একসময় গ্রামাঞ্চলের পথে-ঘাটে, আনাচে-কানাচে ও বাঁধের রাস্তায় কোনো ধরনের পরিচর্যা ছাড়াই বেড়ে উঠতো কাঁটা বেগুনের গাছ। এ গাছে অতিরিক্ত কাঁটা থাকায় একে কাঁটা গাছ বলা হয়। এ গাছকে এক ধরনের আগাছা বলা চলে। তবে এ গাছকে এখন কাজে লাগিয়ে গ্রাফটিং (কাটিং কলম) পদ্ধতিতে টমেটো চাষ শুরু করেছেন চাষিরা।
Advertisement
কৃষক জহুরুল ইসলাম বাদল নওগাঁর রানীনগর উপজেলার শিয়ালা গ্রামের বাসিন্দা। তিনি গ্রাফটিং (কাটিং কলম) পদ্ধতিতে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ করে সফলতা পেয়েছেন। প্রতিকেজি টমেটো পাইকারী ১১০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। আধুনিক এ পদ্ধতিতে টমেটো চাষ করায় এলাকায় বেশ সাড়া পড়েছে। এ পদ্ধতিতে টমেটো চাষ দেখতে অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করছেন। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে এ পদ্ধতিতে টমেটো চাষ করতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
কৃষিতে ভিন্নতা আনতে এবং লাভবান হতে নতুন পদ্ধতিতে চাষাবাদে আগ্রহ কৃষক জহুরুলের। নিজের তিন বিঘা জমি থাকলে ইজারা ও বর্গা নিয়ে প্রতিবছর প্রায় ১০-১২ বিঘা জমিতে ধানের পাশাপাশি বিভিন্ন শাক-সবজির আবাদ করেন। এ বছর ইন্টারনেট দেখে আগাম গ্রীষ্মকালীন সবজি হিসেবে কাঁটা বেগুনের গাছের সঙ্গে টমেটো গাছকে গ্রাফটিং (কাটিং কলম) পদ্ধতিতে চাষ করেছেন।
এ পদ্ধতিতে টমেটো চাষের ফলে গোড়া সহজে পচে না। বেশি খরা, বৃষ্টি সহিষ্ণু এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি হওয়ায় গাছটি দীর্ঘজীবী হয়। ফলে দীর্ঘসময় ফল পাওয়া যায়। এ ছাড়া মালচিং পদ্ধতিতে চাষ করায় জমিতে সার দিতে হয় না। প্রতি সপ্তাহে একবার করে জমিতে সেচ দিতে হয়। বর্তমানে প্রতিদিন ক্ষেত থেকে ৫০-৬০ কেজি টমেটো সংগ্রহ করা হচ্ছে।
Advertisement
কৃষক জহুরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘পড়াশোনা করেছি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। দীর্ঘদিন থেকে সচরাচর পদ্ধতিতে সবাই যেভাবে চাষাবাদ করে সেভাবেই আবাদ করা হয়। এভাবে আবাদ করা গেলেও দাম পাওয়া যেত না। সে চিন্তাধারা থেকেই কৃষিতে ভিন্নতা আনতে নতুন পদ্ধতিতে চাষাবাদের আগ্রহ বাড়ে আমার।’
তিনি জানান, ১২ কাঠা জমিতে হালচাষ করে সার-ওষুধ দিয়ে প্রস্তুত করে মালচিং পদ্ধতিতে সেড তৈরি করা হয়। গত শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি (আগস্ট) সময়ে জমিতে কাঁটা বেগুনের চারা রোপণ করা হয়। এর ১৫ দিন পর রোপণ করা হয় বারি-৪ জাতের টমেটোর বীজ। টমেটোর গাছ বড় হওয়ার ১৫ দিন পর গ্রাফটিং (কাটিং কলম) পদ্ধতিতে কাঁটা বেগুনের গাছের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। গাছ লেগে যাওয়ার পর কাঁটা বেগুনের গাছের ওপরের অংশ কেটে গোড়ার অংশ রেখে দেওয়া হয়।
