ইউরোপের মূল ভূখণ্ড থেকে গত ২৯ অক্টোবর ২৪টি ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিল প্রায় ৯৯০ জন আশ্রয়প্রত্যাশী। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বিপজ্জনক ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে কেন্ট উপকূলে পৌঁছানো। এর পরের দিন আটটি নৌকায় গাদাগাদি করে ব্রিটিশ উপকূলে পৌঁছায় আরও ৪৬৮ জন। ঠিক সেদিনই ডোভারের একটি অভিবাসী-প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে একাধিক পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে এক দুর্বৃত্ত।
Advertisement
তার পরেরদিন ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্রাভারম্যান যুক্তরাজ্যের উপকূলে আশ্রয়প্রার্থীদের এভাবে উপস্থিত হওয়াকে ‘আক্রমণ’ বলে আখ্যা দেন। তার এই মন্তব্য সমালোচকদের ক্ষোভ উগরে দেয়। তবে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ এমপিদের কাছ থেকে সমর্থন পান ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৩৮ হাজার মানুষ বিশ্বের ব্যস্ততম শিপিং লেন পাড়ি দিয়েছেন। এটিকে ব্যস্ত সড়ক দৌড়ে পার হওয়ার ঝুঁকির সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। আশ্রয়প্রত্যাশী বোঝাই এই ছোট নৌকাগুলো যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক অঙ্গনে জটিল সমস্যা তৈরি করেছে।
এই সংকট সম্ভবত ব্রিটিশ সরকারের জন্য সবচেয়ে অপমানজনক। সুয়েলা ব্রাভারম্যানের মতো রাজনীতিবিদরা বারবার শক্তিশালী সীমান্ত, কম অভিবাসন এবং অধিক সার্বভৌমত্বের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন। কিন্তু তারা পেয়েছেন উল্টোটা।
Advertisement
আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে আশ্রয়প্রার্থীরা জোটের অন্য কোনো সদস্য রাষ্ট্রে নিবন্ধিত থাকলে তাদের নির্বাসিত করতে পারতো যুক্তরাজ্য। কিন্তু দেশটি ইইউ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই অধিকার হারিয়েছে দেশটি। এর পরিবর্তে ব্রিটিশ সরকার একটি হঠকারী সংস্করণ চালুর চেষ্টা করেছিল।
যুক্তরাজ্যের পক্ষে আশ্রয়প্রার্থীদের গ্রহণ করার জন্য রুয়ান্ডাকে অর্থ দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অবশ্য সরকারের এই সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত আদালতে আটকে রয়েছে। অল্প কথায় বললে, ব্রিটিশ সরকার একটি বাস্তবিক, নৈতিক ও বৈধ ব্যবস্থাপনাকে এমনটি একটি ব্যবস্থা দিয়ে প্রতিস্থাপিত করতে চায় যা অবাস্তব, অনৈতিক এবং সম্ভবত অবৈধ।
ব্রিটিশ সার্বভৌমত্ব বাড়ানোর জন্য কনজারভেটিভ পার্টির প্রচেষ্টা ভূ-রাজনীতির মারপ্যাঁচে পড়ে দেশটিকে তার প্রতিবেশীদের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল করে দিয়েছে। এখন ছোট নৌকার কথা উঠলেই সেখানে অনুরোধকারী থাকে যুক্তরাজ্য। তাদের এখন অত্যাধুনিক চোরাচালান নেটওয়ার্ক ভাঙতে এবং যারা দেশত্যাগ করতে চায় তাদের আটকে রাখার জন্য ফ্রান্সের সঙ্গে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে হবে, প্রয়োজনে ঘুস দিতে হবে। অর্থাৎ, সার্বভৌম হওয়ার বদলে যুক্তরাজ্য হয়ে উঠেছে আরও পরনির্ভরশীল।
তাছাড়া, এই ছোট নৌকা সংকট কনজারভেটিভদের এক দশকের শাসনের কিছু ব্যর্থতারও প্রতিচ্ছবি। গত চারটি নির্বাচনের প্রতিটিতে কনজারভেটিভরা কম অভিবাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। প্রতিবারই বহু ভোটার তাদের সমর্থন করেছে। কিন্তু অভিবাসন কমেনি।
Advertisement
পরিবর্তে, কনজারভেটিভরা লেবার পার্টির অনুকরণ করেছে। টনি ব্লেয়ারের অধীনে লেবার সরকার একটি উদার অভিবাসন নীতি গ্রহণ করেছিল। ইউরোপের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নাগরিকদের স্বাগত জানানো এবং পরিকল্পিত নিষ্ঠুরতার সঙ্গে আশ্রয়প্রার্থীদের নিবৃত্ত করার ব্যবস্থা ছিল সেই নীতিতে। কনজারভেটিভ সরকারও তার অনুরূপ পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা দক্ষ অভিবাসীদের ছাড় দিলেও আফগানিস্তান থেকে যাওয়া অভিবাসনপ্রত্যাশীকে ভিড়ের মধ্যে বন্দি রেখেছে।
যুক্তরাজ্যে ছোট নৌকা যদি ডানপন্থিদের অযোগ্যতা ও নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করে, তাহলে তা বামপন্থিদের আত্মতুষ্টিও দেখায়। ৬ কোটি ৭৩ লাখ জনসংখ্যার একটি দেশের সমুদ্রতীরে ৪০ হাজারেরও কম লোক হাজির হলে খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আবার এই সংখ্যাও সবসময় একই থাকে না। ২০১৮ সালে মাত্র ৫৯৩ জন ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছিল। সে বছর কয়েক দিনের মধ্যে ১০০ জনের মতো আশ্রয়প্রার্থী আগমনের কারণে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ছুটি থেকে ফিরতে বাধ্য করা হয়েছিল। এমন প্রতিক্রিয়াকে তখন হিস্টিরিয়া বলে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এখন? তা হয়তো হবে না।
সেই সময় বেশিরভাগ মানুষ ছিল প্রকৃত আশ্রয়প্রার্থী। এ বছর পর্যন্ত ছোট নৌকায় আগতদের মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আশ্রয়ের জন্য যোগ্যতা অর্জন করেছে। কিন্তু এই অনুপাতে পরিবর্তন আসতে পারে।
ছোট নৌকা পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা ক্ল্যান্ডেস্টাইন চ্যানেল থ্রেট কমান্ডার ড্যান ও’মাহনির ধারণা, যুক্তরাজ্যে আগতদের প্রায় অর্ধেকই এখন সত্যিই আশ্রয় খুঁজছেন। তার মতে, প্রকৃত আশ্রয়প্রার্থীদের দাবি প্রক্রিয়াকরণের সময় কাজ করা থেকে বিরত রাখা হবে মেধার অপচয়। আর যারা নিয়মের অপব্যবহার করে, তাদের বাদ দেওয়া প্রয়োজন।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্টকেএএ/