ফিচার

রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন হোক জেলহত্যা দিবস

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ মানুষের আবেগ-অনুভূতিকে ধারণ করতে জানতেন। সে কারণে তাঁকে সবশ্রেণির মানুষ ভালোবাসতো। তিনি মন জয় করেছিলেন মেধাবী রাজনীতিকদেরও। মুক্তিযুদ্ধকালে জাতীয় চার নেতার তাঁর প্রতি আনুগত্য ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে তা শ্বাশত চিরন্তন রাজনৈতিক ঐতিহাসিকতার দলিল হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়।

Advertisement

একটু পেছনে গেলে দেখা যায় যে, ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান সাহেব পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পার্লামেন্টারি পার্টির মিটিংয়ে বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদ নেতা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপনেতা, তাজউদ্দীন আহমদ পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান সাহেব সচিব, চিফ হুইপ পদে ইউসুফ আলী, হুইপ পদে যথাক্রমে জনাব আবদুল মান্নান ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম নির্বাচিত হন। আর প্রাদেশিক পরিষদে নেতা নির্বাচিত হন ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলে মনসুর আলী হবেন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী। এজন্য মনসুর আলী সাহেবকে বঙ্গবন্ধু প্রাদেশিক পরিষদে মনোনয়ন দেন। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড সুচারুরূপে পরিচালনা করেছেন অসহযোগের প্রতিটি দিন।

একাত্তরের ১০ এপ্রিল মুজিবনগরে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সমন্বয়ে বাংলাদেশ গণপরিষদ গঠন ও সেই পরিষদে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুমোদন করে তারই ভিত্তিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ গঠন করা হয়। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং উপরাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান স্বরাষ্ট্র ও পুনর্বাসনবিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ করেন এবং অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর প্রিয় মাতৃভূমিকে হানাদারমুক্ত করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ দূরদর্শিতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। জাতীয় চার নেতার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে প্রিয় মাতৃভূমিকে আমরা স্বাধীন করেছি।

জাতির পিতা ও জাতীয় চার নেতার আরাধ্য স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের দুখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করে প্রিয় বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তর করা। মহান নেতাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারলেই নেতাদের আত্মা শান্তি লাভ করবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সে লক্ষ্যই নির্ধারিত হয়ে গন্তব্যে পৌঁছুতে চায় বাংলাদেশ। কিন্তু কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ড ছিল বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ধারাবাহিকতা। এ ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি, দেশবিরোধী চক্র বাংলার মাটি থেকে আওয়ামী লীগের নাম চিরতরে মুছে ফেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস এবং বাঙালি জাতিকে নেতৃত্ব শূন্য করার অপচেষ্ট চালিয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। কারাগারের অভ্যন্তরে এ ধরনের বর্বর হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন।

Advertisement

চার নেতার পরিবার চায়, জাতীয়ভাবে যেন তাদের জীবনী নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা হয়। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবইয়ে তাদের জীবনী তুলে ধরা হলে নতুন প্রজন্ম অনুপ্রাণিত হতো। তাহলে ভবিষ্যৎ একটি সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলা সম্ভব হতো।

এটি শুধু চার নেতার পরিবারের দাবি নয়, আমরাও দাবিটি তুলতে পারি। রাষ্ট্রীয়ভাবেই জেলহত্যা দিবসও উদযাপন করা হোক। তাহলে দুর্যোগময় মুহূর্তে জাতীয় চার নেতা দৃঢ়তার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে যে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, আমাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলেন—তখন তাদের মহিমা সম্পর্ক বিস্তারিত জানার সুযোগ হবে।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ও জেল হত্যাকারীরা প্রায় একই মানুষ। তাই আমাদের দাবি, এর পেছনের যারা কারিগর বা কুশীলব তাদের পরিচয় জানার জন্য যেন একটা স্বাধীন কমিশন গঠন করা হয়। আলাদা কমিশন ছাড়া কারা ঘটনার পেছনে ছিল সেটি জানা সম্ভব নয়। আমরা শুধু শোক প্রকাশ করতে চাই না। কাঁদব আর আসব আর সেই দিনকে স্মরণ করব, সেটা নয়। আমি একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে মনে করি, জাতির অনুপ্রেরণার জন্য জাতীয় চার নেতার মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের যথাযথ মর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে তুলে ধরতে হবে। তাদের আড়ালে রেখে কোনোদিনও আমরা সোনার বাংলা গড়তে পারব না। তৎকালীন জেল কর্তৃপক্ষের কী ভূমিকা ছিল, আমরা তা জানতে চাই।

স্বাধীনতাবিরোধী জাতীয় শত্রু ও ঘাতকরা রক্তে অর্জিত বাঙালির রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ধ্বংসের হীন উদ্দেশ্যেই দেশপ্রেমিকদের হত্যা করেছিল। কিন্তু ঘাতকদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি। দেশের মানুষ সব ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার জন্য বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, দেশবাসীর সহযোগিতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত, তথ্যপ্রযুক্তি সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তুলবেন। যে অভিপ্রায় ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর বিশ্বস্ত ওই জাতীয় চার নেতার মধ্যে। আমরা তাঁদের ভুলতে পারি না। ভুলতে চাই না। তাঁদের প্রস্থান হয়নি বলে চিৎকার করে রাজনৈতিক অপশক্তির প্রেতাত্মাদের বলতে হবে, আমরা বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠ সহকর্মী তথা তাজউদ্দীন আহমদ, নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী ও কামারুজ্জামানদের সৎ আত্মা নিজের মধ্যে এনে দেশের জন্য লড়ে যেতে চাই আজীবন।

Advertisement

লেখক: রাজনীতিক ও সমাজকর্মী।

এসইউ/এমএস