মতামত

দুর্ভিক্ষ বা অর্থনৈতিক মন্দা: প্রস্তুতির উপায় কী?

সামনের বছর আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় উৎসব জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আছে প্রায় ১৪ বছর। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে লম্বা সময়ের সরকার। সফলতা বা ব্যর্থতা মিলিয়ে এই সরকার অন্তত খারাপ চালিয়েছে বলা যাবে না।

Advertisement

আবার একদম দাগহীন সময় পার করেছে সেটাও বলা যায় না। তবে এটুকু সত্য যে একটি ভাঙচূড়া বা পরিচিতিহীন একটি দেশকে তারা বিশ্বের বুকে পরিচিতি এনে দিয়েছে। অন্ততপক্ষে দারিদ্র্যপীড়িত বা ক্ষুধামঙ্গার দেশের পরিচয় থেকে মুক্তি মিলেছে।

গোটা বিশ্ব এখন বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কে জানে, খোঁজখবর রাখে এমনকি উদাহরণ হিসেবেও আলোচনায় আনে। বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের সরকার নানা কারণে প্রশংসনীয়ও হয়েছে। আমাদের দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে কয়েকগুণ, মাথাপিছু আয় বেড়েছে, জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে।

গড় আয়ু বাড়া, শিশু মৃত্যু হার হ্রাস, নারী উন্নয়নসহ বেশ কয়েকটি সূচকের গতিটা ঊর্ধ্বমুখী এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের রিজার্ভ কোনো দিন সংকটের ইঙ্গিত দেয়নি। রিজার্ভ মানে রাষ্ট্রের সঞ্চিত অর্থ, যা দিয়ে বড় বড় ব্যয় নির্বাহ করা হয়।

Advertisement

কিন্তু কয়েক মাস ধরে আমরা শুনতে পাচ্ছি সামনে ভয়াবহ দিন আসছে। প্রথমে বিদ্যুৎ সংকট, এখন আবার শোনা যাচ্ছে খাদ্যেরও সংকট হতে পারে। চালের সঞ্চিতি নিয়ে শঙ্কা আছে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে।

মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও কমে এসেছে। সামগ্রিক পরিস্থিতির হিসাবে আসলে মানুষের আয় কমেছে। মাথাপিছু আয়ের বাড়তি যে সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল সেটি কতটা নিশ্চিত হয়েছে সে নিয়ে আলোচনার দাবি রাখে।

সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে অনেকবারই বলেছেন সামনে খারাপ দিন আসছে। সবাইকে সঞ্চয়ী হতে বলছেন, সাবধান হতে বলছেন। এবং এর কারণটিও তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। কারণগুলো কী? আমরা সবাই জানি ২০১৯ এর শেষ দিক থেকে গোটা বিশ্ব একটি অজানা অচেনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়তে থাকে।

২০২০ সালের মার্চ থেকে সেটা মহামারি আকারে বিস্তৃতি লাভ করে। গোটা পৃথিবী থমকে যায় সেই আঘাতে। সেই প্রথম লকডাউন নামক লাইফ সেইভিং বা জীবন রক্ষার একটি প্রক্রিয়ার সাথে পরিচিত হলাম আমরা।

Advertisement

পৃথিবীর বাঘা বাঘা দেশগুলো যখন বিজেদের বন্দি করে রাখার নীতি গ্রহণ করেছিল তখন আমাদের মতো একটি জনবহুল কিন্তু দারিদ্র্যপীড়িত দেশের প্রধানমন্ত্রী সাহস করে সবকিছু খুলে দিলেন। মোকাবিলার রাস্তায় নামলেন তিনি। ভীত সন্ত্রস্ত জাতি সাহস ফিরে পেলো।

পেটে ভাত রেখে জীবাণুর সাথে লড়ে বেঁচে থাকার ব্রত গ্রহণ করলাম আমরা। এবং সেই লড়াইয়ে উতরে গেলাম ভালোভাবেই। করোনায় বা ক্ষুধায় মৃত্যুহার অন্তত সড়ক দুর্ঘটনার হারের চাইতে কম পাওয়া গেলো।

কিন্তু আমরা পার পেলেই তো হবে না। গ্লোবালাইজেশনের কালে কেউ একা বাঁচতে পারে না বা একা মরতেও পারে না। বাঁচা এবং মরা দুটোই একে অপরের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছে।

