আন্তর্জাতিক

কেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নিজের তুলনা দিচ্ছেন ইমরান খান

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) নেতা ইমরান খানের সাম্প্রতিক এক বক্তব্য ব্যাপক আলোচনা ও কৌতুহলের জন্ম দিয়েছে। ইমরান খান তার সাম্প্রতিক সরকারবিরোধী আন্দোলনকে তুলনা করেছেন ১৯৭০-৭১ সালে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আন্দোলনের সঙ্গে। আর পিটিআই’কে তুলনা করেছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে।

Advertisement

আগাম নির্বাচনের দাবিতে গত সপ্তাহ থেকে দলের বিপুলসংখ্যক কর্মী-সমর্থক নিয়ে লং মার্চ শুরু করেছেন ইমরান খান। বিভিন্ন শহর ঘুরে এই লং মার্চ পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে গিয়ে শেষ হওয়ার কথা। এরই মধ্যে গত বৃহস্পতিবার (৩ নভেম্বর) লাহোরের কাছে ওয়াজিরাবাদে তার গাড়িবহরে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। এসময় পায়ে গুলিবিদ্ধ হন পিটিআই। তিনি এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

সংবাদমাধ্যমের মনোযোগ এখন এই গুলিবর্ষণের ঘটনার দিকেই। কিন্তু দুদিন আগে এক জনসমাবেশে ইমরান খান যে মন্তব্য করেন, তা-ও পাকিস্তানের ভেতরে ও আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।

শেখ মুজিবের সঙ্গে নিজের তুলনাগুজরানওয়ালার ওই সমাবেশে ইমরান খান তার ভাষায় ‘প্রকৃত মুক্তির’ এই আন্দোলনকে তুলনা করেন ১৯৭০-৭১ সালে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আন্দোলনের সঙ্গে।

Advertisement

পর্যবেক্ষকদের মতে, এখানে তিনি এমন কিছু কথা বলেছেন, যা পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের মুখে সাম্প্রতিককালে শোনা যায়নি। ইমরান বলেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙে গিয়েছিল, কারণ একটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট পেলেও তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার অধিকার দেওয়া হয়নি।

তৎকালীন পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা ও পরবর্তীকালের প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত জুলফিকার আলি ভুট্টোর প্রতি ইঙ্গিত করে সাবেক ক্রিকেটার বলেন, একজন চতুর ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদ তৎকালীন নির্বাচনে বিজয়ী বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের (আওয়ামী লীগ) বিরুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছিল, যার ফলে দেশ দু-টুকরো হয়ে যায়।

নিজের দল পিটিআই’কে আওয়ামী লীগের সাথে তুলনা করে ইমরান খান বলেন, তার পার্টিই ‘বৃহত্তম এবং একক কেন্দ্রীয় দল’। তবু সরকার তাকে নতুন নির্বাচনের সুযোগ দিচ্ছে না।

তিনি বলেন, সবাই জানে, শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার দল ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে জিতেছিল। কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে একজন চতুর রাজনীতিবিদ আওয়ামী লীগ ও সামরিক বাহিনীকে সংঘাতের পথে ঠেলে দেন... আর এখন নওয়াজ শরিফ এবং আসিফ জারদারি একই ধরনের ভুমিকা পালন করছেন। তারা চেষ্টা করছেন এস্টাব্লিশমেন্টের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে পিটিআই’র ক্ষমতায় ফেরার পথ আটকে দিতে।

Advertisement

মজার বিষয় হচ্ছে, এসব কথা শোনা গেলো এমন একজন পাকিস্তানি রাজনীতিবিদের মুখে, যার নিজের সম্পর্কেই একসময় বলা হতো, দেশটির ক্ষমতাধর সামরিক বাহিনীর প্রচ্ছন্ন আশীর্বাদ নিয়েই তিনি রাজনীতিতে এসেছেন এবং প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তার সরকারকে সমালোচকরা বলতেন ‘হাইব্রিড’ সরকার। এমনকি পরে সেই ‘সুসম্পর্ক’ খারাপ হওয়ার জল্পনাও ছিল দুনিয়াজোড়া সংবাদমাধ্যমে বড় খবর।

