দুই হাজার ষোলো। প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে মাস দুয়েক হলো হাই স্কুলে পা রেখেছে মিলি, মিতু এবং রিমা। অনন্যাকে ওর বাবা-মা ভর্তি করে মাদ্রাসায়। ওরা প্রতিবেশী এবং খুব ভালো বন্ধুত্ব ওদের। চারজনই বড্ড দস্যি। বেশ একরোখাও। এ-পাড়া ও-পাড়া চষে বেড়ায়। ক’দিনই বা বয়স! স্বভাবে বেশ একটা ছোকরা ছোকরা ভাবও আছে। আবার মেয়েদের যতো খেলাধুলা আছে, সবকিছুতে চারজনই বেশ পাকা। কানামাছি, দাঁড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, ফুলটোকা সবকিছুতেই ওদের একটা দখল আছে। পাড়ার রাস্তাঘাট তখনও পাকা হয়নি। এমনকি ইটও বসায়নি। কখনও কখনও রাস্তায় ডাংগুলিও খেলেছে ওরা। সন্ধ্যা নামার আগেই আবার ঘরে ফিরে পড়তে বসার অভ্যেসটাও ছিল।
Advertisement
বেশ কিছুদিন হলো অনন্যা তেমন ঘর থেকে বেরোচ্ছে না। বিকেলে নিয়ম করে খেলতে পর্যন্ত আসছে না। জিজ্ঞেস করলে বলছে, ‘মা রাগ করেন।’ মা এর আগেও রাগ করতেন। তাই বলে তাকে কবে আটকে রাখতে পেরেছেন? পারেননি। সে ঠিক সুযোগ বুঝে ছুটে আসতো। হঠাৎ এমন কী ঘটলো, যেটা তাকে মায়ের বাধ্য সন্তান করে ফেলল? বাবার চোখরাঙানি যে বরাবরই উপেক্ষা করে এসেছে, তার হঠাৎ বাধ্যটি বনে যাওয়ার রহস্য খুঁজতে খুঁজতে বাতাসে খবর ভাসে, ‘সপ্তাহখানেক বাদেই অনন্যার বিয়ে।’
অনন্যার বিয়ে? ওইটুকু মেয়ে এখনই বিয়ের কী বোঝে? কেউ কেউ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেও এমন বিয়ে এ গাঁয়ে নতুন নয়। ক্লাস ফোরের তন্নির বিয়ে হলো বছরখানেক আগে। একবার নয়, দুই-দুইবার বিয়ে হলো তার। সে তুলনায় অনন্যার বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে বললে ভুল হবে না। এ গাঁয়ের নিয়ম তাই-ই বলে।
পাড়াময় ছড়িয়ে যায় অনন্যার বিয়ের কথা। সাউন্ডবক্সের শব্দে কাঁপছে গোটা গ্রাম। পরশু বিয়ে। মিলি, মিতু, রিমাদের মন খারাপ। দু’দিন হলো খেলাধুলায় ওদের মন নেই। কী বা সকাল, কী বা বিকেল, খেলার মাঠ কিংবা মিলিদের বাড়ির উঠোন ওদের পায়ের স্পর্শ পায় না। চিৎকার-চেঁচামেচিও না। সবটা কেমন স্তব্ধ হয়ে যেতে থাকে ধীরে ধীরে।
Advertisement
তারপর ছয় মাস কেটে যায়। মিলিদের উঠোনটা যেটা একসময়ে ফুলটোকা, কানামাছির মাঠ ছিল; সেটি এখন বরযাত্রীর বসার জায়গা। এত বড় উঠোন তবু জায়গা সংকুলান হচ্ছে না। বিশ-পঞ্চাশ নয়, একেবারে তিনশ লোক এসেছে। হ্যাঁ, আজ মিলিরও বিয়ে। খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে ওকে। একেবারে পুতুলবউয়ের মতো লাগছে।
এদিকে অনন্যাদের বাড়িতে অনন্যার মা-বাবার ভেতর ঝগড়া-অশান্তি লেগেই থাকে। মেয়ের সংসারটা শেষমেশ বোধহয় টিকবে না। এখানে বিয়ে দেওয়ায় এখন একে অন্যকে দোষ দেওয়া ছাড়া যেন ওদের আর কাজ নেই। সাত মাসের মাথায় ফিরে আসে অনন্যা। আর তার ঠিক সাত মাস এবং নয় মাসের মাথায় লোক বিদায়ের কাজ সারে মিতু-রিমার মা-বাবাও। দু’জনেরই বেশ ভালো ঘরে বিয়ে হয়।
ভালো সম্বন্ধ আসে তন্নিরও। পরপর দু-দুটো সংসারের পাট চুকিয়ে তন্নি সবে পড়াশোনায় মন বসিয়েছে। সমাপনীরও আর মাস দেড়েক বাকি। এর মধ্যেই সম্বন্ধ আসে তার। পড়াশোনা আর ঠিকঠাক হয়ে উঠলো না। এ আক্ষেপ তাকে আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।
তবে মিলি আর অনন্যা এখন নিয়মিত স্কুলে যায়। মিতু আর রিমা নেই বলে খেলার মাঠটায় তেমন একটা যায় না। মিলিদের উঠোনেও তেমন একটা ছোটাছুটি করে না ওরা। ওরা ঠিক করেছে, মিতু আর রিমা ফিরে এলে আগের মতো জমিয়ে খেলাধুলা করবে। বিশেষ করে কানামাছি আর ফুলটোকাটা নিয়মিত চলবে। এ দুটো খেলাই তো ওদের জীবনে সবচেয়ে বেশি জায়গা করে নিয়েছে!
Advertisement
লেখক: শিক্ষার্থী, সম্মান ৪র্থ বর্ষ, ইংরেজি সাহিত্য বিভাগ, সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজ, গোপালগঞ্জ।
এসইউ/জেআইএম