ফিচার

পিঁপড়া কীভাবে রাজ্য দখল করে?

ছোট্ট এক জীব পিঁপড়া। আমার-আপনার আশেপাশে কতই তো দেখতে পাওয়া যায়। আমরা কি একবার ভেবেছি ওদের নিয়ে? পরিশ্রম, সময়ানুবর্তিতা, একতাবদ্ধতা ও শৃঙ্খলার উদাহরণ হিসেবে প্রকৃতিতে পিঁপড়ার জুড়ি মেলা ভার। পিঁপড়ারা অভাবে পড়ে না। ওদের দুর্ভিক্ষ নেই। লাখো লাখো পিঁপড়া নিজেরাই নিজেদের খাবার খুঁজে নিতে সুদক্ষ।

Advertisement

দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানা যায়, পৃথিবীতে প্রায় ১৪ হাজার প্রজাতির পিঁপড়া আছে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের কোনো কোনো প্রজাতির পিঁপড়া তাদের শরীরে উৎপন্ন নিজস্ব কেমিকেল ব্যবহার করে ফসলের ক্ষেতে ক্ষতিকর পোকা তাড়িয়ে পরিবেশ দূষণ রোধ করে। তাই ফসলের ক্ষেতে ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ ঠেকাতে কৃষকের বিষ প্রয়োগের দরকার নেই। বিকল্প ব্যবস্থা হতে পারে এসব পিঁপড়া।

ওদিকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র ফিজিতে এক জাতের পিঁপড়ার আচরণ একেবারে খুদে কৃষকের মতো। ওরা সযত্নে বীজ বোনে, তারপর সেগুলোয় সার দেয়। জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক সম্প্রতি একথা জানিয়েছেন। নেচার প্ল্যান্টস সাময়িকীতে প্রকাশিত ওই গবেষণা বলছে, ‘ফিলিড্রিস নাগাসাউ’ নামের পিঁপড়ারা নিজেদের খাবারের জোগান দিতে ছত্রাকের চাষ করে। পিঁপড়াগুলো সেখানেই মল ত্যাগ করে, যাতে চারাগাছগুলো মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় সার পায়।

রাজ্য দখলে পিঁপড়ার যুদ্ধঅতীতে যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্র গড়ে ওঠার কথা জানি। প্রাচীনযুগের মানুষ, মানুষকে দাস বানানোর কথা কারও অজানা নয়। আমরা কি জানি, পিঁপড়াদের মধ্যেও প্রচলিত আছে রাষ্ট্র দখলের যুদ্ধ। পিঁপড়াদের রাষ্ট্রে রয়েছে রানী, সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর একেকজন গেরিলা দক্ষতা সম্পন্ন। পরস্পর কাঁধে চড়ে অনেক উঁচুতে ওঠায় দক্ষতা সম্পন্ন। এ ছাড়াও আছে দক্ষ কর্মীবাহিনী এবং সুনাগরিক। আছে দাস প্রথাও। মাধ্যম একই, অর্থাৎ যুদ্ধ। কে না জানে, মৌচাক ও পিঁপড়ার বাসায় রানী মৌমাছি ও রানী পিঁপড়ার পাশাপাশি শ্রমিক মৌমাছি ও শ্রমিক পিঁপড়া থাকে। সাধারণত এসব বাসায় বা কলোনিতে একই প্রজাতির রানী ও শ্রমিক থাকে। কিন্তু পলিআরগাস প্রজাতির পিঁপড়ারা খাবার সংগ্রহ করতে পারে না। বাচ্চাদের খাওয়াতেও পারে না। এমনকি নিজেদের বাড়িঘর পর্যন্ত নিজেরা পরিষ্কার রাখতে পারে না। এদের প্রয়োজন হয় শ্রমিক পিঁপড়ার। সৈন্য পিঁপড়ার। তাই দক্ষ শ্রমিক, দাস ও দক্ষ সৈনিক সংগ্রহের উদ্দেশে এরা দলবেঁধে হানা দেয় ফর্মিকা প্রজাতির পিঁপড়ার রাজ্যে।