করোনার ধাক্কা সামলে যখন কেবল সোজা হয়ে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল সবাই ঠিক তখনই অশান্তির মা এসে বাগড়া দিলো। এ যেন অদৃশ্য নিয়তির মতো ঘাড়ে চেপে বসলো রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ।

এখন সবাই বলতে পারে যুদ্ধ কেন আমাদের অর্থনীতিকে আঘাত করবে? আমরা তো অনেক দূরের একটি দেশ। কিন্তু ওই যে পৃথিবী এখন গ্লোবাল ভিলেজ যেখানে সবাই সবার ওপর নির্ভরশীল। শুরু হয়ে গেলো অপ্রস্তুত লড়াই।

জ্বালানি সংকট, ডলার সংকট, বাজার সংকটের সাথে যুক্ত হয়ে গেলো আমাদের দেশের অর্থলোভী স্বার্থপর ও সুযোগ সন্ধানী দুর্নীতিবাজদের চক্রান্ত।

তরতর করে উঠতে থাকা অর্থনীতি স্তিমিত হতে শুরু করেছে। বিষয়টা একটি চক্রের মতো। চলমান আয় কমে গেলে তো সঞ্চয়ে হাত পড়বেই। আর তাই সঞ্চিতির পরিমাণ কমতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে আবারও নতুন করে ঋণ চাওয়া হয়েছে আইএমএফ’র কাছে।

আপৎকালীন ঋণ নিয়ে সরকার অর্থনৈতিক ধাক্কাকে সামলাতে চাইছে। কিন্তু আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছে বলে পত্রিকায় এসেছে সেগুলোর ধাক্কাও আবার নতুন করে আসবে এই আমার মতো সাধারণ মানুষের ওপরই।

আমি অর্থনীতিবিদ না কিন্তু একটি সংসার ও একটি পরিবার চালানোর অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি দেশকে বুঝতে চাই। আমার ক্রয়ক্ষমতা ও দৈনন্দিন চ্যালেঞ্জগুলো দিয়ে আমি সামগ্রিক চ্যালেঞ্জ বিশ্লেষণ করি।

আর সেই বিশ্লেষণ আমাকে ইঙ্গিত দিচ্ছে প্রস্তুত হতে হবে। দুর্ভিক্ষ কেমন হয় বা সেসময় কেমন করে প্রস্তুত নিতে হয় সেটি কখনও গল্পেও শুনিনি আমি। তাই কোনোভাবেই বিষয়টি দৃশ্যায়ন করতে পারছি না।

প্রধানমন্ত্রী প্রস্তুত হতে বলছেন। সঞ্চয় করতে বলছেন। কিন্তু ঠিক কোন উপায়ে সঞ্চয় করবো? কোথায় রাখবো আমার সঞ্চয়ের ধন সেটি নিশ্চিত হতে পারছি না। কারণ ব্যাংকিং সেক্টরেও সুবিধার সংবাদ আসছে না। প্রথম সারির বেশ কিছু ব্যাংকের বিষয়ে ইতিমধ্যে নেতিবাচক সংবাদ এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে সোনা বিক্রি করতে চাইছে।

এই যে সংবাদ্গুলো সামনে আসছে সেগুলোর কার্যকারণ ব্যাখ্যাটা অজানা সাধারণ মানুষের সামনে। আমরা কেবল ঘটনা জানছি কিন্তু এর পেছনের উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারছি না।

সঞ্চয় ঠিক কতদিনের করবো? কেমন করে করবো বা কোথায় করবো আর কোথা থেকেই বা সঞ্চয় করবো সেটির রাস্তাও অজানা।

এহেন অবস্থায় আমরা চাই আমাদের যারা সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ ব্যক্তি আছেন, সরকারের যারা সংশ্লিষ্ট দায়িত্ববানরা আছেন তারা সঠিক বক্তব্যটি তুলে ধরবেন।

রাজনীতির কথা নয়, সাধারণের কথা বলবেন। সরকারের সফলতা বলতে গিয়ে যেন সাধারণ মানুষ সংকটে না পড়ে তেমনভাবেই দিক নির্দেশনা দেবেন।

লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস