জাতীয়

আড়তের ৬৮ টাকার ইলিশ ঢাকায় ৪০০

নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার মেঘনা নদী সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ছে রুপালি ইলিশ। জেলে, আড়তদার, পাইকার ও খুচরা বিক্রেতার হাত হয়ে এসব ইলিশ পৌঁছায় ক্রেতার হাতে। আড়তদার থেকে পাইকার পর্যায়ে ইলিশের দাম সহনীয় হলেও লাগামছাড়া হচ্ছে খুচরা পর্যায়ে। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইলিশ আড়ত থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বের হয়ে খুচরায় কয়েকবার হাতবদল হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে পরিবহন খরচ। ফলে ক্রেতার হাতে পৌঁছাতে ইলিশের দাম হয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।

Advertisement

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই ইলিশের দাম বেশ চড়া। আকারভেদে প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়। এক কেজি বা তার চেয়ে বেশি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়। ৫০০ গ্রাম থেকে এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে এক হাজার টাকায়। এছাড়াও ৩০০ থেকে ৫০০ গ্রামের ইলিশ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়। আড়তদার ও খুচরা বাজার সূত্রে জানা গেছে, আড়তদার ও পাইকারি পর্যায় থেকে খুচরা বাজারে ৪-৫ গুণ বেশি দামে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে।

আরও পড়ুন: ভরা মৌসুমেও চড়া ইলিশের দাম

সরেজমিনে জানা গেছে, মেঘনা নদী ও তদসংলগ্ন বঙ্গোপসাগর থেকে ধরে আনা মাছ হাতিয়ার হরনী ইউনিয়নের চেয়ারম্যানঘাটের আড়তদাররা ডাকের মাধ্যমে পাইকারি মাছ ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। ওই পাইকাররা আবার চাদঁপুরসহ বিভিন্ন জেলার পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। ফলে ৫০০ গ্রাম ওজনের যে ইলিশ চেয়ারম্যানঘাটে বিক্রি হয় প্রতি পিস ৬৮-৮০ টাকায়, সেই মাছ খুচরা বাজার থেকে ক্রেতা কেনেন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়।

Advertisement

চেয়ারম্যানঘাটে যেভাবে মাছ বিক্রি হয়চেয়ারম্যানঘাট, চতলারঘাট, সতলারঘাটে ইলিশ, পোয়া, পাঙাশসহ নানা ধরনের সামুদ্রিক মাছের বেচাকেনা সারাদিনই চলে। চেয়ারম্যানঘাট সংলগ্ন বাজারে পোয়া মাছ বিক্রি হয় ভোর ৬টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত। এরপর সকাল ৯টা থেকে সারাদিন ও গভীর রাত পর্যন্ত বিক্রি হয় ইলিশসহ অন্যান্য মাছ। তবে জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করে চেয়ারম্যানঘাটের কার্যক্রম চলে। জোয়ারের সময় সচল থাকে চেয়ারম্যানঘাট। শতাধিক আড়তদারের মাধ্যমে এই ঘাটে মাসে কোটি টাকার মাছ কেনাবেচা হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে মেসার্স মেঘনা বহন মুন স্টার মৎস্য আড়তের মালিক ফয়সাল জাগো নিউজকে বলেন, ট্রলারে মাছ আনার পর আড়তে রাখা হয়। তারপর আমরা সেগুলো ডাকে (দাম ধরে মাছ বিক্রির প্রক্রিয়া) পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করি। জেলেদের কাছ থেকে আমরা মাছ কিনি। এরপর সেগুলো আমরা পন হিসেবে বিক্রি করি, ৮০ পিস মাছে এক পন ধরা হয়। তবে আকার ছোট হলে ৮৮ পিসে এক পন ধরা হয়। মাছ ছোট হলে একটু বেশি দিতে হয়, ব্যাপারীদের একটু পুষিয়ে দিতে হয়।

আরও পড়ুন: সাড়ে ৬ টাকা জ্বালানি খরচে ইলিশের দাম বেড়েছে ১৫০-২০০!

