মতামত

রাজনৈতিক দলের নামে তামাশা?

রাজনৈতিক দল যদি জনগণের জন্য হয়, তাহলে তার সঙ্গে জনসাধারণের সম্পর্ক কী হওয়া উচিত, সেই ভাবনাটা বড় প্রয়োজন। রাজনৈতিক দল নিশ্চয়ই আর পাঁচটা বেসরকারি সংগঠনের মতো নয়, তারা জনপরিসরের প্রতিষ্ঠান। রাজনীতি মানেই হলো জনসমর্থন পাওয়ার জন্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা এবং সে কারণে দলের প্রতিটি কাজের জন্য জনসাধারণের কাছে তাদের জবাবদিহির দায় থাকা উচিত।

Advertisement

বাংলাদেশে সম্ভবত রাজনীতি নিয়ে ভিন্ন কোন ভাবনা আছে। না হলে এমন তামাশা হয়? এ বছর নির্বাচন কমিশনের কাছে যে ৯৮টি দল নিবন্ধন চেয়েছে, তাদের নাম শুনেই মানুষ এখন হাসছে। এগুলোর মধ্যে আছে বাংলাদেশ ইত্যাদি পার্টি, বৈরাবৈরী পার্টি, নৈতিক সমাজ, মুসকিল লীগ, নাকফুল বাংলাদেশ। নামেই বোঝা যায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে কতটা তামাশার চোখে দেখা হচ্ছে। বড় রাজনৈতিক দলের নেতা ও নেত্রীরা হয়তো কর্ণপাতও করবেন না, কিন্তু তাদের কারণেই যে যথার্থ রাজনীতির চর্চা না হয়ে রাজনীতির নামে এই হাস্যরস লিপিবদ্ধ হচ্ছে সেটা মনে রাখা জরুরি।

গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলকে জনসাধারণের সমর্থন নিয়ে চলতে হয়। কিন্তু এরা কারা? নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের বিষয়ে খসড়া আইন ও বিদ্যমান আইনে যেসব শর্ত রয়েছে এসব আবেদনকারীর অনেকে সেসব পড়ে দেখেছেন বলেও মনে হয় না। নিবন্ধন পাওয়ার শর্ত হলো সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয় থাকা, অথচ অনেকেই ঢাকায় পার্টি সভাপতির বাসা-বাড়িকেই দলের অফিস বলে চালিয়ে দিচ্ছেন।

২১ জেলায় কার্যকর কমিটি এবং অন্তত ১০০ উপজেলা বা মেট্রোপলিটান থানায় নিদেনপক্ষে ২০০ ভোটারের সমর্থনসংবলিত দলিল থাকা। এর ধারেকাছেও অনেকে নেই এরা। কমপক্ষে একজন এমপি থাকা বা আগে কোন নির্বাচনে দলকে মোট পাঁচ শতাংশ ভোট পাওয়ার কথাও আছে শর্তে।

Advertisement

একটি বা দুটি নয়, ৯৮টি দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে, নাম তাদের যাইই হোক। প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে ভোটাধিকার প্রাপ্ত প্রতিটি নাগরিকের রাজনীতি করা, সংগঠন করা, রাজনৈতিক দল করার গণতান্ত্রিক অধিকার আছে। কিন্তু তাই বলে রাজনৈতিক দলের এমন উচ্চ ফলনশীল জাত আর কোন দেশে আছে কিনা জানা নেই। বলতেই হবে যে, বাংলাদেশ এদিক থেকে অনেক বেশি ঊর্বর।

এর আগে দশম সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আগ্রহী নতুন ৪৩টি রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের আবেদন করেছিল। এর মধ্যে ৪১টিই নির্বাচন কমিশনের কাছে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়। মাত্র দুটি দল শর্ত অনুযায়ী মাঠপর্যায়ে কার্যালয় ও কমিটি থাকার তথ্য দিয়েছিল। এরপর তাদের নিবন্ধন দেয় কমিশন। দল দুটি হল- বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) ও সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট।

অসুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমাদের দেশে সর্বগ্রাসী দলতন্ত্র কায়েম করেছে। দলতন্ত্রের অভিধানে নৈতিক দায়দায়িত্বের কোনও স্থান নেই। দলীয় রাজনীতির যে রূপ এখন প্রকট, সেটাই বোধ করি যাকে তাকে রাজনৈতিক দল গড়ার এমন মানসিক প্রশ্রয় দিয়েছে।

বহুবিধ কারণে বাংলাদেশের ভোটাররা রাজনৈতিক দলের কাছে দায়বদ্ধতার প্রত্যাশা হারিয়ে ফেলেছেন। আর রাজনৈতিক দলগুলো তো মানুষকে কোন বিষয়ই মনে করেনা। তাই এমন হাস্যকর নামধাম নিয়ে যারা দল গড়তে নির্বাচন কমিশনের কাছে হাজির হয়েছেন তারা ধরেই নিয়েছেন যে, রাজনৈতিক দল মানেই এমন। একটা নাম থাকলেই হলো, যদি প্রভাব বিস্তার করা যায় তাহলে অর্থ, বিত্ত ও সম্পদের অভাব হবেনা। ক্ষমতা হাতে থাকলে যথেচ্ছ আচরণও করা যাবে।

Advertisement

নির্বাচন কমিশনকেও ভাবতে হবে কী করণীয়? প্রথমেই বলতে হয় যে, সারাবছরই রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন প্রক্রিয়া চালু রাখা উচিত। আবেদন চালু থাকবে এবং পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যেগুলো শর্ত পূরণ করবে না, তাদের প্রাথমিক তালিকা থেকেই বাদ দিতে হবে। যদি গ্রহণযোগ্য হয় তাহলে থাকবে। এতে করে পাঁচ বছর পর পর এত এত নাম দেখতে হবেনা।

নিবন্ধনের জন্য রাজনৈতিক দলের দরখাস্ত করার আগের দুই নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নিয়ে অংশগ্রহণ ও কমপক্ষে একটি আসন প্রাপ্তির শর্ত এবং অংশগ্রহণকৃত আসনের মোট ভোটের পাঁচ ভাগ ভোট পাওয়ার শর্ত নিয়েও ভাবা দরকার। এর সংশোধন প্রয়োজন। একেবারে নতুন দল হলে তো এমপি পদ বা পাঁচ শতাংশ ভোট পাওয়ার কোন কারণই নেই। কমিশনকে আরেকটি বিষয় ভাবতে হবে যে, প্রয়োজনে বিধি করে কিছু দলকে শুধু আঞ্চলিক রাজনীতি করার অনুমোদন দেয়া যেতে পারে।

আমাদের রাজনীতির কারবারিরা বহুবছর দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং সমাজের পক্ষে হানিকর আচরণই করে এসেছেন। ফলে রাজনীতি এবং তারা নিজেরা হাসির উপকরণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন মানুষের কাছে। সেটারই প্রমাণ এমন সব নাম।

একটি রাজনৈতিক দলকে জনসম্পৃক্ত হতে হয়। এবং সেটা গড়তে একটি দলকে ধারাবাহিকভাবে জনতার পাশে থাকতে হয়। আবেদনকারীরা হয়তো বুঝতেই পারেননি, রাজনৈতিক দল একেকটি প্রতিষ্ঠান যারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে দেশ চালায়, দেশের ভেতরকার শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর প্রতিষ্ঠান গুলো পরিচালনা করে।

সবারই সংগঠন বা দল করার অধিকার আছে, তাই বলে এভাবে? কথাটা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অন্ধকার আদিগন্ত বিস্তৃত হলেই কেবল রাজনীতি এমন তামাশার বিষয় হতে পারে।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।

এইচআর/জেআইএম