আন্তর্জাতিক

এবারের শীতে কীভাবে টিকবে ইউক্রেন?

কিয়েভের পশ্চিমে ছোট্ট একটা শহর মাকারিভ। স্থানীয় মেয়রের দাবি, যুদ্ধের শুরুর দিকে সেখানে অন্তত ১৩২ জনকে গুলি করে হত্যা করেছিল রুশ সেনারা। পুরোনো সেই ক্ষত মিটতে না মিটতেই শহরটিতে দেখা দিয়েছে নতুন সমস্যা। গত অক্টোবরের শুরুতে মাকারিভের কাছাকাছি বিভিন্ন স্থাপনায় দফায় দফায় ক্ষেপণাস্ত্র ও ‘কামিকাজে’ ড্রোন হামলা চালায় রাশিয়া। এসব লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে একটি বৈদ্যুতিক সাবস্টেশনও রয়েছে। ফলে ব্ল্যাকআউট শুরু হয়েছে শহরটিতে। গত ৩১ অক্টোবর ফের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করেছে রুশ সেনারা।

Advertisement

ইউক্রেনের অন্য অঞ্চলগুলোর মতো মাকারিভও এখন ভয়ংকর শীতের প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাশিয়ার আক্রমণ অনেকটা কম কার্যকর হয়ে পড়েছে। ন্যাটোর বিভিন্ন সদস্য দেশ থেকে নতুন আকাশপ্রতিরক্ষা সরঞ্জাম পেয়েছে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী। তারা সম্প্রতি রাশিয়ার ব্যবহৃত হাতেগোনা কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ছাড়া বাকিগুলো ভূপাতিত করার দাবি করেছে। তারপরও হামলায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক।

ইউক্রেনের জ্বালানি অবকাঠামোর ৪০ শতাংশই অকেজো হয়ে গেছে। জাতীয় বৈদ্যুতিক গ্রিড পরিচালক ইউক্রেনার্গো দেশজুড়ে পর্যায়ক্রমে লোডশেডিং দিতে বাধ্য হয়েছে। গৃহস্থালী ও বাণিজ্যিক উভয় খাতে ইউক্রেনীয়দের বিদ্যুৎ ব্যবহার কমাতে অনুরোধ জানানো হচ্ছে।

গত ৩১ অক্টোবর রাশিয়ার হামলার পর কিয়েভে প্রায় সাড়ে তিন লাখ ঘরবাড়িতে বিদ্যুৎ ও ৮০ শতাংশ বাসিন্দার কাছে পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। যদিও এর বেশিরভাগ ফের সচল হয়েছে বলে জানিয়েছে ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ। তবে রাত হলে এখনো দেশটির রাজধানীর বিশাল এলাকা অন্ধকারই থাকছে।

Advertisement

রয়েছে আরও আক্রমণের ভয়। এ কারণে যেসব ইউক্রেনীয় নাগরিক যুদ্ধের কারণে দেশত্যাগ করেছিল, তাদের ফিরতে নিষেধ করছে কিয়েভ। গত কয়েক মাসে কয়েক লাখ ইউক্রেনীয় দেশে ফিরেছে।

ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় জ্বালানি সংস্থা নাফটোগাজের প্রধান দেশবাসীকে তাদের ইতিহাসে ‘সবচেয়ে ভয়ংকর শীতের’ জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। ইউক্রেনের বিভিন্ন অংশে এরই মধ্যে শীত পড়তে শুরু করেছে। রাতের বেলা কিয়েভের তাপমাত্রাও হয়ে উঠছে হিমশীতল। ফলে সারা দেশে উষ্ণায়ন ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।

ইউক্রেনে এক-তৃতীয়াংশ বা সংখ্যার দিক থেকে ৫০ লক্ষাধিক ঘরবাড়ি শীতে উষ্ণতার জন্য ‘ডিস্ট্রিক্ট হিটিং সিস্টেম’-এর ওপর নির্ভরশীল। এতে প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা বা কাঠ দিয়ে একটি কারখানায় পানি গরম করা হয়। এরপর কয়েক হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন বেয়ে সেই পানি পৌঁছে যায় বাড়ি বাড়ি। কয়েক দশক আগে সোভিয়েত প্রকৌশলীরা তৈরি করেছিলেন এই ব্যবস্থা।

