ফিচার

হাতিয়া গণহত্যা: ইতিহাসের কালো অধ্যায়

জরীফ উদ্দীন

Advertisement

১৯৭১ সালে তৎকালীন বৃহত্তর রংপুর জেলার সবচেয়ে বড় গণহত্যা অনুষ্ঠিত হয় কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের বাগুয়া অনন্তপুর, রামখানা, নয়াদাড়া, নীলকণ্ঠ ও দাগারকুটি এবং পার্শ্ববর্তী বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের মন্ডলের হাট, যমুনা ও আশেপাশের গ্রামে। এতে প্রাণ হারায় ৭০০ এর বেশি নিরীহ, নিরস্ত্র গ্রামবাসী। প্রত্যন্ত অঞ্চলের ঘটনা হিসেবে জাতীয় পর্যায়ের গণমাধ্যমে নেই কোনো উল্লেখ ও আলোচনা। না হোক আলোচিত জাতীয় ইতিহাসে। তবুও লালিত হয় শহীদ স্বজন ও স্থানীয় মানুষের হৃদয়ে নিভু নিভু এ গণহত্যার দগদগে স্মৃতি। পরবর্তীতে অনেকেই এগিয়ে এসেছেন এ ইতিহাস রচনায়।

একাত্তরে কুড়িগ্রামবাসীর ভূমিকা ছিল অনন্য। মুক্তিযুদ্ধে কুড়িগ্রামের রৌমারীতে গড়ে তোলা হয় মুক্তাঞ্চল। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মুক্তিযোদ্ধারা এসে ঘাঁটি গড়ে লড়াই করেন পাকিস্তানিদের সঙ্গে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে বারবার পর্যুদস্ত হতে থাকে। অপরপক্ষে মুক্তিযোদ্ধারা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, কোনোভাবেই যেন হানাদার বাহিনী ঢুকতে না পারে। রাজাকারদের মাধ্যমে এ খবর পায় পাকিস্তানিরা। বিশেষ করে চিলমারী আক্রমণের পর থেকে পাকহানাদার বাহিনী ও তার দোসর রাজাকার, আল-বদর খুঁজতে থাকে কোথায় অবস্থান করছে মুক্তিবাহিনী। সেইসঙ্গে প্রস্তুতি নেয় বিস্তীর্ণ অঞ্চল আক্রমণের। তাদের ধারণা, উলিপুর হাতিয়া ও বুড়াবুড়ি এবং চিলমারীতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান ঘাঁটি। পাকিস্তানি বাহিনী এ ঘাঁটি নির্মুল করতে উন্মাদ হয়।

১৯৭১ সালের ১২ নভেম্বর। শুক্রবার। ২২ রমজান। ট্রেন যোগে পাঁচশর মতো বর্বর পাকিস্তানি সৈন্য উলিপুরের উদ্দেশে রওনা দেয় কুড়িগ্রাম থেকে। পথিমধ্যে ৩ ভাগ হয়ে হাতিয়ার দিকে যাত্রা করে তারা। রাত দ্বিপ্রহর অর্থাৎ ১৩ নভেম্বর, ২৩ রমজান, শনিবার। গ্রামের বেশিরভাগ ধর্মপ্রাণ মানুষ সেহরি খেয়ে ঘুমিয়েছেন, কেউ নিচ্ছেন ঘুমানোর প্রস্তুতি। একটু পরেই মসজিদ থেকে ভেসে আসে সুমধুর আজানের ধ্বনি। নামাজের প্রস্তুতি নিতে অজু সেরে অনেকে মসজিদে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে পা বাড়িয়েছেন। কেউ কেউ পৌঁছেছেন মসজিদে। ঠিক সে সময়েই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার বাহিনীরা ঘিরে ধরে হাতিয়ার গ্রামগুলো। তারপর মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে থাকে আর চালাতে থাকে তাণ্ডব। অনন্তপুর বাজারে এসে উচ্চস্বরে বলতে থাকে, ‘জ্বালাও, আগ লাগাও, কাহাহে মুক্তি, খোঁজো।’

