বিনোদন

গানের হুমায়ূন সুরের হুমায়ূন

কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ বাংলাসাহিত্যে স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে আছেন। তেমনি চলচ্চিত্র স্রষ্টা হিসেবেও এদেশের সিনেমাপ্রেমীদের কাছে অনন্য নির্মাতা হয়ে আছেন। হুমায়ূন আহমেদ যেমন জাদুকরি লেখনির মাধ্যমে কথাসাহিত্যে ভিন্ন ধারা সৃজন করেছিলেন, তেমনি সিনেমা, নাটক নির্মাণেও সবার থেকে আলাদা রূপে সবকিছু উপস্থাপন করেছেন।

Advertisement

সংলাপ, চিত্রনাট্য, গল্প সবকিছুতেই অন্যান্যদের চেয়ে আলাদা রসের, তথ্যের ও বিনোদনের জোগান দিয়েছেন হুমায়ূন। হুমায়ূন আহমেদ দেশীয় সিনেমার চিরায়ত ধারাকে ভেঙে সম্পূর্ণ আলাদা মেজাজে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। নায়ক নায়িকাসহ তার সিনোমর অন্যান্য পাত্র-পাত্রীদের তুলে ধরেছেন ভিন্ন আঙ্গিকে। তবে উপমহাদেশে চলচ্চিত্রে গানের যে ব্যবহার রয়েছে সেখানে তিনি স্থির থেকেছেন।

তিনি তার চলচ্চিত্রে সুনিপুণভাবে গান ব্যবহার করেছেন। নিজের সিনেমার গল্প ও চিত্রনাট্য অনুযায়ী কথাসাহিত্যিক হয়েও নিজেই লিখেছেন তার সিনেমার গান। গান লিখে হুমায়ূন পেশাদার ও তার আমলের সেরা সেরা গীতিকারদেরও ছাড়িয়ে গেছেন। গান রচনার ক্ষেত্রেও হুমায়ূন বাংলা সংগীতাঙ্গনে চিরস্থায়ী আসন গেড়েছেন।

হুমায়ূন আহমেদের লেখা গান এখনও মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। এখনও রেডিও টেলিভিশনের সংগীতানুষ্ঠানগুলোতে তার গান নিয়মিত প্রচার হচ্ছে শ্রোতা ভক্তদের ব্যাপক চাহিদার ভিত্তিতে।

Advertisement

কথাসাহিত্যের মানুষ হলেও হুমায়ূন গান এবং সুর ভীষণ ভালোবাসতেন। বাঁশির সুরে হারিয়েতেন। যেখানে যেতেন সেখানে তিনি গানের আসর জমাতেন। তিনি একজন গান ও সুর অন্তপ্রাণ মানুষ ছিলেন। বাংলার লোকায়ত গান ছিল হুমায়ূনের ভীষণ পছন্দের। দেশের অনেক লোকশিল্পীদের তিনি তুলে এনেছেন। তার গান গেয়ে সেসব শিল্পীরা মূল ধারার সংগীতাঙ্গনেও জনপ্রিয়তা লাভ করছেন। এর মধ্যে কুদ্দুস বয়াতীর নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।

গান রচনার ক্ষেত্রেও তিনি গানের চিরায়ত ভাষা প্রয়োগ এড়িয়ে গেছেন। যেমন, গোলাপ, বেলি, রজনীগন্ধা নয় - হুমায়ূন আহমেদ গানে ব্যবহার করেছেন লাউ ফুলকে। লিখেছেন, ‘সবুজ বরণ লাউ ডগায় দুধ সাদা ফুল।’ এই ফুলের সৌন্দর্য তিনি সবাইকে জানাতে চেয়েছেন তার গানের মাধ্যমে। যুগে যুগে গীতিকবিরা নারীর সৌন্দর্য নিয়ে লিখেছেন। পাশাপাশি করেছেন নারীর রূপ বন্দনা। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন ‘দুই চোখে তার আহারে কি মায়া’। এভাবেই হুমায়ূন বাংলাসংগীতেরও অমর স্রষ্টা হয়ে সুরপিয়াসী মানুষের মনে মিশে রয়েছেন।

হুমায়ূন আহমেদের সর্বাধিক গানের সুর করেছেন সুরকার ও সংগীত পরিচালক মকসুদ জামিল মিন্টু। তিনি হুমায়ূনের গান নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের আবহ সংগীত করতে গিয়ে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে পরিচয়। অসংখ্য নাটকের আবহ সংগীত করেছি তার সঙ্গে। তার চলচ্চিত্রে কাজ করেছি, তার লেখা গীতিকবিতায় সুর করেছি, যেগুলো লোকের মুখে মুখে ফেরে।

মকসুদ জামিল মিন্টু আরও বলেন,‘একটা ছিল সোনার কন্যা’ গানটি লিখে দিয়ে লাজুকভাবে বলেছিলেন, ‘ভাই মিটারে গণ্ডগোল থাকলে বলবেন।’ সেই থেকে শুরু পথচলা। বেশ কিছু গান লিখে দিয়েছেন, যার অধিকাংশই আমার সুর করা। আরও দুই একজনকে দিয়েছেন। তারাও সুর করেছেন। প্রতিটি গানই কথা ও সুরে অসাধারণ হয়েছে, বাংলা গানকে করেছে সমৃদ্ধ।

Advertisement

হুমায়ূন আহমেদ যেসব গানে সংগীতপ্রেমীদের মনে ঠাঁই নিয়েছেন যেসব কিছু গানের কথা জেনে নেওয়া যাক-

১৯৯৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত ‘আমার ভাঙা ঘরে ভাঙা চালা’ গানটির সুর ও সংগীত মকসুদ জামিল মিন্টুর। এই গানটি এখনও তুমুল জনপ্রিয়।

‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রের আরেকটি গান ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’। এই গানেরও সুর ও সংগীত মকসুদ জামিল মিন্টুর। সুবীর নন্দীর গাওয়া এই গানটি বাংলা সংগীতের শ্রেষ্ঠ সুর ও বাণী সমৃদ্ধ গান হিসেবে বিবেচিত হবে।

‘বরষার প্রথম দিনে’ সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে এ গানটি ছিল ২০০০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত হুমায়ূন আহমেদের ‘দুই দুয়ারী’ চলচ্চিত্রে। এই গানের সুরও করেছিলেন মকসুদ জামিল মিন্টু।

‘মাথায় পড়েছি সাদা ক্যাপ’ কণ্ঠশিল্পী আগুনের গাওয়া তরুণদের মাঝে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।

২০০৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘চন্দ্রকথা’ চলচ্চিত্রে সুবীর নন্দীর কণ্ঠে শোনা ‘ও আমার উড়াল পঙ্খী রে’ গানটি দারুণ জনপ্রিয় হয়।

‘চাঁদনী পসরে কে আমারে স্মরণ করে’মকসুদ জামিল মিন্টুর সুরে, সেলিম চৌধুরীর কণ্ঠে, হুমায়ূন আহমেদের লেখা ‘চন্দ্রকথা’ চলচ্চিত্রের এ গান শ্রোতারে হৃদয় জয় করে নিয়েছিল।

এরপর ‘চল বৃষ্টিতে ভিজি’, ‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এস এক বরষায়’, ‘ও কারিগর দয়ার সাগর… চাঁদনি পসর রাইতে যেন’ এসব গানের বাণী সুর হুমায়ূন আহদেমকে একজন সংগীত কারিগর হিসেবে মানুষ যুগ যুগ ধরে মনে রাখবে। আজ জন্মদিনে এই অমর কথাসাহিত্যিক, সংগীত রচয়িতা ও চলচ্চিত্র নির্মাতাকে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি।

এমআই/এমএস