মতামত

মাদক ও জুয়া: ধ্বংস করে সুখি-সমৃদ্ধ পরিবার

আজ নগর থেকে শুরু করে নিবিড় পাড়াগাঁয়েও ছড়িয়ে পড়ছে মাদক ও জুয়ার ছোবল। যুবসমাজ যেন আজ অস্থির আর তাই সমাজে বাড়ছে নানামুখী অস্থিরতা। নীতি আদর্শ এবং মূল্যবোধ যেন সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। সামাজিক অস্থিরতার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে অবক্ষয়ের শিকার হচ্ছে যুবসমাজ। অথচ তারা একটি দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। ইতিহাস ঐতিহ্য আর ক্রমবর্ধমান সভ্যতার ক্রমবিকাশের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে মানুষ তার আপন সত্তার কথা ভুলে গিয়ে জড়িয়ে পড়ছে নানান অপকর্মে।

Advertisement

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার নাম। সব সংঘাত সংঘর্ষের চিরন্তন ও মহাসমন্বয় হচ্ছে ইসলাম। জীবনাদর্শ, জীবন ব্যবস্থা ও জীবন বিধান হিসেবে ইসলামে রয়েছে সব সমস্যার সঠিক সমাধান। এতে রয়েছে জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি সমস্যার সমাধান আর মৃত্যুর পর আখেরাতের অনন্ত জীবনে নিশ্চিত সুখ-শান্তি লাভের উপায়।

ইসলাম মানুষের চলার পথের সন্ধানদাতা, উন্নত, সুখী ও সমৃদ্ধশালী জীবন এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি অর্জন তথা মানবজীবনের চরম লক্ষ্য হাসিলের একমাত্র পন্থা। এর ব্যাপ্তি জীবনের সর্বক্ষেত্রে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের সব ক্ষেত্রেই ইসলামের নিয়ন্ত্রণাধিকার।

তাই ইসলাম মানুষের সঠিক পথের দিশারী, দুনিয়া ও আখেরাতের সর্বাঙ্গীন ও পূণাঙ্গ একমাত্র জীবন ব্যবস্থা। শান্তিপূর্ণভাবে জীবন যাপনের জন্য আমাদের যা কিছু প্রয়োজন তাকে বৈধ করেছেন আর যা ক্ষতিকর তা থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তেমনিভাবে মদ ও জুয়া মানুষের জন্য ক্ষতি ও ধ্বংস ছাড়া কিছুই বয়ে আনে না আর এ কারণেই আল্লাহ এই পাপ থেকে দূরে থাকার আদেশ করেছেন। জুয়াবাজি একটি ঘৃণিত ও গর্হিত কাজ। একটি মারাত্মক সামাজিক অপরাধ। জুয়াড়ির জীবন-সংসার কুরে কুরে বিনষ্ট হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে তা সম্পূর্ণ অবৈধ ও হারাম। এ ব্যাপারে কোনো আলেম দ্বিমত পোষণ করেন নি।

Advertisement

ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে এবং মহানবির (সা.) আগমনের সময় তৎকালীন মক্কায় নানা ধরনের জুয়ার প্রচলন ছিল এবং মদ ও জুয়ায় তারা মত্ত থাকত। কুরআনে মদ ও জুয়াকে ঘৃণ্য বস্তু এবং শয়তানের কাজ বলা হয়েছে। এগুলো থেকে দূরে থাকার আদেশ দেওয়া হয়েছে। মদ-জুয়ার মাধ্যমে পরস্পর শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়। উপরন্তু এগুলোর মাধ্যমে শয়তান মানুষকে নামাজ ও আল্লাহতায়ালার স্মরণ থেকে বিমুখ রাখে।

মদ-জুয়া হারাম হওয়ার বিষয়টি অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই। বর্তমান সমাজে লটারি, হাউজি, বাজি ধরা, চাক্কি ঘোরানো, রিং নিক্ষেপ প্রভৃতি নামে নানা ধরনের জুয়ার প্রচলন রয়েছে। এগুলো কখনও মানুষের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। জুয়ার যাবতীয় প্রক্রিয়াকে হারাম এবং নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে। তুমি বল এ দুটোতে রয়েছে মহাপাপ।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২১৯)

এ বিষয়ে হাদিসে উল্লেখ আছে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত মহানবি (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা মদ, জুয়া ও বাদ্যযন্ত্র হারাম করেছেন।’ (বায়হাকি ও মিশকাত)

জুয়া সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে অপর এক স্থানে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে যারা ঈমান এনেছ! নিশ্চয় মাদক দ্রব্য, জুয়া, প্রতিমা ও ভাগ্য নির্ধারণী তীর হলো অপবিত্র ও শয়তানী কার্যকলাপ। অতএব তোমরা এগুলো থেকে একেবারে দূরে থাক যেন তোমরা সফল হতে পার। মাদক দ্রব্য ও জুয়ার মাধ্যমে শয়তান তোমাদের মাঝে কেবল শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে এবং আল্লাহকে স্মরণ করা ও নামাজ থেকে তোমাদের বিরত রাখতে চায়। অতএব তোমরা কি এসব থেকে বিরত হবে?’ (সুরা মায়েদা, আয়াত: ৯০-৯১)