কী ঘটেছিল ১৯৭০’র নির্বাচনেইমরান খান যে নির্বাচনের কথা বলেছেন, তা হয়েছিল ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর। পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিমাংশে মোট ৩০০টি আসনে ভোটাভুটি হয়েছিল।

নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টিতে জয়ী হয়। জুলফিকার আলি ভুট্টোর পিপিপি পশ্চিম পাকিস্তানে জয়ী হয় ৮১টি আসনে।

ফলে সেই নির্বাচনে শুধু পূর্ববঙ্গে নয়, গোটা পাকিস্তানেই সার্বিকভাবে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং ভুট্টো নানা কৌশল করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় যেতে দেননি। ফলে বাঙালিদের তীব্র বিক্ষোভ স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নেয় এবং পরবর্তীতে নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের পর আত্মপ্রকাশ ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের।

কী প্রেক্ষাপটে এই তুলনা?২০১৮ সালের নির্বাচনে জিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ইমরান খান। তখন তাকে দেখা হতো এমন একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে, যিনি সাবেক ক্রিকেটারের হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন এবং তার প্রতি পাকিস্তানের ‘এস্টাব্লিশমেন্টের’ গোপন সমর্থনও ছিল।

পাকিস্তানে শক্তিশালী সামরিক বাহিনীকে বোঝাতে এস্টব্লিশমেন্ট কথাটি ব্যবহার করা হয়, যারা পর্দার পেছনে থেকে রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। কিছুদিন আগে পিটিআই ত্যাগকারী এক নেতা বলেছিলেন, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীই ‘ইমরান খানকে তৈরি করেছে এবং তাকে ক্ষমতায় এনেছে।’

কিন্তু ক্ষমতাগ্রহণের কিছুদিন যেতে না যেতেই সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ইমরান খানের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। কিছু পর্যবেক্ষকের মতে, ২০২১ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানের একটি গোয়েন্দা সংস্থার নতুন প্রধানের নিয়োগ অনুমোদন করে সই দিতে অস্বীকার করেছিলেন ইমরান খান। এটি তার সামরিক বাহিনীর সমর্থন হারানোর একটি কারণ।

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার রশিদ বাজওয়া। ছবি সংগৃহীত

ইমরানের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষগুলো এ পরিস্থিতির সুযোগ নিতে ছাড়েনি। গত এপ্রিল মাসে তার বিরুদ্ধে আনা একটি অনাস্থা ভোটের সময় তেহরিক-ই-ইনসাফের বেশ কিছু এমপি দলত্যাগ করায় পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারান পিটিআই চেয়ারম্যান।

এরপর থেকেই ইমরান খান বলে আসছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সরকারকেও তিনি বলে থাকেন, এটি হচ্ছে ‘ইমপোর্টেড’ বা আমদানিকৃত সরকার।

‘নজিরবিহীন ঘটনা’পাকিস্তানের সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মানসুর মালিক বলেন, সম্প্রতি সামরিক বাহিনীকে লক্ষ্য করে ইমরান খান আরও বেশি আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিচ্ছিলেন। বিশেষ করে, আরশাদ শরিফ নামে একজন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের পর তার কথাবার্তার প্রেক্ষাপটে আইএসআইএ প্রধান এক সংবাদ সম্মেলন করেন। পাকিস্তানের ইতিহাসে এর আগে কখনো এমনটি ঘটেনি।

এ ধরনের বক্তব্যের ধারাবাহিকতাতেই ইমরান খান তার লং মার্চ কর্মসূচি শুরুর পর ১৯৭০-৭১’র প্রসঙ্গ তুলে সামরিক বাহিনীকে লক্ষ্য করে আরও একদফা আক্রমণ শানালেন। পাকিস্তানে ১৯৭০-৭ ‘র ঘটনাবলী নিয়ে নানা সময় নানাভাবে আলোচনা-বিতর্ক হয়েছে, কিন্তু ওই ঘটনাবলীর সঙ্গে দেশটির বর্তমান পরিস্থিতির তুলনা, তা-ও আবার একজন রাজনীতিবিদের মুখ থেকে- কখনো শোনা যায়নি।

মানসুর বলেন, ইমরান খান নিজেকে তুলনা করছেন শেখ মুজিবের অবস্থানের সঙ্গে, আর শাহবাজ শরিফ ও আসিফ আলি জারদারিকে তুলনা করছেন জুলফিকার আলি ভুট্টোর সঙ্গে।