তিনি বলেন, ছোট আকারের প্রতি পন ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকায়। এই হিসাবে প্রতি পিসের দাম পড়ে ৬৮ টাকার মতো। পাইকাররা এটা ৭৫ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি করেন। তবে ইলিশের দাম সবচেয়ে বেশি বাড়ে খুচরা পর্যায়ে। খুচরা ব্যবসায়ীরা কেনা দাম থেকে কয়েকগুণ বেশি দামে ইলিশ বিক্রি করছেন।

Advertisement

বাজারে ইলিশের বাড়তি দাম প্রসঙ্গে এই ব্যবসায়ী বলেন, আমরা আড়তদার কিংবা পাইকাররা পাইকারি দামে বিক্রি করছি। কিন্তু বেশি দামে মাছ বিক্রি করে সুবিধা নিচ্ছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। মাঝারি আকারের ইলিশ পাইকারদের কাছ থেকে কেনার পর খুচরা ব্যবসায়ীদের খরচ পড়ে প্রতি কেজি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। কিন্তু তারা সেগুলো বিক্রি করছেন প্রতি কেজি ৭০০ থেকে এক হাজার টাকায়। বাজারে পর্যাপ্ত ইলিশ থাকলেও কম আছে এমন কথা বলে পাইকারি ব্যবসায়ীরা সুবিধা নেন। এছাড়া অনেক সময় তারা গুদামজাত করেও ইলিশের দাম বাড়ান।

চাঁদপুরের ইলিশ ব্যবসায়ী লক্ষ্মণ চন্দ্র দাস জানান, মা ইলিশকে ডিম ছাড়ার সুযোগ দিতে অক্টোবরে ২২ দিন ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। ওই সময়ে ক্রেতাদের কাছে ইলিশের একটা চাহিদাও থাকে। আবার দীর্ঘদিন বাজারে ইলিশ পাওয়া যাবে না বলে অনেকেই মজুত করেন। ফলে স্বভাবতই একটা বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়। এসব কারণে বাজারে প্রচুর সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও ইলিশের দাম কমছে না। সারা বছরই দাম চড়া থাকছে।

হাতিয়া মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও হরণী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আখতার হোসাইন বলেন, চাহিদা অনুযায়ী মাছের দাম ওঠানামা করে। মাছ বিক্রি করে পাইকার ও আড়তদাররা খুব বেশি লাভ করেন না। কিন্তু অন্যান্য খরচ যেভাবে বেড়েছে তাতে ইলিশের বাজারেও প্রভাব পড়েছে।

আরও পড়ুন: সময়ের সঙ্গে ইলিশের দাম বাড়া অস্বাভাবিক নয়

চেয়ারম্যানঘাট থেকে কিছু দূরে মাইজদী, সুবর্ণচর, চরভাটাসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে ইলিশ। তবে এসব বাজারে পদ্মা ও মেঘনা- এই দুই নদীর ইলিশ বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।

খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, মেঘনার ইলিশ সরাসরি তারা খুব একটা পান না। চাদঁপুর ঘাট হয়ে তাদের কাছে ইলিশ আসে। চলতি বছর ইলিশ ধরার মৌসুম শুরুর পরেই আগস্ট মাসে জ্বালানি তেলের বর্ধিত দাম কার্যকর হয়। ফলে মাছ ধরার ট্রলারের খরচ ছাড়াও বেড়েছে ইলিশ মাছের পরিবহন খরচ। এছাড়া কয়েক হাত ঘুরে ক্রেতার কাছে যাওয়ায় প্রভাব পড়ছে ইলিশের দামে।

নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর ছোট ইলিশ মিলছে বেশি ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে গত ২৯ অক্টোবর থেকে ইলিশ শিকারে যাওয়া শুরু করেন জেলেরা। হাতিয়ার চেয়ারম্যানঘাট, বাংলাবাজার, কাজীরঘাট, সূর্যমুখী, বুড়িরদোন, রহমতবাজার, নতুন সুইজ, কাদিরা সুইজ, জংগলিয়া, মোহাম্মদ আলী সুইজ, মোক্তারিয়াঘাট, আমতলিঘাট ও কাটখালিঘাটসহ অর্ধ-শতাধিক ঘাট থেকে মাছ শিকারে গভীর সমুদ্রে যান তারা। জেলেরা জানান, নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর থেকেই ভালো মাছ পাচ্ছেন তারা।

মনির উদ্দিন নামের এক জেলে বলেন, ইলিশ বিক্রি করে আবার দ্রুত সাগরে ফিরে যাচ্ছেন তারা। এখনও বড় আকারের ইলিশ তেমন একটা পাওয়া যাচ্ছে না। আশা করছি আগামীতে জালে বড় ইলিশ উঠবে।

