ইথিওপিয়ার সরকার ও তাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্টের (টিপিএলএফ) নেতারা অবশেষে সমঝোতায় পৌঁছালো। প্রায় দুই বছর ধরে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ চলছিল। সেই ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় গত ২ নভেম্বর। বোমা, বুলেটের আঘাতে বহু মানুষের প্রাণ গেছে এই গৃহযুদ্ধে। তাছাড়া যুদ্ধজনিত কারণে ক্ষুধা ও রোগের কারণে আরও বহু মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে। উদ্বাস্তু হয়েছে লাখ লাখ মানুষ।
Advertisement
ইথিওপিয়ার সরকার ও উত্তরের একটি অঞ্চল তাইগ্রের নেতারা এই যুদ্ধে তেমন কিছুই অর্জন করেনি। এরইমধ্যে তাইগ্রে, আফার এবং আমহারার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস এবং বহু ফসল পুড়ে যেতে দেখেছে। বিস্তৃত এলাকাজুড়ে চলে জাতিগত নিধন। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন অসংখ্য নারী। আফ্রিকান ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় দক্ষিণ আফ্রিকায় আনুষ্ঠানিক শান্তি আলোচনা শুরুর এক সপ্তাহের কিছু বেশি সময় পর সমঝোতার ঘোষণা এলো। দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় সংঘাতে লিপ্ত পক্ষগুলো অবশেষে শান্তি চুক্তিতে সম্মত হয়েছে। এর আগে ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবে আহমেদের অনুগত সেনাবাহিনী এবং তাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্টকে (টিপিএলএফ) সমর্থনকারী বাহিনীর মধ্যে লড়াই অবিলম্বে বন্ধ করার আহ্বান জানায় আফ্রিকান ইউনিয়ন। উভয়ই নিরীহ মানুষদের জন্য নিরবচ্ছিন্ন সহযোগিতার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে।
এই সমঝোতার ফলে তাইগ্রেতে বেসামরিক নাগরিকদের ত্রাণ দেবে টিপিএলএফ যাদের বেশিরভাগই যুদ্ধের জন্য সরকারি বাহিনীর দ্বারা অবরুদ্ধ ছিল। আগস্টে আবারও যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এই অঞ্চলে কোনো ত্রাণ প্রবেশ করেনি। ফলে অনাহারে থাকা লাখ লাখ তাইগ্রিয়ান চরম দুর্ভোগে পড়ে।
দেশটির সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ও ব্যাংকিং সুবিধা আবারও চালু করা হবে ওই অঞ্চলে। ২০২১ সালের জুন মাস থেকে এসব সার্ভিস বন্ধ করে দেওয়া হয়। সে সময় ইথিওপিয়ান সেনাবাহিনী ও প্রতিবেশী ইরিত্রিয়ার মিত্রদের কাছ থেকে বেশিরভাগ অঞ্চল দখলে নিয়েছিল টিপিএলএফ।
Advertisement
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস এই শান্তি চুক্তিকে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এই চুক্তি ইথিওপিয়ার লাখ লাখ বেসামরিক লোককে কিছুটা স্বস্তি দেবে।
সমঝোতা অনেক ভালো উপায়। এটি তাইগ্রে ও ফেডারেল সরকারের মধ্যে ভবিষ্যত সম্পর্কের জন্য একটি নীলনকশা তৈরি করলো। ফলে এই অঞ্চলের ওপর ‘সাংবিধানিক কর্তৃত্ব’ দ্রুত পুনরুদ্ধার হবে। ফেডারেল সরকারের সেনাদের এই অঞ্চলের রাজধানী মেকেলে প্রবেশ করতে হবে এবং বিমানবন্দর, হাইওয়েসহ অন্যান্য ফেডারেল সার্ভিসগুলোর বাস্তবায়ন করতে হবে।
দেশটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত একটি ‘অন্তর্বর্তীকালীন’ প্রশাসন অঞ্চলটি পরিচালনা করবে। বাস্তবে এর অর্থ হবে টিপিএলএফ-এর নেতৃত্বাধীন আঞ্চলিক সরকারের বিলুপ্তি। যা ফেডারেল সরকারের আদেশ অমান্য করে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে নির্বাচিত হয়েছিল। এই নির্বাচনই তিন মাস পরে দেশটিকে গৃহযুদ্ধের পথে নিয়ে যায়। যখন আবে, ফেডারেল কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে তাইগ্রের ব্যাপারে ক্ষিপ্ত হয়ে এই অঞ্চলের সীমান্তে সেনা মোতায়েন শুরু করেন। ফলে টিপিএলএফ কেন্দ্রীয় সরকারের বাহিনীর ওপর হামলা শুরু করে।
