চলতি বছর রাজশাহীতে পরীক্ষামূলকভাবে ব্রি ধান ৭৫’র বীজ বপন করা হয়েছিল। ১০৫ দিনের মাথায় কাটা হয়েছে। তবে ৯৫ দিনে এই ধান কাটা সম্ভব। ট্রায়াল প্লটে (মাঠ পরীক্ষা) হেক্টরপ্রতি ৫ টনের বেশি ফলন পাওয়া যাচ্ছে নতুন এ জাতের। এমনটিই জানিয়েছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর।
Advertisement
অক্টোবরের শেষ দিকে গোদাগাড়ী উপজেলার দেওপাড়া ইউপির সারইল গ্রামে ব্রি ৭৫’র ফসল কর্তন ও কৃষক সমাবেশে তিনি এ তথ্য জানান।
ব্রি’র মহাপরিচালক বলেন, ‘এই ধান অন্য ধানের তুলনায় অনেক উন্নত। এই ধান চাষ করার পর সরিষা ভালো হবে। আমরা তেলজাতীয় ফসলের দিকে পিছিয়ে আছি। দেশে সয়াবিন আমদানির ষড়যন্ত্রের কারণে সরিষা চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বছরে ২৪-২৫ হাজার কোটি টাকার তেল আমদানি করতে হয়। যদি আমরা সরিষা চাষ করি তাহলে বাড়তি টাকা পাব। দেশ বাঁচবে আপনারাও লাভবান হবেন। এজন্য ফসলের শস্যবিন্যাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি বলেন, এ জাতের ধান চাষে সময় কম লাগে। পোকা-মাকড়ের আক্রমণ কম হওয়ায় বালাইনাশক স্প্রে করতে হয় না। পোকা-মাকড়ের আক্রমণ না থাকার কারণে ফলন ভালো হয়। এই ধান আগাম বাজারে আসায় দাম বেশ পাওয়া যায়। তাছাড়া এই জমির ধান তোলার পর সবজি চাষ করে বেশ লাভবান হওয়া যায়। এ জাতের ধানচাষ ছড়িয়ে দিতে পারলে কৃষি অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে।
Advertisement
জমি থেকে কাটা ধান মাড়াই করার পর কাঁচাভেজা দাঁড়িপাল্লায় মেপে দেখা গেলো প্রায় ২২ মণ! এতে জমির মালিক আবুল হোসেন মাসুদ বেজায় খুশি।
পেশা শিক্ষকতা হলেও কেতাদুরস্ত কৃষক আবুল হোসেন মাসুদ। কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, এই ধানের চাল চিকন। এর ভাত হয় ঝরঝরে। আমরা ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরামর্শ ও সহায়তা নিয়ে ব্রি-ধান ৭৫ চাষ করেছি। উচ্চফলন এবং আরও কিছু সুবিধা হওয়ায় আমাদের দেখাদেখি অন্যান্য কৃষকও এতে আগ্রহী হয়েছেন। আরও একটি সুবিধা এই ধান হেলে পড়ে না, ইঁদুর লাগে না। সবচেয়ে বড় লাভ হলো ধান কেটে সরিষা অতিরিক্ত ফসল হিসেবে ঘরে তুলতে পারব।
শুধু আবুল হোসেন নন, এই উপজেলাসহ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট রাজশাহী কৃষি অঞ্চলে (রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ) অন্তত ৪০০ বিঘা জমিতে ব্রি ধান-৭৫ চাষাবাদ করা হয়েছে। পোকা-মাকড়ের বালাই নেই। সুগন্ধি জাতের এমন ধান চাষের পরও জমিতে সরিষা লাগানোর সুযোগ থাকে। ফলে কৃষকরা ব্রি-৭৫ জাতের নতুন ধান চাষ করে বেশ লাভবান হয়েছেন বলে জানা গেছে।
কৃষক আবুল হোসেন, সাইফুল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম, আব্দুল জব্বারসহ কয়েকজন জানান, আমরা আগামী বছর আরও বেশি এলাকায় এই ধানের চাষ করতে চাই। ২২ মণ হারে ফলন হলে কৃষকরা চাষ করবেই। যে ধান ভালো আর চাষ করার পর সরিষা হবে সেটাতেই কৃষক ঝুঁকবে বলেন তারা।
Advertisement
রাজশাহী ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. ফজলুল ইসলাম বলেন, চলতি বছর রাজশাহী অঞ্চলে প্রায় ৪০০ বিঘা জমিতে ব্রি-ধান ৭৫-এর চাষ হয়েছে। আমরা কৃষকদের বীজ ও সার সরবরাহ ছাড়াও অনেক সহায়তা দিয়েছি। গবাদিপশুর খাবার হিসেবে এই ধানের খড় বেশ সুন্দর। ধান হেলে পড়ে না, ফলন বেশি, খেতে সুস্বাদু, রোগ-বালাই কম। চাষিরা ব্রি-৭৫ জাতের সুগন্ধি ধান চাষে লাভবান হয়েছেন।
বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ মো. শামছুল ওয়াদুদ বলেন, এই ধান আপনারা আরও আগে লাগাতে পারলে আরও আগে তুলতে পারবেন। আগের প্রাচীন পদ্ধতি ছেড়ে আধুনিক কৃষির দিকে যেতে হবে। এই ধান কেটে সরিষা, এরপর সরিষা তুলে বোরো হবে। এ বছর ৩০ শতাংশ সরিষা আবাদ বাড়াতে হবে, আগামী বছর ৭০ শতাংশ ও পরে দেড়শ শতাংশে উন্নত করতে হবে।
রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার জি এস এম জাফরউল্লাহ এনডিসি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতি ইঞ্চি মাটি কাজে লাগানোর কথা বলেছেন। আজ জনগণের উন্নতি হয়েছে। কৃষির উন্নতি হয়েছে। আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। উৎপাদন বেড়েছে। ফলে কৃষিকে অবহেলা না করে আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে।
কৃষক সমাবেশ শেষে ৪০০ জন কৃষককে ব্রি ধান-৮৯, ব্রি ধান -৯২, ব্রি ধান-৮১সহ কয়েকটি উন্নতজাতের বীজ ধান দেওয়া হয়।
এর আগে গোদাগাড়ী উপজেলার দেওপাড়া ইউপির সারইল গ্রামে রোপা আমন মৌসুমে ব্রি ধান-৭৫ ১০৫ দিনের মাথায় কাটা হয়। এসময় উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার জি এস এম জাফরউল্লাহ এনডিসি, ব্রি’র মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর, রাজশাহী রিজিওনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও অফিস প্রধান ড. মো. ফজলুল ইসলাম, বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ মো. শামছুল ওয়াদুদসহ জেলা, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও চার শতাধিক কৃষক-কিষাণি।
এসএইচএস/এমএস