Advertisement

কোনো কোনো সময় এরা দেড়শ মিটারের বেশি পথ পাড়ি দিয়ে আক্রমণ করে ফর্মিকার রাষ্ট্র। আক্রমণকারী পলিআরগাসরা ফর্মিকা রানী ও শ্রমিকদের তাড়িয়ে দিয়ে মুককীটগুলো নিজেদের রাষ্ট্রে বহন করে নিয়ে আসে। অন্যান্য দাস পিঁপড়ারা এসব মুককীটগুলোকে যত্ন নেয় এবং ফুটে বেরোনোর পর তারা কলোনির কাজ, এক কথায় রাষ্ট্রের নানা কাজের দায়িত্ব নেয়। একটা রাষ্ট্রে যখন পিঁপড়ার জনসংখ্যা বেড়ে যায়, তখন শ্রমিক, সেনা, দাস ফর্মিকা পিঁপড়ারা প্রায় হাজার দু’য়েক পলিআরগাস পিঁপড়ার মুককীট এবং রানীকে নতুন বাসায় নিয়ে যায়।

সৈন্যরা রানীকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করে গবেষকরা জানান, কলোনি দখলের আগের ব্যাপারগুলোর পুরোটাই মাটির নিচে সম্পন্ন হয় বলে পর্যবেক্ষণ করা খুব কঠিন। সেজন্য নিউইয়র্কের আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রির গবেষক হাওয়ার্ড তাঁর স্নাতক ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গী করে স্বচ্ছ বাসা তৈরি করে বিষয়টি পরীক্ষামূলকভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। হাওয়ার্ড ও তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা ফর্মিকা পিঁপড়ার এই গুরুত্ববহ মগজ ধোলাইয়ের কারণ অনুসন্ধানেরও চেষ্টা করেছেন। হাওয়ার্ড ও তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা লক্ষ্য করেন, একটি ফর্মিকা রানীকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করে। লাশটা নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে পলিআরগাস রানীর সামনে হাজির করেন। নিষ্প্রাণ রানীকে পলিআরগাস সঙ্গে সঙ্গে কামড়াতে শুরু করে। পঁচিশ মিনিট ধরে কামড়ানো ও চেটে খাওয়া অব্যাহত থাকে। খাওয়া শেষ হওয়া মাত্র শ্রমিক পিঁপড়ারা নতুন রানীর পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এ থেকে গবেষকরা ধারণা করেন, ফর্মিকা রানীকে হত্যার সময় ওর দেহরস চেটে পলিআরগাস রানী ফর্মিকার রাসায়নিক পদার্থ গ্রহণ করে থাকে। এই রাসায়নিক পদার্থ আত্তিকরণ করার ফলে ফর্মিকার শ্রমিক পিঁপড়ারা এত দ্রুত তাঁর বাধ্য অনুচরে পরিণত হয়। গবেষকরা এ ধারণা সঠিক কি না তা প্রমাণের জন্য আরেকটি গবেষণা চালান। তাঁরা ফর্মিকা রানীকে বাসা থেকে সরিয়ে সেখানে পলিআরগাস রানীকে ঢুকিয়ে দেন। এবার কিন্তু শ্রমিকরা খুবই বিপরীত ব্যবহার করে। ওরা পলিআরগাস রানীর বিরুদ্ধে ক্লান্তিহীন ও দীর্ঘ যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়। শেষ পর্যন্ত পলিআরগাস রানীকে হত্যা করতে সমর্থ হয়।

