দেশজুড়ে

কোমর তাঁতে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন পাহাড়ের ৭০ নারী

পাহাড়ি নারীদের কোমর তাঁতে তৈরি থামি, পিনন, ওড়না, গামছা বা চাদর জায়গা করে নিয়েছে সমতলেও। এ শিল্পকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে পাহাড়ের পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থা। তবে বাণিজ্যিক উদ্যোগে নয়, পাহাড়ি নারীরা স্ব-উদ্যোগে বাঁচিয়ে রেখেছেন এ শিল্পকে।

Advertisement

এদিকে, সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এসব নারীদের বোনা কাপড়ের লাভের একটি বড় অংশ চলে যায় দাদন ব্যবসায়ীদের পকেটে। ফলে তাদের আর্থিক দৈন্যদশা আর পিছু ছাড়ে না। এমন অবস্থায় পাহাড়ি নারীদের আর্থিক সংকটের বিষয়টি জানতে পেরে তাদের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন গাজীপুর সরকারি মহিলা কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ প্রফেসর ফেরদৌসী পারভীন। তার উদ্যোগে এখন পাহাড়ের ৭০ নারী স্বাবলম্বী।

কোমর তাঁতের সঙ্গে জড়িত পাহাড়ি নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বছরের পর বছর ধরে তারা এ কাজ করলেও আর্থিক সংকটে নিজেরা সুতা কিনতে পারেন না। ফলে মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছ থেকে দাদনে টাকা নিয়ে সুতা কিনতে হয়। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পরিশ্রম করলেও লাভের বড় অংশ চলে যায় দাদন কারবারিদের পকেটে।

খাগড়াছড়ি ঘুরতে এসে পাহাড়ের কোমর তাঁতের সঙ্গে জড়িত নারীদের আর্থিক সংকটের বিষয়টি জানতে পারেন গাজীপুর সরকারি মহিলা কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ প্রফেসর ফেরদৌসী পারভীন। পরে তার মানবিক সহযোগিতায় দাদনে সুতা এনে থামি-ওড়না বানানো ৭০ নারীর জীবন বদলে গেছে।

Advertisement

কেবল এই ৭০ নারীই নয়, এর আগেও তিনি তার ঢাকার কিছু সুহৃদের সহযোগিতায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ২০ জন প্রশিক্ষিত নারীকে সেলাই মেশিন দিয়েছেন। খাগড়াছড়ির মধুপুর এলাকার এক নারীকে দোকান করে দিয়েছেন। যার মাধ্যমে তিনিও আজ স্বাবলম্বী।

ফেরদৌসী পারভীন ব্যক্তিগত উদ্যোগে দুই দফায় চেলাছড়া, গাছবান ও খাগড়াপুরের ৭০ পাহাড়ি নারীকে পাঁচ কেজি করে সুতা দিয়েছেন। তার সহযোগিতায় বদলে গেছে ৭০ পাহাড়ি নারীর অর্থনীতির চাকা। প্রফেসর ফেরদৌসী পারভীনের দেওয়া সুতায় থামি-ওড়না বুনে আর্থিক সচ্ছলতা পেয়েছের এসব নারীরা। থামি বিক্রির টাকায় কেউ কেউ শুকর পালন করে বাড়তি আয় করছেন। একসময় অভাব-অনটনের সঙ্গে লড়াই করা ৭০ পাহাড়ি নারী হয়ে উঠেছেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা।

উপকারভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছর ৪০ জনকে এবং চলতি বছর ৩০ জন নারীকে থামি-পিনন ও ওড়না বোনার জন্য সুতা দিয়েছেন ফেরদৌসী পারভীন। তিনি যে সুতা দিয়েছেন তা দিয়ে প্রতিজন ৮/৯ সেট থামি-ওড়না বানাতে পারেন। যার প্রতি সেটের পাইকারি মূল্য তিন থেকে চার হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে আবার সুতা কিনে থামি-ওড়না তৈরির পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচও যোগান দিচ্ছেন তারা।