এখন পর্যন্ত ইউক্রেনের এই উষ্ণায়ন ব্যবস্থার পরিস্থিতি ভালোই রয়েছে। ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে থাকা ২২টি প্রদেশের মধ্যে ১৮টিই উষ্ণায়ন মৌসুমের জন্য প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন দেশটির উন্নয়নমন্ত্রী ওলেক্সি চেরনিশভ। তবে যুদ্ধের সম্মুখভাগে থাকা অঞ্চলগুলোর অবস্থা খারাপ। কিয়েভে আগামী ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হচ্ছে উষ্ণায়ন মৌসুম। এক্ষেত্রে প্রথমে উষ্ণতা পাবে স্কুল, কিন্ডারগার্টেন ও হাসপাতালগুলো।

Advertisement

কিন্তু এই ব্যবস্থাটি রুশ আক্রমণের মুখে অনেকটাই অরক্ষিত। বিশেষ করে, যেসব শহর কয়েকটি বৃহৎ সম্মিলিত তাপ ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীল, সেগুলোই বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।

ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্সিয়াল প্রশাসনের উপপ্রধান কিরিলো টাইমোশেঙ্কো বলেছেন, রাশিয়া কিয়েভের প্রতিটি উৎপাদনকেন্দ্র ধ্বংসের চেষ্টা করেছে। তারা সফল হলে রাজধানীর ২০ লাখ বাসিন্দার বেশিরভাগই শীতে জমে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়তো।

ইউএসএআইডির জ্বালানি সুরক্ষা প্রকল্পের ডায়ানা কর্সাকাইট বলেন, পাইপলাইনগুলোতে আক্রমণ হলে অনেক সমস্যা হবে, বিশেষ করে কিয়েভের মতো সমন্বিত নেটওয়ার্কগুলোর জন্য। একটি পাইপের ক্ষতি হলে হাজার হাজার মানুষের উষ্ণায়ন ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে। তাছাড়া প্রবল ঠান্ডায় বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রন্ত পাইপে ফাটল তৈরি হতে পারে।

ইউক্রেনের প্রায় সব তাপ উৎপাদন কেন্দ্রই প্রাকৃতিক গ্যাসে চলে। তবে ডিস্ট্রিক্ট হিটিং সিস্টেমের সংযুক্ত নয় এমন অন্তত ৮০ লাখ পরিবার উষ্ণতার জন্য বয়লারের ওপর নির্ভরশীল। দেশটিতে শীতকালে গ্যাস সরবরাহে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। ইউক্রেনে ১৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস মজুত রয়েছে, যা শীতকাল পার করার জন্য যথেষ্ট হওয়া উচিত। কিন্তু বিদ্যুৎ ও পানির সরবরাহে বিঘ্ন ঘটতে পারে। ডিস্ট্রিক্ট হিটিং সিস্টেমের মাধ্যমে পানি সরবরাহের পাশাপাশি কেন্দ্রগুলো নিজে চলার জন্যে বিদ্যুতের প্রয়োজন। বেশিরভাগ বয়লারেও বৈদ্যুতিক সরবরাহ প্রয়োজন হয়।

যেসব ইউক্রেনীয় নিজের বাড়িতে বসবাস করে, তারা এরই মধ্যে কাঠ, বৈদ্যুতিক জেনারেটর ও হিটার মজুত করছে। সোভিয়েত আমলের ‘বুরঝুইকা’ নামে পরিচিত পোটবেলি স্টোভ বিভিন্ন শহরতলিতে ফিরতে শুরু করেছে। গত বছর এক-দশমাংশ ইউক্রেনীয় ঘর গরম করতে এই স্টোভ ব্যবহার করেছিল। সেই সংখ্যা এবার বাড়বে নিশ্চিত।

চেরনিশভ বলেছেন, তিনি পশ্চিমা দাতাদের শীতের আগে দেড় হাজার মোবাইল থার্মাল স্টেশন এবং ২৫ হাজার জেনারেটর সরবরাহ করতে বলেছেন। কিন্তু সেগুলো এখনো আসেনি এবং সবাইকে উষ্ণ মেটানোর জন্য যথেষ্ট না-ও হতে পারে।

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্টকেএএ/