আজ ৩ নভেম্বর জেল হত্যা দিবস। বাঙালির কলঙ্কের ইতিহাসে গাথা আরও একটি দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর জাতীয় ৪ নেতাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি। বঙ্গবন্ধু হত্যার মাত্র ৭৯ দিনের মাথায় এই হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। উল্লেখ্য, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর খুনি মোশতাক সরকার গ্রেফতার করে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিসভার দুই সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামান- এই জাতীয় ৪ নেতাকে।
Advertisement
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই দিনটি এক বেদনাময় কলঙ্কিত অধ্যায়। রাতের আঁধারে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে এই হত্যাকাণ্ডে প্রকাশ্যে ছিল কতিপয় সেনা অফিসার, যারা ১৫ আগস্টে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডেও যুক্ত ছিল। জাতীয় চার নেতা ছিলেন বাংলাদেশের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরীক্ষিত রাজনৈতিক বন্ধু, সহচর। বঙ্গবন্ধুর পরেই এরা ছিলেন দলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা।
কারাগার হলো যে কোন মানুষের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে নিরাপদ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের স্থান। সেই কারাগারেই ঘাতকদল ব্রাশফায়ারে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটায়। কারাগারের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা অবস্থায় বর্বরোচিত এমন হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। বঙ্গবন্ধু এবং চার নেতার হত্যাকাণ্ড ছিল একই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে ষড়যন্ত্রকারীরা জাতীয় চার নেতাকে তার সরকারে যোগদানের জন্য চাপ দেয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর এই ঘনিষ্ঠ সহচররা তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেন। এ কারণে তাদের বন্দি করা হয়। রাজনৈতিক জীবনে জাতীয় চার নেতা বঙ্গবন্ধুর মতোই সাধারণ জীবনযাপন করতেন। সারাজীবন দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন, অধিকার আদায়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। কখনও অন্যায়ের কাছে আপোস করেননি।
জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলার সাক্ষীদের বর্ণনায় জানা যায়, হাবিলদার মোসলেম উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি দল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাদের হত্যার উদ্দেশে যায়। প্রথমে তারা কারা কর্তৃপক্ষের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। পরে খন্দকার মোশতাক টেলিফোনে তার অভিপ্রায় ও সম্মতির কথা জানালে ঘাতক দলটি নির্বিঘ্নে এগিয়ে যায় নেতাদের সেলের দিকে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দীন আহমদ জেলখানার নতুন জেলের (নিউ জেল) ১ নং কক্ষে বন্দি ছিলেন। পার্শ্ববর্তী রুম থেকে অপর দুই জাতীয় নেতা এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে আনা হয় ১নং কক্ষে।
Advertisement
চার নেতাকে একত্র করার পর খুব কাছ থেকে সম্পূর্ণ ঠাণ্ডামাথায় অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। গুলিতে তাজউদ্দীনের মৃত্যু না হলে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা নিশ্চিত করে ঘাতকরা। ঘাতকদের কয়েক মিনিটের এই তাণ্ডবলীলা থেমে যাবার পর জেলখানায় নেমে আসে নীরব, নিস্তব্ধতা। চার নেতার বুকের তাজা রক্তে ভেসে যায় ১নং সেলের মেঝে।
মাঝখানে নীরব, নিথর, প্রাণহীন অবস্থায় পড়ে থাকে বুলেটের আঘাতে তাদের ক্ষত-বিক্ষত দেহ। জানা যায়, সারারাত পাগলাঘণ্টা এবং একসাথে গুলির শব্দের প্রচণ্ড আওয়াজে সমগ্র জেলখানা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। ঘাতকরা এই নির্মমতার মাধ্যমে একাত্তরের পরাজয়ের জ্বালা মিটিয়েছিল। ইতিহাসের এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় শুধু বাংলাদেশের মানুষই নয়, স্তম্ভিত হয়েছিল সমগ্র বিশ্ব।
জাতীয় চার নেতার প্রতি খন্দকার মোশতাকের চরম আক্রোশ ছিল দীর্ঘ দিনের। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে নানা অস্থিরতার হোতাও এই খুনি মোশতাক। তবে কেবল মোশতাক তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ কিংবা প্রতিপক্ষকে হত্যা করে নিজের ক্ষমতাকে নিষ্কন্টক করার জন্যই কেবল জেল হত্যা সংঘটিত করেছে এমনটি ভাবা ঠিক হবে না। এর পেছনে জাতিকে রাজনৈতিকভাবে মেধাহীন করা, নেতৃত্বের শূন্যতা সৃষ্টি এবং ’৭১ এর পরাজিত শক্তির প্রতিহিংসা বাস্তবায়নের একটা সূক্ষ ষড়যন্ত্র ছিল এটি। যে ষড়যন্ত্র চলে আসছিল স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই। তেসরা নভেম্বরের জেলহত্যা সেই সূক্ষ ষড়যন্ত্রেরই বাস্তবায়ন।
ঘটনার ধারাবাহিকতায় খন্দকার মোশতাক অনেকটাই নিশ্চিত ছিলেন যে, আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার শাসন ব্যবস্থার যবনিকা হতে যাচ্ছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার প্রচেষ্টার চেয়ে মোশতাক সংক্ষিপ্ত সময়ে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। কারণ, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর তার ধারণা ছিল বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে জাতীয় চার নেতা দেশ ও জাতিকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। তারা পূরণ করতে পারবেন রাজনৈতিক শূন্যতা।
Advertisement
এ জন্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে দেশের মানুষ যেন এগুতে না পারে, একটি আত্মনির্ভরশীল, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসাবে যাতে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে না পারে- অর্থ্যাৎ নেতৃত্ব শূন্যতা সৃষ্টির প্রতিই খন্দকার মোশতাকের লক্ষ্য ছিল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ’৭১ এ বুদ্ধিজীবী হত্যা, ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা এবং ৩ নভেম্বর জেলহত্যা স্বাধীনতা বিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের ধারাবাহিক ধাপ- যা পরবর্তী সময়ে জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়া-নিজামীরা এগিয়ে নিয়ে গেছে অনেকদূর।
খুনি মোশতাক সমর্থিত সেনাশাসকদের প্রলোভনের ফাঁদে পা না দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে আমৃত্যু অনুসরণ করতেন আমাদের জাতীয় চার নেতা। ঘোর বিপর্যয়ের সেই সময়ে চার নেতার পরিবার হারায় তাদের সবচেয়ে ভরসার মানুষকে। জাতীয় ৪ নেতাকে হত্যার পর কঠিনপথ পাড়ি দিতে হয় তাদের পরিবারকে। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত-নির্যাতন সহ্য করতে হয় তাদের। ৭৫ সালের পর সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার মতো জাতীয় চার নেতার সন্তানরাও লড়েছেন, নিজেদের গড়ে তুলেছেন যোগ্য সন্তান হিসেবে। বাবার উত্তরসূরি হিসেবে তাদের কয়েকজন রাজনীতির মাঠে প্রতিষ্ঠাও পেয়েছেন। এরজন্য তাদের নতুনভাবে সংগ্রাম করতে হয়েছে।
এমনকি থাকার জায়গা পেতেও চরম কষ্টের মুখোমুখি হয়েছেন দেশের সার্বভৌমত্ব এনে দেয়া নেতাদের এই সন্তানরা। বাবাকে হারানোর বেদনা থাকলেও জাতীয় ৪ নেতার সন্তানরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা তার পরিবারের সঙ্গে বেঈমানি করেননি কখনও। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হলে ছত্রভঙ্গ আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিক কাঠামোর ওপর দাঁড় করানোর জন্য আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তাজউদ্দীনের স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীন।
সেনাশাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনিই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দাবি করেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে মিলাদের আয়োজন করেন। রাজনীতির মাঠে সৈয়দ আশরাফ, মোহাম্মদ নাসিম, খায়রুজ্জামান লিটন ও সোহেল তাজদের মতো নেতৃত্ব শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বের অনুসারী হিসেবে কাজ করেছেন, করছেন। জাতির পিতার দুই কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাও চার নেতার সন্তানদের শ্রদ্ধা, স্নেহ ও ভালোবাসায় আবদ্ধ রেখেছেন।
দীর্ঘদিন পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকার্য শেষ হয়েছে, খুনিদের কারও কারও ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। জেলহত্যা মামলার বিচারকার্যও সম্পন্ন হয়েছে। এটি সম্ভব হয়েছে শুধু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ়চিত্ত নেতৃত্বের কারণে। বঙ্গবন্ধু হত্যা বিচারের মতো জেলহত্যা বিচারের মাধ্যমে মিথ্যার জাল ছিন্ন করে সত্য বেরিয়ে এসেছে। বিচার হয়েছে ব্যক্তি হত্যার। জেল হত্যাকাণ্ডের ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামিদের কেউ কেউ এখনও পলাতক। বাঙালি জাতির ইতিহাসকে পুরোপুরি কলঙ্কমুক্ত করতে হলে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামিসহ ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডের দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে রায় কার্যকর করতে হবে- এবারের জেলহত্যা দিবসে এটাই সকলের প্রত্যাশা।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/এমএস