আমাদের দেশে তো বটেই, বিশ্বব্যাপী করোনার প্রকোপ ব্যাপক হারে কমতে শুরু করেছে| শনাক্তের সংখ্যার মতো করোনার অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর সংখ্যা বিশ্বব্যাপী ছয় মাস ধরে ব্যাপক হারে কমতে শুরু করেছে| গত মার্চ মাসেও বিশ্বব্যাপী যা মৃত্যু হতো তার এক-পঞ্চমাংশ কমে এসেছে এখন| করোনা মহামারির বিদায়টাকে অনেকে ম্যারাথন দৌড়ে সম্ভাব্য বিজয়ী খেলোয়াড় তার দৌড়ের ফিনিশিং লাইন দেখতে পারার সাথে তুলনা করছেন|
Advertisement
আবার সতর্কতাও দেখাচ্ছেন যে ফিনিশিং লাইয়ে যাওয়ার আগে খেলোয়াড় যেমন তার সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে ফিনিশিং লাইন ছুঁতে চেষ্টা করেন এবং এ থেকে সামান্য বিচ্যুতি তার পরাজয়ের কারণ হতে পারে ঠিক তেমনি মহামারি নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি শীতলতাও দেখানো ঠিক হবে না| অর্থাৎ নতুন নতুন ভেরিয়েন্ট এর ট্রাকিং এবং উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ মানুষদের নিয়মিত টিকা প্রদান ইত্যাদি চালিয়ে যাওয়া| যেমন খুব সম্প্রতি মানুষের সব ধরনের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ডিঙিয়ে আক্রমণ করতে পারে এমন একটি অমিক্রণ ভেরিয়েন্টের কথা শোনা যাচ্ছে|
করোনার মহামারির তিন বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই, এমন প্রস্থান শতাব্দী আরেকটি অন্যতম মহামারি স্প্যানিশ ফ্লুংয়ের কথা মনে করিয়ে দেয়| এটি H1N1 ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট হয়েছিল এবং ১৯১৮ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। স্প্যানিশ ফ্লুও তখন দ্রুতই বিলুপ্ত হয়নি এবং বছরের পর বছর টিকে থেকে একটি হালকা মৌসুমি বাগ হয়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাপী ৫০ কোটিরও বেশি মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল এবং মৃতের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ কোটি। স্প্যানিশ ফ্লু মহামারির এই তথ্যের ওপর ভর করে অনেক বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাস মহামারির ক্ষেত্রেও ঠিক একই রকম পরিণতি ঘটবে বলেও মন্তব্য করেছিলেন| তাদের ধারণা অনেকটা সত্যি প্রমাণিত হচ্ছে|
প্রাথমিকভাবে স্প্যানিশ ফ্লু মহামারিকেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে উপেক্ষা করা হয়েছিল| কিন্তু বাস্তবে, এই মহামারিতে যুদ্ধের চেয়েও বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। উভয় মহামারিই ব্যাপক আর্থ-সামাজিক ধ্বংসের অন্যতম কারণ হয়েছে। এক বছরের মাথায় টিকার আবিষ্কার এবং প্রয়োগ শুরু হলেও স্প্যানিশ ফ্লুয়ের চেয়েও অনেক বেশি লোক আক্রান্ত এবং মৃত্যুবরণ করেছে করোনা মহামারিতে| অন্যদের মতে, বর্তমান জনসংখ্যা স্প্যানিশ ফ্লুয়ের সময়কার জনসংখ্যার চেয়ে চার গুণেরও বেশি হওয়ায় তুলনামূলক কম মৃত্যু এবং আক্রান্ত হয়েছে করোনাভাইরাস মহামারিতে| ফলে উভয়ই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক মহামারি হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত থাকবে।
Advertisement
দেশে দেশে স্বাস্থ্য সুরক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক বিধিনিষেধ ইত্যাদি প্রায় উঠে গেছে| শুধু চীনে এখনো তা ভালোভাবে বলবৎ রয়েছে| এমন সময় ছিল, যখন বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন ৪০ মিলিয়ন টিকাও প্রদান করা হয়েছিল, বর্তমানে তা কমে গিয়ে ২ বা ৩ মিলিয়নে নেমে গেছে| চাহিদা তলানিতে ঠেকেছে| চাহিদা না থাকায়, মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার কারণে ভারতও কিছুদিন আগে ১০০ মিলিয়ন টিকা নষ্ট করতে বাধ্য হয়েছে| নতুন মারাত্মক কোনো ভেরিয়েন্টের সন্ধান না মেলায় বিশ্বের করোনা পান্ডেমিক পরিস্থিতি প্রায় এন্ডেমিকে চলে গেছে| বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটা শুধু বাকি| ভবিষ্যতে দেশে দেশে বা জায়গায় জায়গায় ফ্লুয়ের মতো মৌসুমি রোগের আকারে কোভিডকে আমরা দেখতে পাব|
দীর্ঘ দুই বছর ৮ মাস ধরে ২৯ হাজার ৩০০টিরও বেশি প্রাণ কেড়ে নিয়ে বাংলাদেশ থেকে করোনাভাইরাস মহামারির এমন অবসানের খবরে মন খুশি হওয়ার আগেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব এবং প্রাণ কেড়ে নেওয়ার অজানা আশঙ্কা সবাইকে অস্বস্তিতে ফেলেছে| প্রতি বছরই এমন অজানা আশঙ্কার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে| সবার মনে আশঙ্কার একটি ক্রনিক ধারা তৈরি হয়েছে| অক্টোবরের শুরুতে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমতে পারে অনেকের এমন অনুমানকে ভুল প্রমাণিত করে এ বছরের মধ্যে অক্টোবর মাসেই সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গুর বিস্তার এবং মৃত্যু ঘটেছে| অনুমান বা পূর্বাভাস কোনোটাই সঠিক হচ্ছে না|
