সাহিত্য

হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তা প্রসঙ্গে

রিপন আহসান ঋতু

Advertisement

হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন দু’হাতে। তার গ্রন্থের সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়ে গেছে। তিনি লিখেছেন উপন্যাস ও ছোটগল্প, নাটক ও রম্যরচনা, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি ও শিশুতোষ রচনা। নির্মাণ করেছেন অসংখ্য টিভি নাটক ও সিনেমা।

প্রথম প্রথম সমালোচকেরা তাঁর অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। তারপর তারা তাঁর ত্রুটি ধরতে নেমে পড়েছেন। হুমায়ূন আহমেদের বিরুদ্ধে তাদের যে অভিযোগগুলো ছিল; হুমায়ূন বেশি লেখেন, তাতে তার লেখার মান পড়ে যায়। হুমায়ূন কেবল গল্প বলেন, দেশ ও সমাজের প্রতি তার কোনো অঙ্গীকার নেই। আবার কেউ কেউ বলেন, হুমায়ূন আহমেদ বেশি লেখেন বলেই হুমায়ূন বড় বেশি জনপ্রিয়, তার মানে তার লেখায় গভীরতা নেই।

এ প্রসঙ্গে একটি গল্প বলা যেতে পারে, হুমায়ূন আহমেদ একবার বাংলা সাহিত্যের এক অধ্যাপককে একটি গল্প পড়তে দেন তার মতামত জানার জন্য। অধ্যাপক স্বীকার করেন, গল্পটা মন্দ নয়, তবে, তাঁর মতে, এতে গভীরতা কম। পাণ্ডুলিপিটা পকেটে ভরতে ভরতে হুমায়ূন আহমেদ তাকে বলেছিলেন, ‘গল্পটা মানিক বন্দ্যোপাধায়ের। আমি শুধু চরিত্রের নাম পাল্টে কপি করে দিয়েছি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় যখন গভীরতার অভাব; তখন আমার লেখা অগভীর হলে আমার দুঃখ নেই।’

Advertisement

অনেককে দেখি সাহিত্যে জনপ্রিয়তাকে স্বীকার করতে চান না। তবে হ্যাঁ, এটা ঠিক যে সাহিত্যে জনপ্রিয়তা শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র মাপকাঠি নয়, তবে জনপ্রিয়তা কিন্তু লেখকের একটি শ্রেষ্ঠ অর্জন; এটাও মানতে হবে।

বাংলা সাহিত্যে অনেকে হুমায়ূন আহমেদকে অস্বীকার করতে চাইলেও হুমায়ূন আহমেদ নিজে কিন্তু কখনো তার পূর্বসুরিদের অস্বীকার করেননি। তার প্রমাণ অগ্রজদের রচনার নাম দিয়ে তিনি বইয়ের নাম রেখেছেন, জীবনানন্দ দাশের ‘দারুচিনি দ্বীপ’ কিংবা ‘যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ’ মনে পড়ে।

তিনি সবচেয়ে বেশি বইয়ের নাম নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ থেকে; ‘আগুনের পরশমণি’, ‘আমার আছে জল’, ‘এই আমি’, ‘চক্ষে আমার তৃষ্ণা’, ‘চলে যায়’, ‘তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে’, ‘দিনের শেষে’, ‘দূরে কোথায়’, ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’—এরকম আরও অনেক বইয়ের নাম তিনি তাঁর প্রিয় অগ্রজদের কাছ থেকে নিয়েছেন।

এখন প্রশ্ন করা যেতেই পারে, হুমায়ূন আহমেদ আসলে কেমন লেখক? হুমায়ূন আহমেদ এমন একজন লেখক, যিনি তাঁর গল্প উপন্যাসে মানুষের চিরচেনা জগৎ-সংসারকে ঠিকঠাক তুলে ধরতে পেরেছেন। আমাদের নাগরিক মধ্যবিত্তের যে জীবন তিনি দেখেছেন, তিনি সেই জীবনকেই উপস্থাপন করেছেন। কথাসাহিত্যের প্রধান কাজই তো মানুষের সেই জীবনকে তুলে ধরা, যেটা পড়ে তাকে মুহূর্তের মধ্যে স্পর্শ করবে।

