সম্প্রতি বিভিন্ন আলোচনায় উঠে আসছে দুর্ভিক্ষ প্রসঙ্গ। প্রধানমন্ত্রী আশঙ্কা প্রকাশ করে সে আলোচনা আরও ত্বরান্বিত করছেন। সরকারি পর্যায়ে দেওয়া হয়েছে ব্যয় কমানোর নির্দেশনা। ব্যক্তিপর্যায়েও ব্যয় কমানোর পাশাপাশি সঞ্চয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন শেখ হাসিনা। বৈশ্বিক পরিস্থিতি আমলে নিয়ে তিনি এমন উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।
Advertisement
প্রধানমন্ত্রীর এমন আশঙ্কা কতটুকু ইঙ্গিতপূর্ণ এবং সংকট উত্তরণে করণীয় এ প্রসঙ্গ নিয়ে জাগো নিউজের মুখোমুখি হন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন ও ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘বিশ্বে খাদ্য উৎপাদন কমে গেলে পরিস্থিতি খারাপ হবেই। আমরা খাদ্যপণ্য আমদানি করি। চাল-গম সবই আমদানি করতে হয়। বিশ্বে তো উৎপাদন কমে গেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ খাদ্যপণ্যের দাম বাড়িয়েছে।
করোনা মহামারি ধস নামিয়েছে। বিশ্বজুড়েই অর্থনীতির চরম অবস্থা যাচ্ছে। করোনার প্রভাব এখনো রয়েছে। দারিদ্র্যের হার বাড়ছে। প্রান্তিক মানুষ আরও প্রান্তিকীকরণের শিকার হচ্ছে। এই পরিস্থিতিকে কোনো অবস্থায়ই স্বাভাবিক বলা যাবে না। যদি সংকট বাড়তে থাকে, তাহলে দুর্ভিক্ষ হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে দুর্ভিক্ষ হলেও ১৯৭৪ সালের মতো মানুষ মরবে না।’
Advertisement
দুর্ভিক্ষ মানুষসৃষ্ট কারণেও হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দুর্ভিক্ষের জন্য প্রাকৃতিক কারণ দায়ী বটে। কিন্তু মানুষসৃষ্ট কারণও দায়ী। প্রচুর টাকা দেশের বাইরে চলে গেছে। এখনো পাচার হচ্ছে। মানুষ ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই পথে বসে যাচ্ছে দুর্নীতি-অনিয়মের কারণে। গুটিকয়েক মানুষের হাতে টাকা চলে যাচ্ছে। বাড়ছে বৈষম্য। ক্রয়ক্ষমতা কমছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। আবার মানি লন্ডারিং এবং ঋণখেলাপিও বাড়ছে। কার টাকা কে নিয়ে যাচ্ছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এসব তো সরকারকে অ্যাড্রেস করতে হবে।’
‘অর্থনীতির এমন অসঙ্গতি নিয়ে বহু আগে থেকেই বলে আসছি। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও নানাভাবে অর্থপাচার, দুর্নীতি নিয়ে তথ্য প্রকাশ করে আসছে। সত্যিকার অর্থে আমলে নেওয়া হয়নি। শুরু থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হলে আজকের পরিস্থিতি দাঁড়াতো না।’
প্রধানমন্ত্রী বারবার সঞ্চয়ের কথা বলছেন। ব্যক্তিপর্যায়ে যেমন সঞ্চয়ী হওয়া সময়ের দাবি, তেমনি রাষ্ট্রীয়ভাবেও। উন্নয়ন নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। জনবিচ্ছিন্ন উন্নয়ন দুর্ভিক্ষকে ত্বরান্বিত করবে। দুর্নীতি, অর্থপাচার রোধ করতে না পারলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। একটি বাদ দিয়ে আপনি আরেকটির ওপর গুরুত্ব দিলে হবে না। সব দিক বিবেচনায় এনেই পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে’ যোগ করেন মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী মূলত গোটা পৃথিবীর কথা আমলে নিয়ে দুর্ভিক্ষের শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ তো পৃথিবীর বাইরের কোনো রাষ্ট্র নয়। প্রভাব তো পড়বেই। আমরা সাবধান না হলে দুর্ভিক্ষ হবেই। আপনি দেখেন, গত কয়েক বছরে পণ্য আমদানি কমেছে। আবার দেশে কতগুলো খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন কমেছে। প্রধানমন্ত্রী মূলত এই কথাটাই বলেছেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, আমাদের আরও ইফোর্ট দিতে হবে। শত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও বাড়াতে হবে উৎপাদন।’
