ধর্ম

ইসলামে আলেমদের সম্মান ও মর্যাদা

ফখরুল ইসলাম নোমানী

Advertisement

একজন আলেম দেশ ও জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ । মূল্যবান সম্পদ হারিয়ে গেলে মানুষ যেমন দিশেহারা হয়ে যায় তেমনি কোনো আলেম চলে গেলে পুরো দেশ ও সমাজ দিশেহারা হয়ে যায়। এসব আলেম-ওলামা না থাকলে মানুষ সঠিক পথ দিকনির্দেশনা পাবে না। পৃথিবীর সব মানুষ মনুষ্যত্ব ভুলে গিয়ে চতুষ্পদ জন্তুতে পরিণত হয়ে যাবে। তাই ইসলামে আলেম-ওলামাদের সম্মান ও মর্যাদা সর্বোচ্চ।

প্রকৃত আলেমদের মর্যাদা আল্লাহর কাছে অতি উচ্চে। সাধারণ মানুষের মাঝে আলেমরা হলেন নক্ষত্রতুল্য। যাদের অনুসরণ করার মাধ্যমে মানুষ সঠিক পথের সন্ধ্যান পেয়ে থাকে। আলেমরা আল্লাহর ওলি বা বন্ধু । তাঁদের সঙ্গে বিদ্বেষ পোষণ করা আল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধ করার শামিল। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তাআলা বলেন, যে ব্যক্তি আমার কোনো ওলির বা বন্ধুর সঙ্গে শত্রুতা করবে আমি তার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করলাম। (বুখারি ৬৫০২)

নবি-রাসুলদের উত্তরাধিকার

Advertisement

আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন । তাদের সম্মানিত করেছেন ওহির জ্ঞান ও জীবন-বিধান দিয়ে । সেই ওহির জ্ঞান ও বিধি-বিধান মানবজাতির কাছে পৌঁছানোর জন্য তিনি প্রেরণ করেছেন যুগে যুগে অসংখ্য নবি-রাসুল। তাঁরা ছিলেন জগতবাসীর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক বড় করুণা ও রহমতস্বরূপ। আল্লাহর রহমতের সেই নবুয়তি ধারা হজরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু হয়ে হজরত মুহাম্মাদু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে শেষ হয়েছে। তিনি ছিলেন সর্বশেষ নবি। তাঁর পর আর কোনো নবি এই দুনিয়াতে আগমন করবেন না। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলেমদের তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আলেমরাই হলেন নবিদের উত্তরাধিকারী।’ 

আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষ্যদাতা

যুগে যুগে যাঁরা নবিদের জ্ঞান ধারণ করে আসছেন তাঁরাই যুগের হক্কানি ওলামায়ে কেরাম। যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আজ আমাদের মাঝে এসে পৌঁছেছে তাফসির, হাদিস, ফিকহ ও অন্যান্য ইসলামি শাস্ত্রের সুবিন্যস্ত বিশাল গ্রন্থাবলি। আল্লাহ তাআলা তাঁদের বানিয়েছেন নিজ একত্ববাদের অন্যতম সাক্ষী। তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ সাক্ষ্য দিয়েছেন যে তিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই । ফেরেশতারা এবং ন্যায়নিষ্ঠ আলেমরাও সাক্ষ্য দিয়েছেন যে তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১৮)

আলেমরা সম্মানিত

Advertisement

হজরত উবাদা ইবনে সামেত রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ওই ব্যক্তি আমার আদর্শের ওপর নেই যে আমাদের বড়দের সম্মান করে না, ছোটদের স্নেহ করে না এবং আমাদের আলেমদের প্রাপ্য মর্যাদা প্রদান করে না।

মৃত্যুর পরও আলেমের নেক আমল জারি থাকে

মানুষ মৃত্যুবরণ করার সঙ্গে সঙ্গে তার আমল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আলেমদের আমল জারি থাকে। একজন আলেম জীবিত অবস্থায় ইলম বিতরণ করার কারণে অনেকে উপকৃত হয়েছেন। সেজন্য মৃত্যুবরণ করার পরও তার সওয়াব তিনি পেতে থাকবেন । এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত সাহাবি আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন,  রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, মানুষ যখন মারা যায় তখন তার আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি উৎস থেকে তা অব্যাহত থাকে : সদকায়ে জারিয়া, উপকারী ইলম ও নেক সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।’ (মুসলিম ৪৩১০)

সকল সৃষ্টি আলেমের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে

কুরআন-সুন্নাহর ইলম সমৃদ্ধ ব্যক্তির জন্য বড়ই সুসংবাদ যে, তার জন্য আল্লাহর কাছে সকলেই ক্ষমা প্রার্থনা করে। হজরত আনাস ইবনু মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ইলমের অধিকারী ব্যক্তির জন্য সব কিছুই ক্ষমা প্রার্থনা করে। এমনকি সমুদ্রের মাছও । আল্লাহ তাআলা আলেমদের শান ও মর্যাদাকে সমুন্নত করেছেন কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘আল্লাহ তাআলা স্বাক্ষ্য দিচ্ছেন যে তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, এবং ফেরেশতাগণ, আলেমগণ ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৩)