Advertisement

আমরা হুমায়ূন আহমেদের এমন অসংখ্য সৃষ্টির কথা বলতে পারি। সাধারণ মানুষকে কত দারুণভাবে স্পর্শ করেছিল তার প্রমাণ ‘এইসব দিনরাত্রি’ নাটকের শফিক চরিত্রে বুলবুল আহমেদ, রফিক চরিত্রে আসাদুজ্জামান নূর আর নীলু ভাবি চরিত্রে ডলি জহুর তখন সবার কাছে ভীষণ জনপ্রিয়। ছোট্ট টুনির মৃত্যুর মাধ্যমে ধারাবাহিকটি শেষ করেন হুমায়ূন আহমেদ। পরদিনই প্রেস ক্লাবের সামনে টানানো হলো ব্যানার, ‘টুনির কেন মৃত্যু হলো, হুমায়ূন আহমেদ জবাব চাই’।

হুমায়ূন আহমেদের নাটকের চরিত্রের জন্য রাজপথে মিছিল করার মতো ঘটনা তো একাধিকবার দেখা গেছে। ‘বাকের ভাইয়ের কিছু হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’ স্লোগানের মিছিলটি কোনো রাজনৈতিক দলের ছিল না। হুমায়ূন আহমেদের ধারাবাহিক নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’র প্রধান চরিত্র বাকের ভাইকে ফাঁসি না দেওয়ার দাবি জানিয়ে এই স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল।

নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে হুমায়ূন আহমেদ লেখেন ধারাবাহিক ‘কোথাও কেউ নেই’। এ নাটকের প্রধান চরিত্র বাকের ভাইকে বাঁচানোর দাবিতে মিছিল, দেওয়াল লিখন ও সমাবেশ হয়েছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত গল্পের যবনিকা টানতে গিয়ে বাকের ভাইকে ঝুলতে হলো ফাঁসিতে। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি এখনো মেনে নিতে পারেননি অনেকে। অতএব হুমায়ূন আহমেদকে কেমন লেখক বলতে পারি, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

তাঁর ছোটগল্প নিয়ে প্রচুর কথা বলা উচিত। ছোটগল্পগুলোয় হুমায়ূন আহমেদ অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ছিলেন। যেহেতু তাঁর মন পড়ে থাকতো সাধারণ মানুষের জীবনে। এসব সাধারণ মানুষ নিতান্তই সাধারণ একজন গৃহকর্মী, একজন স্কুলশিক্ষক, একজন কথাপ্রিয় গুণীন, একজন দরিদ্র বাবা। তাদের জীবনের গল্পগুলোও সাধারণ—সেগুলোর পেছনে কোনো ঘটনার ডামাডোল ছিল না। অথচ ওই সামান্য গল্পগুলোই শুধু বলার কুশলতার জন্য একটা মহাকাব্যিক ব্যাপ্তি পেতো।

হুমায়ূন আহমেদের গল্প, উপন্যাস, নাটক, সিনেমার যথার্থ মূল্যায়ন ভবিষ্যতে একসময় অবশ্যই হবে। কেন তিনি এত জনপ্রিয় হয়েছিলেন, কেন তাঁর তিরোধানে সারাদেশের অসংখ্য মানুষ শোকাতুর হয়েছিল; সেই রহস্যও একদিন উদঘাটিত হবে। আরও সংক্ষপ্তি করে যদি বলি, হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব, তিনি শিল্পমাধ্যমের তিনটি ক্ষেত্রেই দারুণভাবে সফল। সাহিত্য, টিভি নাটক ও চলচ্চিত্রে তিনি একটা শক্তিশালী মাত্রা যোগ করতে পেরেছেন। এ তিনটি মাধ্যমেই তিনি অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। যেখানে একটি আরেকটিকে অতিক্রম যেমন করেনি; তেমনি একটি অপরটির পরিপূরকও হয়ে ওঠেনি।

প্রকৃত সৃষ্টিশীল মানুষের মধ্যে একটা খেয়ালি ভাব থাকে, যেটা হুমায়ূন আহমেদের ব্যক্তিজীবনের নানা আচরণের মধ্যে স্পষ্ট ছিল। হুমায়ূন আহমেদের মধ্য একটা বাউল এবং বোহেমিয়ান বাস করত, যাকে আমি ভীষণ উপভোগ করতাম। কারণ এই পৃথিবীতে সবাই পাগলামো করতে পারে না, কেউ কেউ পারে। যাদের সংখ্যা হাতে গোনা যায়। আমি আসলে আমৃত্যু এই হাতে গোনা মানুষদেরই ভালোবাসতে চাই।

লেখক: কথাসাহিত্যিক।

এসইউ/এমএস