Advertisement

সহজ-সরল নিরীহ মানুষগুলো কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনী মিলে গ্রামের বাড়ি-ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। চলতে থাকে লুটপাট ও নির্যাতন। বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণে মানুষ জীবন বাঁচাতে পার্শ্ববর্তী ধানক্ষেত, ঝোঁপ-ঝাড়ে শুয়ে জীবন রক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। জীবন বাঁচাতে অনেকে ঝাঁপ দেন ধরলায়। তবুও রক্ষা পান না তারা। নারকীয় হত্যাযজ্ঞ থেকে সেদিন মায়ের কোলের শিশুও রক্ষা পায়নি। কেড়ে নিয়ে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়। রক্ষা পাননি তাদের লালসা থেকে অগণিত মা ও বোন। পালিয়ে বাঁচতে যাওয়া অসহায় মানুষের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা মুহূর্তেই শেষ হয়ে যায়। তাদের খুঁজে খুঁজে ধরে পিঠমোড়া করে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় দাগারকুঠির এক স্থানে। তারপর সারিবদ্ধ করে গুলি করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। তাদের আর্তচিৎকারে ভারী হয় আকাশ-বাতাস। রক্তে লাল হয় ধরলা ও ব্রহ্মপুত্রের স্রোত। দিনব্যাপী চলে হানাদার বাহিনীর হত্যা আর অগ্নিসংযোগ।

নারকীয় এ হত্যাকাণ্ড থেকে বাবর আলী তার পরিবার নিয়ে পালাতে গিয়ে ধরা পড়েন পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে। ঘরে টাঙানো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিতে গুলি করে ছবিটি মাটিতে ফেলে বুট দিয়ে লাথি মারে মিলিটারিরা। পরে সারিবদ্ধ অনেকের সঙ্গে তাকেও গুলি করা হয়। বামহাত ও বুকে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। রাত ১১টায় গ্রামবাসী তাকে উদ্ধার করে চিকিৎসায় পাঠান। তিনি সুস্থ হয়ে ফিরলেও ফেরেননি তার ভাই আব্দুল ওহাব ও জোবেদ আলী। তাদের মা শোক-দুঃখে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে দেড় বছর পর মারা যান। স্বামীসহ শুয়ে ছিলেন আমেনা বেওয়া। তার চোখের সামনে থেকে স্বামীকে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। লুট করে নিয়ে যায় তাদের গোয়ালের গরু। বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যান কামাল হোসেন, বাবা বাবর উদ্দিন, চাচা বক্তার আলী ও দাদা শাহাদুল হককে। গলা, হাত ও বুকে গুলি খেয়ে কামাল প্রাণে বেঁচে গেলেও বাঁচেননি তার স্বজনেরা।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পা ধরেও জুলেফ বেওয়া রক্ষা করতে পারেননি স্বামী ও তিন দেবরকে। চোখের সামনে স্বামী ও দেবরকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। কচভান বেওয়ার যুবক স্বামীকেও হত্যা করে পাকিস্তান বাহিনী। রামখানা গ্রামের কিশোর আব্দুর রহমান পালিয়ে বাঁচলেও বাঁচেনি তার পরিবারের ৮ সদস্য। এভাবে দশ ঘণ্টাব্যাপী নজিরবিহীন গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালিয়ে ৬৯৭ কিংবা তারও বেশি জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি নরখাদকেরা। এরপর পাকিস্তানিরা এলাকা ত্যাগ করে রেখে যায় লাশের স্তূপ। রক্তে ভেসে যায় ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র। চারদিকে পোড়া লাশের গন্ধে ভারি হয় বাতাস। শহীদদের গণকবর দেওয়া হয়।

১৯৭১ সালে উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় হত্যাকাণ্ড ‘হাতিয়া গণহত্যা’। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও আজও রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। হত্যাকাণ্ডে শিকার পরিবার পায়নি রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা। ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে আইসিটিবিডি মিসকেস ০১/২০২০, উলিপুর থানার জিডি নং ৩৪৭ এর আওতায় হাতিয়া গণহত্যাসহ অন্যান্য যুদ্ধ অপরাধের জন্য ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে মারা গেছেন ২ জন। বর্তমানে বিচার চলছে তাদের।

Advertisement

ইতোমধ্যে স্থানীয়ভাবে দিবসটি নানা কর্মকাণ্ডে পালন করা হলেও নীরবে মুছে যাচ্ছে ইতিহাসের পাতা থেকে। বর্তমান প্রজন্ম জানে না বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তর এ গণহত্যা সম্পর্কে। আগামী প্রজন্মকে এ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানাতে হাতিয়ায় স্মৃতিস্তম্ভের পাশে শহীদদের নামফলক স্থাপনসহ ১৩ নভেম্বর দিনটিকে জাতীয়ভাবে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের ব্যবস্থা নেওয়া এবং শহীদ পরিবারকে আর্থিকভাবে সহায়তা করা সময়ের দাবি।

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক।

এসইউ/জিকেএস