জহুরুল জানান, গাছের বয়স ২ মাস হলে ফল আসা শুরু হয়। পাইকারী ১১০ টাকা কেজিতে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। এরই মধ্যে প্রায় লক্ষাধিক টাকার টমেটো বিক্রি হয়েছে। আরও প্রায় লক্ষাধিক টাকার মতো বিক্রির আশা। এ পদ্ধতিতে প্রায় ৮ মাস ফলন পাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। অনেকেই এ পদ্ধতিতে টমেটো চাষ দেখতে এবং পরামর্শ নিতে আসছেন।
পতিত জমিতে বস্তায় আদা রোপণেও সাড়া ফেলেছেন তিনি। ৬ কাঠা জমিতে ১ হাজার ৬০০ বস্তায় আদার গাছ আছে। উঁচু-নিচু জায়গা হওয়ায় সেখানে কোনো ফসল হতো না। অনাবাদি পড়ে থাকতো। সেখানে বালি, মাটি ও জৈব সার মিশিয়ে প্রায় ১৫-২০ দিন ফেলে রাখা হয়। এরপর প্লাস্টিকের বস্তায় অর্ধেক পরিমাণ এ উপকরণ ভরে প্রতিবস্তায় তিন পিস করে আদা রোপণ করা হয়। সবকিছু দিয়ে প্রতিবস্তায় খরচ পড়ে ২২ টাকা।
Advertisement
আদা হতে ৬-৭ মাস সময় লাগে। এতে রোগবালাই কম হয়। আগামী একমাস পর আদা তোলা হবে। আশা করা যায়, প্রতিবস্তা থেকে সর্বোচ্চ ২ কেজি আদা পাওয়া যাবে। বাজারে দেশি আদার দামও ভালো। ৯০-১০০ টাকা কেজি। প্রায় দেড় থেকে ২ লাখ টাকার আদা বিক্রির আশা করা যায়।
স্থানীয় কৃষক এমদাদুল হক বলেন, ‘আমরা সাধারণ পদ্ধতিতে টমেটো চাষ করি। এ বছর দেখছি জহুরুল ভাই কাঁটা গাছে কলম করে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ করেছেন। এ পদ্ধতিতে টমেটো চাষ করে আগাম বাজারে উঠিয়ে ভালো দাম পেয়ে লাভবান হচ্ছেন। গাছে প্রচুর টমেটো ধরেছে এবং রোগবালাইও কম। যদি কৃষি অফিস থেকে পরামর্শ ও সহযোগিতা করা হয়, তাহলে আগামীতে আমরাও টমেটোসহ অন্য আবাদে উদ্বুদ্ধ হবো। এমনকি বস্তায় আদা লাগিয়েও তিনি সাড়া ফেলেছেন।’
রানীনগর উপজেলা কৃষি অফিসার মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘উপজেলায় আগাম ৩০০ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ করা হয়েছে। কৃষি অফিস থেকে ইতোমধ্যে আধুনিক পদ্ধতিতে সবজি চাষাবাদ করতে ৪০ জন কৃষককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। আগামী বছর থেকে অনেকেই আগাম সবজি চাষ করবেন। এ পদ্ধতিতে কৃষকদের মাঝে আধুনিক পদ্ধতিতে ভিন্নমাত্রায় চাষাবাদে আগ্রহ বাড়ানো গেলে অফসিজনে যেমন চাষাবাদ বাড়বে; তেমনই লাভবান হতে পারবেন চাষিরা।’
নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় ৬ হাজার ৭১৫ হেক্টর জমিতে গ্রীষ্মকালীন শাক-সবজি রোপণ করা হয়। যেখানে ১ লাখ ২৩ হাজার ৬১৫ মেট্রিক টন উৎপাদিত হবে।
আব্বাস আলী/এসইউ/জেআইএম