কেন এমন তুলনা?লন্ডনের কিংস কলেজের অধ্যাপক এবং পাকিস্তানের রাজনীতির বিশ্লেষক আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, পাকিস্তানের সমাজে একটি শিক্ষিত ও বুদ্ধিবৃত্তিক অংশ রয়েছে, যারা ১৯৭০-৭১ সালে যা ঘটেছিল তাকে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসের আলোকেই দেখেন। তবে ইমরান খান এখন একে ভিন্নভাবে তুলে ধরতে চাইছেন তার নিজের সুবিধার জন্যই।

তিনি বলেন, পাকিস্তানে এখনো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যেভাবে ১৯৭১’র ঘটনাবলী বর্ণনা দেওয়া হয়. তাতে একে ‘ভারতের ষড়যন্ত্র’ বলে তুলে ধরা হয়। কিন্তু ইমরান খান বলছেন, তখন যা ঘটেছিল এবং এখন যা ঘটছে তার জন্য সামরিক বাহিনীই দায়ী। তারা ১৯৭১ সালে শেখ মুজিবকে বঞ্চিত করেছিল এবং এখন তাকে অর্থাৎ ইমরান খানকে বঞ্চিত করছে।

আয়েশা বলেন, ইমরান খান এমন এক সময় এ নিয়ে কথা বলছেন, যখন পাকিস্তানের একটি প্রজন্ম সামরিক বাহিনীর এই চ্যালেঞ্জ নিয়ে উদ্বিগ্ন। তিনি এর সুযোগ নিচ্ছেন এবং মানুষকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন ১৯৭১ সালে কী হয়েছিল।

বিশ্লেষক মানসুর মালিকের মতে, ইমরানের লক্ষ্য নতুন নির্বাচনের জন্য চাপ সৃষ্টি করা। তিনি বলেন, ইমরান খান ১৯৭১’র প্রসঙ্গ তুলেছেন একটাই উদ্দেশ্যে- সামরিক এস্টাব্লিশমেন্ট ও সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, যেন নতুন নির্বাচন দেওয়া হয়। কারণ ইমরান মনে করেন, নির্বাচন হলে তিনিই জিতবেন।

পাকিস্তানে আগামী নির্বাচন হবার কথা ২০২৩ সালের অক্টোবর নাগাদ। তবে পিপিপি এবং মুসলিম লিগ (নওয়াজ) কেউই তার আগে নির্বাচন হোক তা চায় না।

সে কারণে ইমরান খান বলছেন, দরকার হলে তিনি এক বছর ধরেই তার এই লংমার্চ চালিয়ে যাবেন।

এই তুলনা কতটা সঠিক?আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, ইমরান খান ১৯৭০’র নির্বাচন-পরবর্তী বাস্তবতার সঙ্গে বর্তমান পাকিস্তানের যে তুলনা দিচ্ছেন, তা সঠিক নয়। বর্তমানে ইমরান খানের জনপ্রিয়তা বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু তার দল এখনো পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল নয়।

তিনি বলেণ, পাঞ্জাবসহ কিছু এলাকায় তেহরিক-ই-ইনসাফের জনপ্রিয়তা বেড়েছে, কিন্তু সব জায়গায় নয়। যেমন- ইমরান খানের জনপ্রিয়তার কারণে পাঞ্জাবে নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগের ভোট হয়তো খানিকটা কমেছে, কিন্তু তার পরিমাণ খুব বেশি নয়। সিন্ধ প্রদেশে পিপিপির ক্ষেত্রেও তাই। এ জন্যই ১৯৬০’র দশক বা ১৯৭০ সালের শেখ মুজিবের সঙ্গে ইমরান খানের তুলনা নির্ভুল নয়।

তবে একটি ক্ষেত্রে তার এই তুলনার কিছুটা যৌক্তিকতা রয়েছে। তা হলো, সামরিক এস্টাব্লিশমেন্ট ইমরান খানের জনপ্রিয়তায় ভীত এবং তারা ও তাদের সহযোগী রাজনৈতিক দলগুলোও এখন নির্বাচন দিতে চায় না।

সূত্র: বিবিসি বাংলাকেএএ/