অনেক তাইগ্রিয়ান মনে করেন চুক্তিটি আত্মসমর্পণের সমান। তাইগ্রের বাইরের লোকদের মধ্যে, যারা শেষ বার ফেডারেল সৈন্যরা দখল করার সময় তাদের মাতৃভূমিতে কয়েক মাস ধরে হত্যা, ধর্ষণ ও অনাহার প্রত্যক্ষ করেছিল তারা এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না। টিপিএলএফের কাছে চুক্তিটি প্রকাশ্যে ব্যাখ্যা করার জন্য দাবিও রয়েছে। দলটির নেতারা কঠোরভাবে দাবি করছেন যে তারা ইথিওপিয়ার সাংবিধানিক আদেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সফলভাবে লড়াই করেছেন।
Advertisement
কয়েক মাস ধরে টিপিএলএফ-এর শীর্ষস্থানীয় নেতারা জোর দিয়েছিল যে তাদের বাহিনী লড়াইয়ে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে এটি স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে তারা পতনের দ্বারপ্রান্তে। টিপিএলএফ নেতারা যারা দাবি না মানার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার মধ্যে তাইগ্রে থেকে ইরিত্রিয়ান সৈন্যদের প্রত্যাহার এবং যুদ্ধের শুরুতে প্রতিবেশী আমহারা অঞ্চল দ্বারা সংযুক্ত অঞ্চলগুলোর প্রত্যাবর্তন। শেষ পর্যন্ত ইরিত্রিয়া স্বাক্ষরিত চুক্তিতে একটিও উল্লেখ করার অনুমতি দেয়নি।
এদিকে, ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এলাকা’ নিয়ে সমাধান কি? কেউ কেউ মনে করেন যে সংবিধান অনুযায়ী, এটিতে গণভোট হতে পারে।
এটি যে এতো ছাড় দিয়েছে তা সম্ভবত যুদ্ধক্ষেত্রে টিপিএলএফের দুর্বলতা ও অবরোধের অধীনে বেসামরিক নাগরিকদের দুর্ভোগের কারণে। কিন্তু কেউ কেউ এখনও মনে করেন যে এটি খুব শিগগির বন্ধ হয়ে যাবে। একজন সাবেক ইথিওপিয়ান কূটনীতিক মনে করেন যে এটি ‘অনেক ছাড়’ দিয়েছে, সম্ভবত আমেরিকার চাপের মধ্যে ছিল।
৩ নভেম্বর দক্ষিণ ইথিওপিয়াতে এক সমাবেশে বক্তৃতা দেওয়ার সময়, আবে ‘জয়’ ঘোষণা করেন এবং বলেন তার পক্ষের প্রস্তাবগুলোর শতভাগ চূড়ান্ত চুক্তিতে পরিণত হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আশা করছেন যে এই চুক্তি ইথিওপিয়ার যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে বাঁচাতে এবং পুনর্গঠনের জন্য আরও দাতা গোষ্ঠী যেমন আইএমএফের প্রোগ্রাম দ্রুত পুনঃপ্রবর্তনের দিকে পরিচালিত করবে। তবুও এটি চুক্তির সাফল্যের ওপর নির্ভর করবে যা এরইমধ্যে ভঙ্গুর বলে মনে হয়। যদিও এর মধ্যে কয়েকটি যুদ্ধবিরতি আগেও হয়েছে।
বাস্তবে আফ্রিকান ইউনিয়ন, যারা আলোচনার আয়োজন করেছিল, তাকে গ্যারান্টর হিসাবে কাজ করতে হবে। কিন্তু এর চেয়ারপারসন মুসা ফাকিরের আবের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। মিকিয়েলে তেকুল, একজন তাইগ্রিয়ান যিনি দেশের বাইরে রয়েছেন, বলেন ‘আমাদের দেখতে হবে কি ঘটে। কিন্তু আমি আবে আহমেদকে বিশ্বাস করি না’।
যদি এই চুক্তিটি তাইগ্রের সঙ্গে যুদ্ধের সমাপ্তিকে চিহ্নিত করে, তবুও ইথিওপিয়ায় অন্যান্য দ্বন্দ্ব-সংঘাত এখনও ক্রমশ বেড়েই চলেছে। আবে আমহারার অনেকের বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, যারা বলে যে তারা দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রতিনিধিত্ব করেনি এবং উদ্বিগ্ন যে সরকার অবশেষে তাদের দখলকৃত বিতর্কিত অঞ্চলগুলো তাইগ্রেকে ফিরিয়ে দেবে। আমহারার সশস্ত্র মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোও আবের নিজ অঞ্চল ওরোমিয়ার কিছু অংশের সঙ্গে যুদ্ধ করছে।
আবের সরকার সেখানে বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে বলে মনে করার কম কারণ নেই।
ইথিওপিয়ার ইতিহাস সম্পর্কে সতর্ক হওয়ার আরেকটি কারণ আছে। ইরিত্রিয়ার বিরুদ্ধে এটি যে যুদ্ধ করেছিল, যা ১৯৯৮ সালে শুরু হয় এবং দুই বছরের মধ্যে অন্তত ১ লাখ মানুষের প্রাণ যায়। ২০০০ সালে আবার সমঝোতা হয়। ছয় মাস পর একটি পূর্ণ শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল দেশ দুটির মধ্যে। দুই দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও তা সঠিকভাবে এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট
এসএনআর/এমএস