮০ থেকে ১০০ আসনে সমঝোতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনা যদি বলেনও বিএনপিকে ১৬০ আসন দিয়ে দেবেন এবং আওয়ামী লীগ ১৪০ আসন নেবে, এটা দেওয়ার উনি কে? তিনি আমাকে একটা সিট দেওয়ার কে? উনি তো একটা মাত্র ভোটের মালিক। সিটের মালিক জনগণ। সুতরাং, উনি ওই কথা বলবেন কেন? আর আমি সেটা নিয়ে আলোচনা করবোই বা কেন? তাহলে আমি কি জনগণকে মানুষ মনে করি না? তাদের অধিকারে এবং ভোটে বিশ্বাস করি না?’
সমঝোতাকারী প্রসঙ্গে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘আমি জানি না গুরুত্বপূর্ণ এ ব্যক্তি কারা? এ অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিরা কেউ তো বলেন না যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে বা তারেক রহমানের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমরা অন্ধকারে হাঁটবো কেন?’
আরও পড়ুন: ১০ ডিসেম্বর বিএনপি বাড়াবাড়ি করলে ছাড় নয়
ওয়ান-ইলেভেনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এ নেতা বলেন, ‘দল আছে। কিন্তু সেদিন যারা বিপথগামী হয়েছিলেন, তারা হারিয়ে গেছেন। আমাদের নেতা বলেছেন, দেশ যাবে কোন পথে, ফয়সালা হবে রাজপথে। দলের নেতাকর্মী বা জনগণ অন্য কিছু আর বিশ্বাস করতে চান না।’
তবে সমঝোতা প্রক্রিয়ায় জড়িত বলে গুঞ্জন ছড়ানো বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তিনি দাবি করেন, ‘এগুলো সব এজেন্সির প্রচারণা।’
সমঝোতা প্রক্রিয়ায় যুক্ত বলে গুঞ্জন ছড়ানো আরেক নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীও এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘সমঝোতা কী? কার সঙ্গে সমঝোতা? সরকারের সঙ্গে সমঝোতা..? ইটস অ্যাবসলউটলি রাবিশ।’
আরও পড়ুন: আলোচনায় বিএনপির শূন্যপদ, আপাতত মনোযোগ ১০ ডিসেম্বরে
তিনি বলেন, ‘রাস্তায় আমরা সরকার পতনের আন্দোলন করছি। সেখানে কীসের সমঝোতা? প্রশ্নই ওঠে না। লাখ লাখ মানুষ আন্দোলন করছে। আর আমি সমঝোতা করবো। লোকজন তো শুনলে পিটিয়ে মেরে ফেলবে।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপ বা সমঝোতার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। দে মাস্ট লিভ…। তাদের (সরকার) চলে যেতেই হবে।’
সমঝোতা ছাড়া পথ নেই, বলছেন বিশ্লেষকরাবিএনপি নেতারা সমঝোতার গুঞ্জনকে ‘ভুয়া’ উল্লেখ করে উড়িয়ে দিলেও তাদের সামনে পথ নেই বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, রাজপথে ফয়সালা করার মতো শক্তি বিএনপির নেই। আবার আওয়ামী লীগও বিএনপি ছাড়া সংসদ কার্যকর করতে এবার হিমশিম খাবে। আন্তর্জাতিক মহলে এবার আর একতরফা নির্বাচন করে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না আওয়ামী লীগ। ফলে সমঝোতা ছাড়া কোনো পক্ষেরই পথ খোলা নেই বলে মনে করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: ১০ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ নয়, পালাবে বিএনপি
জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন খান মোহন বলেন, ‘আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হতে পারে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার জন্য এটা করতে চাইতে পারে। তারা নিজের ভাগ ঠিক রেখে অন্য দলগুলোকে যা দেওয়া দরকার, হয়তো তা ছেড়ে দেবেন। দুটি নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ চালিয়ে নিলেও বুঝেছে এবার বিএনপি না এলে আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না।’
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এবার নির্বাচনে বিএনপিকে নেওয়ার চেষ্টা করবে। তারেক রহমান যদি আওয়ামী লীগের প্রস্তাবে রাজি না হন, তাহলে বিএনপির বড় একটা অংশ সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশ নেবে। কারণ বিএনপি যে রাজপথে ফয়সালার কথা বলছে, সেটা করার মতো সাংগঠনিক শক্তি তাদের নেই।’
কেএইচ/এএএইচ/এএসএ/জিকেএস