লিটন নামে এক আড়তদার জাগো নিউজকে বলেন, ইলিশ ভালোই ধরা পড়ছে। তবে সেটা আগের মতো নয়। নিষেধাজ্ঞার আগে যে রকম ধরা পড়েছে, বর্তমানে তার চেয়ে একটু কম ধরা পড়ছে। আবহাওয়া ও জলবায়ুগত কারণে ইলিশের আকার ছোট হয়ে এসেছে। ১০- ১৫ ইঞ্চি আকৃতির ইলিশ এখন বেশি ধরা পড়ছে। তবে নিষেধাজ্ঞার আগে ১৮-২০ ইঞ্চির ইলিশ বেশি ধরা পড়তো। সেগুলোর ওজন ছিল ৭০০ থেকে ৭৫০ গ্রাম। আর বর্তমানে ১৪-১৫ ইঞ্চির যেগুলো ধরা পড়ছে এগুলোর ওজন সর্বোচ্চ ২৫০ গ্রাম হচ্ছে।

চেয়ারম্যানঘাটের মাছ ব্যবসায়ী শাহজাহান জাগো নিউজকে বলেন, বড় মাছ কম আসছে। একটা জেলে যদি ৪০-৫০ হাজার টাকার মাছ আনেন তার মধ্যে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার বড় মাছ আসে। বাকিগুলো ছোট। মা ইলিশ ডিম ছেড়েছে। ডিম ছাড়ার পর মা ইলিশ নদীতে থাকে না, সাগরে চলে যায়। ফলে নদীতে বড় মা ইলিশ এখন পাওয়া যাচ্ছে না। যেগুলো পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো ছোট, এতে লাভ কম।

আরও পড়ুন: রাতারাতি বেড়ে গেলো ইলিশের দাম

তিনি বলেন, বড় ইলিশ বেশি পাওয়া যায় নিষেধাজ্ঞার আগে। ইলিশের প্রজনন বাড়াতে প্রতি বছর ২২ দিন ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দেয় সরকার। এ সময় ইলিশ ধরা বন্ধে অভিযান চালায় প্রশাসন। তবে অভিযানের আগেই বড় ইলিশ বেশি ধরা পড়ে।

হাতিয়া মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও হরণী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আখতার হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, কেউ কেউ ভালো মাছ পায়, কেউ আবার কম পায়। মেঘনা নদীতে পোয়া মাছ বেশি, ইলিশ তেমন নেই। মেঘনায় এখন বেশি পাওয়া যাচ্ছে পোয়া ও পাঙাশ। তবে গভীর সমুদ্রে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। ছোটবড় সব আকারের ইলিশই পাওয়া যাচ্ছে।

দুই নদীর ইলিশ একসঙ্গে বিক্রিতে খুশি নন ব্যবসায়ীরাবঙ্গোপসাগরের পাশাপাশি পদ্মা ও মেঘনা নদীতে ইলিশ পাওয়া যায়। চেয়ারম্যানঘাটের আড়তদার ও জেলেদের দাবি, মেঘনার ইলিশ পদ্মার মতো সাদা চকচকে কিংবা চোখা আকৃতির নয়। তবে স্বাদে-গন্ধে পদ্মার ইলিশ মেঘনার ইলিশের সমকক্ষ নয়। ফলে পদ্মার ইলিশ বিক্রি করতে দুই নদীর ইলিশ একসঙ্গে মিশিয়ে ফেলছেন অনেকেই। পাশাপাশি ইলিশের মতো দেখতে চাপিলা মাছও মেশানো হয়। এতে মেঘনার ইলিশের সুনাম নষ্ট হচ্ছে।

চেয়ারম্যানঘাটের আড়তদার ফয়সাল জাগো নিউজকে বলেন, মেঘনার ইলিশ অন্য ইলিশের থেকে দেখতে ও স্বাদে আলাদা। এই ইলিশ সরাসরি কোথাও যায় না। চাঁদপুর হয়ে পুরো বাংলাদেশে যায়। তবে এখানেই পদ্মার ইলিশের সঙ্গে মিক্সড হয়ে যাচ্ছে। কেননা পদ্মার ইলিশের স্বাদ তুলনামূলকভাবে কম। এভাবে মিশিয়ে বিক্রি করার কারণে মেঘনার ইলিশের আলাদা স্বকীয়তা হারিয়ে যাচ্ছে। এতে আমাদের ক্ষতি হচ্ছে। সিন্ডিকেটের কারণে এটা হচ্ছে, আমরা কিছু করতে পারছি না।

এসএম/কেএসআর/এমএস