এক সময় সুতা দাদন নিয়ে থামি, পিনন ও ওড়না তৈরি করা চেলাছড়ার বাসিন্দা সুজিতা ত্রিপুরা বলেন, বছরের পর বছর ধরে কোমর তাঁতের মাধ্যমে থামি, পিনন ও ওড়না তৈরি করলেও পরিবার নিয়ে অতিকষ্টে দিন কাটতো আমাদের। আমাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনে পারভীন ম্যাডাম পাশে দাঁড়িয়েছেন। তার সহযোগিতার কারণে থামি বিক্রির টাকায় আবারও সুতা কিনেছি। পাশাপাশি থামি বিক্রির টাকায় শুকুর কিনেছি। এখন আমার পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে।

Advertisement

আরেক সংগ্রামী নারী রমিতা ত্রিপুরা বলেন, প্রফেসর ফেরদৌসী পারভীনের সহযোগিতার কারণে আমি নিজেই থামি বাজারে বিক্রি করে থাকি। থামী তৈরি করে যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে আমরা সংসার চালাই।

রূপসী ত্রিপুরা বলেন, ম্যাডামের কাছ থেকে সুতা পাওয়ার পর আমাদের দিন বদলে গেছে। আমরা এখন নিজেরই কাপড় বোনার পর ভালো দামে বিক্রি করতে পারি।

তিনি বলেন, একটি থামির কাজ শেষ হতে চার থেকে সাত দিন সময় লাগে। ভালোমানের একটি থামি বিক্রি করে তিন থেকে চার হাজার টাকা আয় করা যায়।

উপকারভোগী অঞ্জু ত্রিপুরার কলেজ পড়ুয়া মেয়ে মিমি ত্রিপুরা বলেন, পারভীন ম্যাডামের দেওয়া সুতা দিয়ে আমার মা থামি তৈরি করে বাজারে বিক্রি করেন। থামি বিক্রির টাকা দিয়েই আমাদের সংসার ও লেখাপড়ার খরচ চলে। আমরা আগের তুলনায় অনেক ভালো আছি।

পাহাড়ি নারীরা যুগ যুগ ধরে কোমর তাঁতে অভ্যস্ত। সব নারীরাই কাপড় বুনতে পারলেও আর্থিক সংকটের কারণে বিভিন্নজনের কাছ থেকে দাদন নিয়ে কাপড় বুনতে হয়। ফলে তারা পরিশ্রম করলেও লাভের মুখ দেখেন না। এমনটাই বললেন পাহাড়ের নারী উদ্যোক্তা বীনা ত্রিপুরা। তিনি বলেন, এমন সংকটে ফেরদৌসী পারভীন ম্যাডাম পাহাড়ে কোমর তাঁতের সঙ্গে জড়িত ৭০ জন নারীকে পাঁচ কেজি করে সুতা দিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। তার সহযোগিতায় পিছিয়ে পড়া ৭০টি পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা ফিরেছে।

শিক্ষকতা জীবনে সামর্থ্য অনুযায়ী ছাত্রছাত্রীদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ানোর কথা জানিয়ে প্রফেসর ফেরদৌসী পারভীন বলেন, অবসর গ্রহণের পর সমাজের অবহেলিত নারীদের জন্য কিছু করার ইচ্ছা জাগে। আমি পাহাড় পছন্দ করি বলেই খাগড়াছড়ি ঘুরতে যাই। সেখানেই আমার পূর্বপরিচিতদের মাধ্যমে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর এসব নারীদের সঙ্গে পরিচয় হয়। জানতে পারি পুঁজির অভাবে তারা তাদের ঐতিহ্যবাহী কোমর তাঁতে কাপড় বুনতে পারে না। তখনই তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি।

তিনি আরও বলেন, মানুষের জন্য কিছু করতে পারার মধ্য সুখ আছে। আত্মতৃপ্তি আছে। কিছু পাওয়ার জন্য নয় পিছিয়ে পড়া এসব নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার পথকে সুগম করতেই তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। পাঁচ কেজি সুতায় একটি পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে, তারা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছে এটাই আমার বড় প্রাপ্তি।

ভবিষ্যতেও পাহাড়ের পিছিয়ে পড়া নারীদের কল্যাণে কাজ করার আগ্রহের কথা জানান তিনি।

এমআরআর/জেআইএম