করণীয় প্রসঙ্গে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘প্রকৃতি নামের মাকে যদি আমরা রক্ষা করতে পারি, তাহলে প্রকৃতিই আমাদের রক্ষা করবে। প্রকৃতির ওপর আমাদের মায়া বাড়াতে হবে। সব রোবট বা মেশিন দিয়ে করতে হবে, এই নীতিও ছাড়তে হবে। আমাদের জীবনীশক্তি, শ্রমশক্তি যদি কাজে লাগাতে পারি তাহলে সংকট মোকাবিলা করা সহজ। কারণ এতে মানুষে মানুষে সমতা আসবে। প্রত্যেকের কাজের মূল্যায়ন হবে। মানুষ বেঁচে থাকার শক্তি পাবে।’
Advertisement
‘আমাদের গণমাধ্যমে সংকটের কথা বড় করে দেখানো হয়। এর মানে এই নয় যে, আমি সমস্যাকে খাটো করে দেখাতে চাইছি। সমস্যা আছে। কিন্তু সমাধানও আছে। ভয় বেশি দেখানো হলে মানুষ শক্তি হারায়। মানুষ প্রকৃতির কাছে ফিরুক, দুর্ভিক্ষ হবে না। সবার উপরে মানুষ সত্য, তার উপরে নেই। কৃষকের, শ্রমিকের উপযুক্ত সম্মান দিতে হবে। প্রয়োজনে খাদ্য উৎপাদনে আরও ভর্তুকি দিতে হবে। সাম্যবাদ ফিরিয়ে আনতে হলে শ্রমের মূল্য দিতেই হবে। উৎপাদন, পরিবহন আর বিপণনে শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর জন্য সমবায় জরুরি। তাহলে মধ্যস্বত্বভোগীর খবরদারি দূর হবে।’
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা বিপদ আরও ঘনিয়ে আনছে। সরকারি বলি আর বেসরকারি বলি কেউ আর দায়ের মধ্যে থেকে কাজ করে না। বাংলাদেশ ব্যাংক, বিডা, বেপজা বা এনার্জি রেগুলেরটরি কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানে গত কয়েক বছরের কার্যক্রম দেখেন। হতাশ হবেন। হাজার হাজার কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে, পাচার হচ্ছে। কোনো জবাবদিহি নেই। পাচারের সঙ্গে তো কোনো না কোনো ব্যাংক বা ব্যক্তি জড়িত। সাজাও হয়েছে। বরং দায় স্বীকারই করে না। শুধু রুটিন কথা বলে তো আপনি সমাধান পাবেন না। সমন্বিতভাবে তো অ্যাড্রেস করতে হবে।’
‘আমাদের অ্যাড্রেস করার মতো সক্ষমতাও কমে গেছে। এর জন্য গণতান্ত্রিক পরিবেশ দরকার। জবাবদিহি তো জনগণের কাছে করতে হয়। সরকার সেটা করে কি না, তা দেখার বিষয়। দুর্নীতি কমাতে গেলে আপনাকে জবাবদিহির আওতায় আসতে হবে। আমূলভাবে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার দরকার এবং সেটা সর্বত্রই।’
বৈশ্বিক সংকটের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘খাদ্যপণ্যের প্রায় সবই আমাদের আমদানি করতে হয়। গোটা বিশ্বেই তো সংকট। সিলেটের বন্যা এবার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এই সময়ে সিত্রাংয়ের তাণ্ডব! সবই জলবায়ুর প্রভাব। অসময়ে বন্যা হচ্ছে, খরা হচ্ছে। একদিকে উৎপাদন কমে গেছে বিশ্বে। অন্যদিকে আমাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। এটি তো চ্যালেঞ্জের। মানুষ আসলে চিন্তিত। দুর্ভিক্ষ হয়তো পরের আলোচনা। মানুষ তো এখনই ভালো নেই। খাবার কমিয়ে দিচ্ছে। পুষ্টিমান পাচ্ছে না।’
প্রধানমন্ত্রী দুর্ভিক্ষের যে কথা বলছেন, তা হয়তো সময়ই বলে দেবে। কিন্তু সাবধানতা তো দরকার। রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা না করে আমাদের প্রস্তুতি নেওয়া দরকার।
‘খাদ্যপণ্য আমদানি বাড়িয়ে স্টক করতে হবে। কৃষিতে ভর্তুকি বাড়িয়ে দিন। সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বন্যা-খরা মোকাবিলার প্রস্তুতি রাখতে হবে। এখন যে সমস্যায় আছি, সেখান থেকে শিক্ষা নেওয়ার অনেক কিছু আছে। শিক্ষা নিতে পারলেই দুর্ভিক্ষ থেকে আমরা পরিত্রাণ পাবো।’ এএসএস/এএসএ/এমএস