মতামত

‘এই সংবিধান শহীদের রক্তে লিখিত’

সংবিধান হলো যে কোনো রাষ্ট্রের মূল ও সর্বোচ্চ আইন, যা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য লিখিত ও অলিখিত বিধিবিধানের সমষ্টি। অন্যভাবে বলা যায় একটি রাষ্ট্রের দর্পণ বা প্রতিচ্ছবি। যার মধ্যে একটি জাতি, দেশ ও রাষ্ট্রের জীবন পদ্ধতি মূর্ত হয়ে ওঠে অর্থাৎ সরকারের ক্ষমতা চর্চার শাখাগুলো সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।

Advertisement

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটলের মতে, ‘সংবিধান হলো এমন একটি জীবন পদ্ধতি যা রাষ্ট্র স্বয়ং বেছে নিয়েছে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবিধানই আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠা করে এবং নাগরিক স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার রক্ষা করে’। অধ্যাপক ফাইনারের মতে, ‘মৌল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সুষম ব্যবস্থাই সংবিধান।’

সংবিধানবিহীন কোনো স্বাধীন, সার্বভৌম ও সভ্য রাষ্ট্র চলতে পারে না। ইতিহাস পাঠে জানা যায় যে, মানব সভ্যতার প্রথম সমাজ হিসেবে পরিগণিত গ্রিক সমাজে দাস প্রথা প্রচলিত ছিল এবং তা স্বাভাবিক হিসেবেও সমর্থিতও হয়েছিল। সেখানে দাসগণের কোনো অধিকার ছিল না।

দাসগণ ছাড়া সব নাগরিকই শাসনকার্যে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতো। বিভিন্ন প্রচীন গ্রিক নগর-রাষ্ট্রের সংবিধানসমূহ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, যে সব বিশ্বাস এবং ধ্যান ধারণা অনুযায়ী ওই সব সমাজ পরিচালিত হয়েছিল তা সেখানকার সংবিধানগুলোতে প্রতিফলিত হয়েছিল।

Advertisement

এথেন্স ও স্পার্টা নগরীর দুটির সংবিধানই এর দৃষ্টান্ত বিশেষ। সামন্ততান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী সমাজের এবং সংবিধান সেই ধরনের ‘ক্ষমতাগত সম্পর্ক’ প্রকাশ করে। কিন্তু সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধানে সর্বহারাগণই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং বুর্জোয়াগণের কোনো অধিকার নেই। সর্বহারাগণই সব প্রকার সুযোগ-সুবিধা লাভের অধিকারী হবে এমনভাবেই সেখানে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়।

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সংবিধান ভারতের আর ছোট সংবিধান (মাত্র ১৫-১৬ পাতা) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের; তবে ছয় হাজার শব্দের বেশি নয়। ১৭৭৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত তাদের সংবিধান ২৬ বার সংশোধিত হয়েছে। যুক্তরাজ্যের সংবিধান অলিখিত।

আমাদের মহান ও পবিত্র সংবিধান লিখিত, দুষ্পরিবর্তনীয়, মৌলিক অধিকার দ্বারা স্বীকৃত, এককক্ষ বিশিষ্ট আইন সভা, ১৫৩টি অনুচ্ছেদ, ১১টি ভাগ, ৪টি মূলনীতি, ৭টি তফসিল, ১টি প্রস্তাবনাসহ পরিপূর্ণ একটি সংবিধান। তবুও কারণে বা অকারণে ক্ষমতাসীনদের প্রয়োজনে আজ পর্যন্ত এ সংবিধানে ১৫ বার সংশোধনী আনা হয়েছে। আমরা প্রতি বছরের ৪ নভেম্বর ‘সংবিধান দিবস’ হিসেবে পালন করি।

সংবিধান দিবস নিয়ে বলতে হলে একটু পেছনের কথা বলতে হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের দিন। এ দিন জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখে বাংলাদেশ ও ভারতের মিত্রবাহিনীর নিকট রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) প্রায় ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করার সাথে সাথেই বাংলাদেশ কার্যত স্বাধীন হয়।

Advertisement

১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার মুজিবনগর হতে ঢাকায় এসে শাসনক্ষমতা গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি দান করেন।

বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’ তার ওপর অর্পিত ক্ষমতাবলে ‘আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ’ জারি করেন। এ আদেশ ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর হয়।

এ আদেশ বলে পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামো থেকে প্রাপ্ত সব আইনকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের অধীনে বৈধতা দান করা হয়। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ অনুযায়ী দেশ শাসিত হতে থাকে। সেখানে রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল তার পরিবর্তে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করা হয়।

রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফেরার পর কালবিলম্ব না করে একটি সংবিধান প্রণয়ন করে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ’ জারি করেন। এ আদেশ ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর হবে বলে ঘোষণা করা হয়।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত ৪৬৯ জন সদস্যদের মধ্যে (জাতীয় পরিষদের ১৬৯+প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০=৪৬৯ জন) ৪০৩ জন সদস্য নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হয়। কেননা ৪৬৯ জন সদস্যের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিহত হয়েছিলেন ১২ জন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দালালির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন ৫ জন, দুর্নীতির দায়ে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন ৪৬ জন, পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন দুজন (ভাষা আন্দোলনের খুনি নুরুল আমীন ও স্বতন্ত্র সদস্য রাজ ত্রিদির রায়) পররাষ্ট্র মন্ত্রাণালয়ে চাকরি গ্রহণ করেছিলেন একজন।

এই ৪০৩ জন গণপরিষদ সদস্যের মধ্যে ৪০০ জন ছিলেন আওয়ামী লীগ দলীয়, একজন ছিলেন ন্যাপের (মোজাফ্ফর) এবং বাকি দুজন ছিলেন নির্দলীয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন আহ্বায়ন করেন। অধিবেশনের প্রথম দিনে গণপরিষদের সদস্যরা কর্তৃক স্পিকার নির্বাচিত হন শাহ আব্দুল হামিদ ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন মোহাম্মদ উল্লাহ্।

১১ এপ্রিল ড. কামাল হোসেনকে সভাপতি করে ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। এই ৩৪ জনের মধ্যে ৩৩ জন ছিলেন আওয়ামী লীগের দলীয় গণপরিষদ সদস্য এবং একজন ন্যাপ (মোজাফ্ফর) সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, একজন মহিলা গণপরিষদ সদস্য (বেগম রাজিয়া বানু) ওই কমিটির অন্তর্ভুক্ত হয়।

এই খসড়া কমিটির প্রথম বৈঠক বসে ১৯৭২ সালের ১৭ এপ্রিল। এই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জনমত আহ্বান করা হয়। খসড়া কমিটির সর্বমোট ৪৭টি বৈঠকে ৩০০ ঘণ্টা ব্যয় করে তাঁদের খসড়া চূড়ান্ত করে। ১৯৭২ সালের ১০ জুন কমিটি প্রাথমিক খসড়া প্রণয়ন করে। এরপর কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন ভারত ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে গিয়ে সংবিধান বেত্তাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে মূল্যবান অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন।

প্রস্তাবিত সংবিধানের বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে ১৯৭২ সালের ১১ অক্টোবর কমিটির শেষ বৈঠকে খসড়া সংবিধানের চূড়ান্ত রূপ গৃহীত হয়। ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন বসে। এ অধিবেশনে ড. কামাল হোসেন খসড়া সংবিধান বিল আকারে গণপরিষদে উত্থাপন করেন। ১৯ অক্টোবর সংবিধানের ওপর প্রথম পাঠ শুরু হয় এবং ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত চলে।

এতে মোট ১০টি বৈঠকে ৩২ ঘণ্টা সময় ব্যয় হয়। অতএব ৩১ অক্টোবর দ্বিতীয় পাঠ শুরু হয় এবং ৩ নভেম্বর পর্যন্ত চলে। ৪ নভেম্বর সংবিধানের ওপর তৃতীয় ও সর্বশেষ পাঠ শুরু হয়। মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে এ কাজ শেষ হয়। ওই দিনটি ছিল ইতিহাসের মাহেন্দ্রক্ষণ (বেলা ১:৩০ মিনিট)। বিপুল আনন্দ তুমুল করতালী ও হর্ষধ্বনির মধ্যে বাংলাদেশ সংবিধান গণপরিষদ কর্তৃক পাস এবং তা চূড়ান্ত ভাবে গৃহীত হয়।

সেদিন গণপরিষদের সংবিধানের ওপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, এই সংবিধান শহীদের রক্তে লিখিত, এ সংবিধান সমগ্র জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকবে। এখানে উল্লেখ্য যে, পাকিস্তান সংবিধান প্রণয়ন করতে সময় লেগেছিল প্রায় নয় বছর (১৯৪৭-১৯৫৬), ভারতের সময় লেগেছিল প্রায় তিন বছর (১৯৪৭-১৯৪৯), কিন্তু বঙ্গবন্ধু সরকার মাত্র ১০ মাসে বাংলাদেশকে একটি সংবিধান উপহার দিতে সক্ষম হন।

লেখক: সাংবাদিক।

ফারুক/এমএস