নোয়াখালীজুড়ে ব্যানার-ফেস্টুনে সরব বর্তমান সংসদের প্রধান বিরোধীদল জাতীয় পার্টি (জাপা)। তবে মানুষের মুখে নেই দলটির কোনো নেতার নাম। সাংগঠনিক কার্যকলাপেও নেই গতি। কর্মীদের একাংশ বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে যেতে রাজি নয়। দলটির কেন্দ্রীয় হাইকমান্ড সূত্র বলছে, নোয়াখালী জেলা শাখার সভাপতি সালাহ উদ্দিন আহমেদ সাংগঠনিক কাজে সক্রিয় নন। পড়ে থাকেন ঢাকায়। সাধারণ সম্পাদক বোরহান উদ্দিন মিঠু চান পাশের জেলা লক্ষ্মীপুর-২ আসন বা রায়পুর এলাকায় ভোট করতে। এভাবে বাড়ছে বিভক্তি। সবশেষ ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে নোয়াখালীর সব আসনে জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়া জাপা নেতাদের অধিকাংশ এবার আগ্রহী একক নির্বাচনে। নেতাদের দাবি, বিএনপি তাদের ব্যাপক ক্ষতি করেছে, আর আওয়ামী লীগকে সুবিধা দিতে গিয়ে হারিয়েছে সব।
Advertisement
সরেজমিনে নোয়াখালীর বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকা ঘুরে জানা যায়, ৩০০ আসনে ভোট করতে চাওয়া জাপা এখনো জেলার ছয়টি সংসদীয় আসনে প্রার্থী নির্বাচনে নজর দেয়নি। তাই কোনো প্রার্থী সেভাবে প্রস্তুতিও নিতে পারছেন না। রাজনীতির মাঠে জাপা নেতাদের নিয়ে আলোচনাও কম। অথচ এক সময় জাপা এখানে শক্তিশালী ছিল।
জানতে চাইলে জাপার দপ্তর সম্পাদক এম এ রাজ্জাক খান জাগো নিউজকে বলেন, নোয়াখালীতে এখনো আসন নিয়ে সিটিং হয়নি। কয়েকজনকে কাজ করার জন্য বলা হয়েছে। মার্চ-এপ্রিলে গিয়ে চূড়ান্ত করবো। পরীক্ষা চলছে আমাদের প্রার্থীদের।
নির্বাচনী আইন অনুযায়ী পর্যাপ্ত ভোট না পাওয়ায় একাদশ সংসদ নির্বাচনে নোয়াখালীর ছয়টি সংসদীয় আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা জাপার ছয় প্রার্থীসহ ৪১ জনের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। সবকটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হন। যদিও প্রার্থীদের অভিযোগ নির্বাচনে অনিয়ম, আওয়ামী লীগের জন্য আসন ছেড়ে দেওয়া ও জেলার গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের দলছুটের কারণে নোয়াখালীতে জাপার এ অবস্থা।
Advertisement
একাদশ সংসদ নির্বাচনে নোয়াখালী-১ (চাটখিল-সোনাইমুড়ী আংশিক) আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছিলেন আবু নাছের ওয়াহেদ ফারুক, নোয়াখালী-২ (সেনবাগ-সোনাইমুড়ী আংশিক) আসনে হাসান মঞ্জুর, নোয়াখালী-৩ (বেগমগঞ্জ) আসনে ফজলে এলাহী সোহাগ, নোয়াখালী-৪ (সদর-সুবর্ণচর) আসনে মোবারক হোসেন আজাদ, নোয়াখালী-৫ (কোম্পানীগঞ্জ-কবিরহাট) আসনে মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম স্বপন ও নোয়াখালী-৬ (হাতিয়া) আসনে নাছিম উদ্দিন মো. বায়েজিদ।
আওয়ামী লীগকে সুবিধা দিয়ে সব হারালো জাপা!জানতে চাইলে ফজলে এলাহী সোহাগ জাগো নিউজকে বলেন, ‘গতবার কি নির্বাচন হয়েছে? সেটা নিয়ে কথা বলা মানে নিজেরা, নিজেদের ছোট করা। জাপা বাদ দিলাম। বেগমগঞ্জে বিএনপির বরকতউল্লাহ বুলুকে দয়া করে ২০ হাজার ভোট দেখাইছে। আমি আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়েছিলাম আনুষ্ঠানিকভাবে। সমর্থন দেওয়াটা আমাদের ভুল ছিল। ভোটের সময় আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে ব্যবহার করে, ভোট চলে গেলে ওনারা তলে তলে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গেই সখ্যতা করে। স্থানীয়ভাবে আমরা তাদের সাপোর্ট দেবো আর শেষ ফলগুলো খাবেন ওনারা।’ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেও জাপা লাভবান হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, ইউনিয়ন পর্যায়ে আমাদের নেতাকর্মীরা কোনো সাপোর্ট পায়নি। আমি সংসদ সদস্য ছিলাম। ওনারা আমার সঙ্গে যে কমিটমেন্ট করেছেন তার এক শতাংশও রাখেননি। আমি টাকার বিনিময়ে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেইনি।