নতুন রানী পিঁপড়ার অভিষেকপলিআরগাস রানী একাই কোন ফর্মিকা রানীকে হত্যা করার জন্য যথেষ্ট। ফর্মিকা রানীকে হত্যার পর শ্রমিক ফর্মিকারা আক্রমণকারী পলিআরগাস রানীকে নিজেদের রানী বলে মেনে নেয়। যখন পিঁপড়া দলে নতুন কোন রানী পিঁপড়ার জন্ম হয়; তখন নতুন রানী দাস অভিযানে অন্যান্য শ্রমিক পিঁপড়ার সহযাত্রী হয়। অগ্রগামী পিঁপড়ার দল যখন এগিয়ে চলে তখন নতুন রানী হঠাৎ করে থেমে পড়ে এবং চোয়াল থেকে ফেরোমন (বিপরীত লিঙ্গকে আকর্ষণের জন্য নিঃসরিত রাসায়নিক পদার্থ বিশেষ) নিঃসরণের মাধ্যমে একটি পুরুষ পিঁপড়াকে মিলনে প্রলুব্ধ করে। মিলনের পর পিঁপড়াটি ডানা ত্যাগ করে। রানী পিঁপড়া এর পরপরই তার সঙ্গীদের ত্যাগ করে। ফর্মিকার বাসার খোঁজে বের হয়। বাসা খুঁজে পাওয়ার পর সে খুব দ্রুত রানী পিঁপড়াকে হত্যা করার জন্য এগিয়ে যায় এবং সব বাঁধা অতিক্রম করে রানীর কাছে পৌঁছায়। রানীকে হত্যা করার জন্য সে তার শক্তিশালী চোয়াল ও পেটের কাছের ‘ডিউফোরস’ গ্রন্থি নিঃসৃত এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে ব্যবহার করে। কর্মীদের বাঁধা অপসারণ করার পর পলিআরগাস রানী ফর্মিকা রানীর মাথা, ধড় ও পেট কামড়াতে থাকে। কামড়াতে থাকা অবস্থায় সে ফর্মিকা রানীর ক্ষতসমূহ চাটতে থাকে।

ফর্মিকা রানীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই পিঁপড়ার রাষ্ট্রের পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ফর্মিকা শ্রমিকেরা মোহগ্রস্তের মতো শান্তভাবে নতুন রানীর দিকে অগ্রসর হয়। সেভাবে আগের রানীর যত্নআত্তি করতো; ঠিক সেভাবেই নতুন রানীর যত্নআত্তি করতে থাকে। পলিআরগাস রানী তখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মুককীট গাদা করে অভিষেক অনুষ্ঠানের মতো বিজয়ীর ভঙ্গিতে দাঁড়ায়। আর এভাবেই সম্পন্ন হয় পিপঁড়ার কলোনি দখল, রাষ্ট্র জয় সম্পন্ন হয়।

Advertisement

বহু রানীশাসিত পিঁপড়ার রাষ্ট্রে যুদ্ধ কীভাবে হয়?পলিআরগাস পিঁপড়ার রাষ্ট্রে একটা রানী থাকলেও পূর্ণাঙ্গ একটা ফর্মিকা রাষ্ট্রে একাধিক এমনি সর্বোচ্চ ২৫টি রানীকে দেখা গেছে। গবেষকরা বলেন, বহু রানীশাসিত ফর্মিকা পিঁপড়ার রাষ্ট্র বা বাসা বা কলোনি আক্রমণ করে তখন কী ঘটে, তা দেখার জন্য তাঁরা (গবেষকরা) আগে থেকেই কৌতূহলী ছিলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, ফর্মিকা রানীর সংখ্যাটি পলিআরগাস রানীর আক্রমণ অভিযানে কোনো প্রভাবই ফেলেনি। প্রথম ফর্মিকা রানীকে হত্যার পর এদের ভেতর কোনো তাড়না লক্ষ্য করা যায়নি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বা দিনের পর দিন অপেক্ষা করে সুচারু উপায়ে এরা অন্যান্য ফর্মিকা রানীদের হত্যা করে। অনেক সময় প্রতিরোধের সমস্ত অবশেষ দূর করতে এরা কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত সময় নেয়। তবে এসব অভিযান যে সব সময় জয়ের মাধ্যমে শেষ হয় তা কিন্তু নয়। মাঝে মধ্যে ফর্মিকা শ্রমিকেরা আক্রমণ করে পলিআরগাস রানীকে টুকরো টুকরো করে ফেলে। আর জয়ের জন্য পলিআরগাস রানী অন্য একটি কৌশলও অবলম্বন করে। দৈবক্রমে পলিআরগাস ও ফর্মিকা রানীর মিলনকাল এক হওয়ায় বাসার বাইরেও এদের দেখা হয়। তখন পলিআরগাস রানী সহজেই ফর্মিকা রানীকে হত্যা করে। এসময় ফর্মিকা রানীর রাসায়নিক পদার্থ আত্মস্থ করার সুবাদে কোনো বাঁধা ছাড়াই এরা ফর্মিকা পিঁপড়ার রাষ্ট্রে ঢুকে পড়তে পারে এবং পরবর্তী সময় কোনো বাঁধা ছাড়াই হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যায়। গবেষকরা জানান, পিঁপড়ারা শুধু হত্যাযঞ্জে বিশ্বাসী নয়। এরা নীতিবান। দেখা গেছে, প্রথম মিলিত হয়েছে এমন ফর্মিকা রানীর সামনে ছেড়ে দিলেও পলিআরগাস তাঁকে হত্যা করে না। পলিআরগাস সেই ফর্মিকা রানীকেই হত্যা করতে আগ্রহী, যার সন্তানরা যথেষ্ট বড় এবং কাজ-কর্ম, সেবাযত্নে পারদর্শী হয়ে উঠেছে।

যুদ্ধে পিঁপড়াদের আক্রমণ কৌশলজীব বিজ্ঞানীদের মতে, যে সমস্ত পিঁপড়া নিষেকের পর কমপক্ষে পাঁচ মাস সময় অতিক্রম করেছে। কেবল তাদেরই পলিআরগাস পিঁপড়া আক্রমণ করে। অর্থাৎ এ সময়ে ফর্মিকা পিঁপড়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক রূপান্তর ঘটে। গবেষকরা লক্ষ্য করেন, পলিআরগাসরা ফর্মিকার বিভিন্ন প্রজাতির পিঁপড়াদের দাসত্ব স্বীকারে বাধ্য করাতে সক্ষম হয়। তবে পরিচিত ফর্মিকাদের ক্ষেত্রে যতটা সফল হয়, অপরিচিতদের ক্ষেত্রে ততটা সফল হয় না।

ফর্মিকা পিঁপড়ার প্রজনন ক্ষমতা খুব বেশি হওয়ায় আক্রমণ হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। তবে কেন বয়স্ক দাস ফর্মিকা স্বজনদের কাছে আর ফেরত যায় না? সেটিও গবেষকদের একটি জরুরি ভাবনার প্রশ্ন। এটি সম্ভবত অভ্যস্ততার প্রশ্ন। কারণ নতুন ফুটে বেরোনো ফর্মিকা পলিআরগাসের নতুন দখল করা রাষ্ট্রকেই নিজেদের রাষ্ট্র বলে মনে করে। তবে এই অভ্যাসের মূলে দেখা বা শোনার চেয়ে রাসায়নিক উদ্দীপনা বড় ভূমিকা পালন করে। অনেকে অবশ্য ‘দাসত্ব’ কথাটি ব্যবহার না করে ‘কর্মী বা নাগরিক’ কথাটি ব্যবহার করতে চান। বিজ্ঞানীদের মতে, এ ধরনের সম্পর্কের জন্য পোষক ও পরজীবীদের কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যের প্রাণী হওয়া বিধেয়। ফর্মিকারা পলিআরগাসের রাষ্ট্রের খাবার সরবরাহ, বাসস্থানের উন্নয়ন ও যুদ্ধের কাজই করে থাকে, যেমনটি অন্য স্বাধীন ফর্মিকা কর্মীরা বা নাগরিকরা নিজেদের কলোনিতে বা রাষ্ট্রে নিজেরা করে থাকে।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক। এম.ফিল স্কলার, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এসইউ/এমএস