আলেমদের আনুগত্য

 তাঁরা আম্বিয়ায়ে কেরাম থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানকে মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তাঁদের কাছেই মানুষ পায় কোরআন-সুন্নাহর জ্ঞান। নিজের প্রভুকে চিনতে পারে, শিখতে পারে আল্লাহর বিধি-বিধান। বুঝতে পারে শরিয়তকে। মানতে পারে হালাল-হারামকে। তাঁদের মাধ্যমেই মানুষ খুঁজে পায় নিজের আসল পরিচয়। যাঁদের সংস্পর্শে এসে অন্ধকার জগতের মানুষগুলো সন্ধান পায় আলোকিত জীবনের। মৃত হৃদয়গুলো হয় পুনর্জীবিত। তাঁরা পৃথিবীর জন্য রহমত। তাঁরা উম্মতের জন্য বরকত। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর নির্দেশ মান্য করো, অনুসরণ করো রাসুলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা কর্তৃত্বসম্পন্ন (ন্যায়পরায়ণ শাসক ও আলেম) তাদের।’ (সুরা নিসা : আয়াত ৫৯)

আলেমদের কাছে জিজ্ঞাসা

আলেমদের কাছেই ইসলাম সবার আগে। তাঁরা দ্বীনের অতন্দ্র প্রহরী। দ্বীন রক্ষার ঢাল ও সুদৃঢ় প্রাচীর। ইসলামের বিরুদ্ধে সব ধরনের ষড়ষন্ত্রের মোকাবেলায় তাঁরা সর্বদা সচেষ্ট। তাঁরা নিজেদের সর্বশক্তি ব্যয় করে সব ধরনের বাতিল মতবাদকে রুখে দেওয়ার জন্য সর্বদা অক্লান্ত প্রয়াস চালিয়ে যান। তাঁরা হক কথা বলতে দ্বিধাবোধ করেন না। হক প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জান-মাল ব্যয় করাটা গৌরব মনে করেন। বাতিলের মুখোশ উন্মোচন করতে কালক্ষেপণ করেন না। তাঁদের হাতেই জিন্দা হয় সুন্নত। দূরীভূত হয় বিদআত। যে কোনো শরয়ি সমস্যা নিরসনে তাঁদের দ্বারস্থ হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মহান আল্লাহ তাআলা নিজেই। তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘অতএব আলেম-জ্ঞানীদের জিজ্ঞাসা করো, যদি তোমাদের জানা না থাকে।’ (সুরা নাহল : আয়াত ৪৩)

আলেমদের মর্যাদা

হজরত উবাদা ইবনে সামেত রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন ওই ব্যক্তি আমার আদর্শের ওপর নাই, যে আমাদের বড়দের সম্মান করে না, ছোটদের স্নেহ করে না এবং আমাদের আলেমদের প্রাপ্য মর্যাদা প্রদান করে না। আবু মুসা আশআরি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, বৃদ্ধ মুসলমান কোরআনের আদব রক্ষাকারী ও কোরআন অনুযায়ী আমলকারী হাফেজ এবং ন্যায়পরায়ণ বাদশাহর সম্মান করা মহান আল্লাহর সম্মান করার অন্তর্ভুক্ত।’

ইমাম হাফেজ আবুল কাসেম ইবনে আসাকির রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, হে ভাই, জেনে রাখো! উলামায়ে কেরামের দোষ চর্চা করা বিষাক্ত জিনিস। আল্লাহ তাআলার অভ্যাস হলো উলামায়ে কেরামের কুৎসা রটনাকারীকে তিনি লজ্জিত করেন (এটা কারো অজানা নয়) । যে ব্যক্তি উলামায়ে কেরামের সমালোচনা করবে আল্লাহ তার মৃত্যুর আগে তার অন্তরকে মৃত বানিয়ে দেবেন ।

উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা মোটেও বলা অত্যুক্তি হবে না যে আলেম-ওলামাদের মর্যাদা ও সম্মান অনেক বেশি। তাদের সঙ্গে বেয়াদবি, তাদের কষ্ট দেওয়া ও নির্যাতন করা গুনাহের কাজ। এর জন্যে দুনিয়া ও আখিরাতে কঠিন জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে ।

অতএব আলেমদের সম্মান ও মর্যাদা দান সবার অবশ্যক কর্তব্য। আলেম-ওলামাদেরকে সম্মান ও মর্যাদা দানের মাধ্যমে দুনিয়া ও পরকালে আল্লাহর ভালোবাসা ও নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভালোবাসা পাওয়া সম্ভব।

লেখক : ইসলামি চিন্তক ও গবেষক।

এমএমএস/জিকেএস