Advertisement

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, জুয়ায় অংশগ্রহণকারী, খোঁটাদাতা ও মদ্যপায়ী জান্নাতে যাবে না’ (দারেমি ও মিশকাত)।

অজ্ঞতার যুগে শুধু ধন-সম্পদের ওপরেই জুয়া হত না, বরং কখনো কখনো স্ত্রীদেরকেও জুয়ার সওদা হিসেবে পেশ করা হত। অজ্ঞতার যুগে নানা রকমের জুয়ার প্রচলন ছিল। তন্মধ্যে আরবে প্রচলিত ভাগ্য নির্ধারণী জুয়া খেলার প্রথা সূরা মায়েদায় বর্ণিত হয়েছে। তার পদ্ধতি ছিল, দশ ব্যক্তি শরিক হয়ে একটি উট জবাই করত। অতঃপর এর গোশত সমান দশ ভাগে বন্টন করার পরিবর্তে জুয়ার আশ্রয় নেয়া হত। দশটি তীরের সাতটিতে বিভিন্ন অংশবিহীন চিহ্ন দেয়া থাকত।

অবশিষ্ট তিনটি তীর অংশবিহীন সাদা থাকত। এ তীরগুলোকে তুনের মধ্যে রেখে নাড়াচাড়া করে নিয়ে একেক অংশীদারের জন্য একটি তীর বের করা হত। যত অংশবিশিষ্ট তীর যার নামে বের করা হত, সে তত অংশের অধিকারী হত। আর যার নামে অংশবিহীন তীর হত, সে বঞ্চিত হত। শুধু বঞ্চিত নয়, বরং বঞ্চিত ব্যক্তিকে উটের পূর্ণ মূল্য পর্যন্ত দিতে হত। আরবীতে এ পদ্ধতিকেই কিসাম বিল আযলাম বলা হয় যা হারাম।

লটারি, জুয়া খেলাকে আনন্দ মনে হলেও এর সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রভাব ভয়ংকর। কোরআনে করিম বিভিন্ন আয়াতে জুয়াকে অকাট্যভাবে হারাম ঘোষণা করেছে। এমনিভাবে ঘোড়াদৌড়েও জুয়ার প্রচলন ছিল। দু’ব্যক্তি ঘোড়দৌড়ের প্রতিযোগিতা লাগাত এবং পরস্পরে এ চুক্তিতে আবদ্ধ হত, যে পরাজিত হবে সে বিজয়ী ব্যক্তিকে নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ প্রদান করবে। মহানবি (সা.) একেও জুয়ার অন্তভুক্ত করে হারাম ঘোষণা করেছেন। (সুনানে আবু দাউদ, কিতাবুল জিহাদ)

হাদিস থেকে জানা যায় যে, মহানবি (সা.) জুয়া পরিহার করার প্রতি এতো গুরুত্বারোপ করেছেন যে, শুধু জুয়াকেই হারাম করেননি বরং জুয়ার ইচ্ছা প্রকাশকেও গুনাহ সাব্যস্ত করেছেন। যে ব্যক্তি অপরকে জুয়ার প্রতি আহ্বান করবে, তাকে তার এই গুনাহর প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে কিছু সদকা করার নির্দেশ দিয়েছেন।

হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে মহানবি (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ লাত-উজ্জার শপথ ইত্যাদি বললে, তবে সে যেন সঙ্গে সঙ্গে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে। আর কেউ যদি অন্যকে প্রস্তাব দেয়, এসো আমরা জুয়া খেলি, সে যেন (জরিমানাস্বরূপ) দান-সদকা করে’ (বোখারি, তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ)।

বিশ্বময় এই মাদক ও জুয়ার ব্যাপকতা তা মূলত হবারই কথা। কেননা শেষ যুগের লক্ষণাবলি আজ স্পষ্টভাবে প্রকাশিত। যেমন বোখারি শরিফে উল্লেখ রয়েছে- মুসলমানদের মাঝে অনৈক্য ও দলাদলি, মিথ্যা ও দুর্নীতির সর্বগ্রাসী প্রাদুর্ভাব। সুদ, মদ, জুয়া ও ব্যভিচারের ছড়াছড়ি।

তাই এ যুগে সব ধরনের মন্দ কাজ থেকে নিরাপদ থাকা অনেকটাই কঠিন বিষয় হলেও মুক্ত থাকতেই হবে। বিশেষ করে মাদক ও জুয়া এটি সমাজ বিরোধী কাজ। এসব থেকে যেভাবেই হোক আমাদের সন্তানদেরকে রক্ষা করতে হবে।

লেখক: গবেষক, ধর্মীয় চিন্তাবিদ।

এইচআর/এমএস