নোয়াখালী জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক বোরহান উদ্দিন মিঠু মনে করেন, ৮০ পরবর্তীসময়ে প্রয়াত মওদুদ আহমদসহ হেভিওয়েট নেতা দলছুট হওয়ায় নোয়াখালীতে শক্তি হারিয়েছে জাপা। এরশাদ আমলে যারা সুবিধাভোগী হয়েছে তারা ক্রান্তিকালে দল ছেড়ে চলে গেছে।
জাগো নিউজকে তিনি বলেন, অনেক আসনেই আমাদের চাপ দিয়ে জোর করে নিয়ে গেছে। কোম্পানিগঞ্জে চাপ দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীসময়ে জাপার প্রার্থী সংবাদ সম্মেলন করে ওবায়দুল কাদেরকে সমর্থনে দেন।
Advertisement
রওশন নাটক জাপাকে চাপে রাখার কৌশল, বিএনপির সঙ্গে জোটে যেতে বিভক্তিদলটির নেতাকর্মীরা বলছেন, বিএনপির শাসনামলে জাপা নানানভাবে নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে। আগামীতে দলটির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করা নিয়ে দ্বিধাবিভক্তি আছে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে।
ফজলে এলাহী সোহাগ বলেন, আমি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। জাপা চেয়ারম্যান যদি এককভাবে চিন্তা করেন যে জাপা ভোট বর্জন করবে তাহলে আছি। যদি বিএনপির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভোট বর্জন করেন তাহলে আমি নেই। এককভাবে উনি ভোট করলে আমি করবো, বিএনপির সঙ্গে থাকলে আমি নেই। আমাদের দলের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে বিএনপি। তারা দলকে ধ্বংস করেছে, আমরা নেতাকে অসম্মান করেছে। বিএনপিকে আমি আমাদের শত্রু মনে করি।
অন্যদিকে বোরহান উদ্দিন মিঠুও মনে করেন, বিএনপি আমলে জাপা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে জিএম কাদেরের সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত মানছেন এই নেতা। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, জাপা জনগণের স্বার্থে রাজনীতি করে। পার্টির চেয়ারম্যান যে সিদ্ধান্ত নেবেন জনগণের স্বার্থেই নেবেন, এটা আমার বিশ্বাস। তার সিদ্ধান্ত আমরা মেনে নেবো।
সম্প্রতি জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদের ঢাকা কাউন্সিল নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি দলটিকে চাপে রাখতে সরকারের কৌশল বলে মনে করছেন দলটির শীর্ষ নেতারা।
তারা বলছেন, বিগত তিন নির্বাচন ধরে দেখছি জাপা নিয়ে সরকার একটা খেলা খেলে। জাপা ছাড়া কেউই ক্ষমতায় আসতে পারবে না। এটাই বাস্তবতা।
ফজলে এলাহী সোহাগ বলেন, রওশন ম্যাডামসহ কয়েকজন আছেন সরকারের সাপোর্ট নিয়ে এমপি হতে হতে স্বাদটা পেয়েছেন ভালো। জিএম কাদের মানুষের জন্য লড়াই করছেন। রওশন এরশাদ ম্যাডামকে আমি ছোট করি না। ওনাকে কুবুদ্ধি দিয়ে কেউ এগুলো করাচ্ছে।
জাপার এক শীর্ষ নেতা বলেন, জাপাকে এর আগেও বিভক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। রওশনের সঙ্গে মূল দলের কেউ নেই। রাঙ্গাও অনেক প্রভাবশালী নেতা ছিলেন, তাকে বহিষ্কার করার পর তার পেছনে ১০টা লোকও দাঁড়ায় না। রওশন ম্যাডাম পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক, ওনার কোনো গ্রহণযোগ্যতা তৃণমূলে নেই।
২০১৮-এর পর না হওয়া কমিটির তারিখ শিগগির ঘোষণার প্রত্যাশা২০১৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ১১১ সদস্য বিশিষ্ট জেলা শাখা কমিটি ঘোষণা করেন দলটির তৎকালীন মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার। দুই বছর মেয়াদি এই কমিটির মেয়াদ ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে শেষ হওয়ার কথা। তবে দলীয় কোন্দলে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড আটকে রয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
এ প্রসঙ্গে বোরহান উদ্দিন মিঠু বলেন, এখানে কোনো কোন্দল নেই। ২০১৮ সালের পর কমিটি এক্সটেনশন হয়েছে। করোনার কারণে ৯ মাস বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই কমিটির মেয়াদ শেষ হবে ডিসেম্বরে। তারপর নতুন কমিটি আসবে।
এসএম/এএসএ/এমএস