ডেঙ্গুর বিস্তার এবং হাসপাতালে ভর্তির ট্রাজেক্টরি দেখলে গত কয়েক বছরে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে সর্বোচ্চ বিস্তার ঘটেছে (হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে), যেটা কয়েক বছর আগেও জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল| বাংলাদেশে ২০১৯ সালে সবচেয়ে বেশি লোকের (এক লাখেরও বেশি) ডেঙ্গু শনাক্ত এবং হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়| এই ট্রানজিশনের পেছনের কারণ খুঁজে বের করা দরকার| সম্প্রতি সিত্রাং ঘূর্ণিঝড়ের কারণে দেশব্যাপী ব্যাপক বৃষ্টিপাত হওয়ার চলমান ডেঙ্গু পরিস্থিতির আরও অবনতি এবং আরও মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে|
এখন পর্যন্ত এ বছর প্রায় ৩৭ হাজার ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এবং ১৩৬ জন মৃত্যুবরণ করেছে, যার ৫৫ শতাংশ হয়েছে গত অক্টোবর মাসে (২২ হাজার ভর্তি এবং ৮৬ মৃত্যু)| ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০২২ সাল হবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ডেঙ্গু বিস্তারের বছর| এবছর প্রতি ১০,০০০ হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীর বিপরীতে এখন পর্যন্ত ৩৭ জন রোগী মারা গেছে| অক্টোবর মাসে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা অনেক বেশি হলেও মৃত্যুর অনুপাত একটু বেশি রয়েছে অর্থাৎ প্রতি ১০,০০০ হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীর বিপরীতে মৃত্যুর সংখ্যা ৩৯|
Advertisement
সব রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে না, অনেকে বাসায় অবস্থান করছে, আবার অনেকেই পরীক্ষাও করাচ্ছে না| ফলে প্রকৃত ডেঙ্গু আক্রান্ত সংখ্যা অজানাই থেকে যাচ্ছে| নির্বিচারে ডেঙ্গু টেস্ট করা হলে ডেঙ্গু আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা অনেকগুণ বেশি হতো| কেননা, করোনাভাইরাসের মতো ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও লক্ষণহীন রোগীর সংখ্যা অনেক| বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে মৃদু এবং লক্ষণহীন ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৮০ শতাংশেরও বেশি হয়| বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ হওয়ায় তাই অতীতে একবার ডেঙ্গুতে আক্রান্তকারীদের মধ্যে দ্বিতীয় বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে| আর ডেঙ্গুর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী অতীতে একবার ডেঙ্গু হলে কেউ দ্বিতীয় বার অন্য কোন সেরোটাইপের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে ভয়াবহতা অনেক বেশি হয়, এর সাথে মৃত্যুঝুঁকিও অনেক বেড়ে যায়|
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম থাকার কারণে শিশু এবং বয়স্ক লোকেরাই বেশি মারা যাচ্ছে এবং ঝুঁকিতে রয়েছে| জনবহুল ঢাকা শহরের বাইরেও ডেঙ্গুর বিস্তার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্যান্য জনবহুল এবং অপরিকল্পিত শহরেও ডেঙ্গুর বিস্তার বেশি বেশি বাড়ছে| বিগত বছরগুলোতে ঢাকার বাইরে ২০ শতাংশ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেও তা বেড়ে এ বছর প্রায় ৩২ শতাংশ হয়েছে| উন্নত সেবা প্রাপ্তির আশায় ঢাকার হাসপাতালে রোগী ভর্তির প্রবণতা বেশি থাকায় আমার ধারণা ঢাকায় বাইরের প্রকৃত ডেঙ্গু রোগীর হার এর চেয়েও বেশি হবে| ফলে এই ক্রমবর্ধমান ডেঙ্গুতে আক্রান্তের ঝুঁকি এবং পরিসর বছর বছর অন্তর মানুষের মধ্যে একটা অজানা ক্রনিক ভয় কিংবা আতঙ্ক সৃষ্টি করছে|
ডেঙ্গু একেবারে নতুন কোন রোগ নয়, এর ইতিহাস পুরাতন| এটি বাংলাদেশে ১৯৬০ সালের দিকে প্রথম ধরা পড়ে| তখন তাকে ঢাকা-রোগ নামে ডাকা হতো| এরপর কদাচিৎ এই রোগের কথা জানা গেলও ২০ বছর ধরে এটি একটি মহামারি হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে| দিন দিন তা আরও বেশি আতঙ্ক সৃষ্টি করছে|
ক্রমবর্ধমান অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং আমাদের দৈনন্দিন আচরণের বৈশিষ্ট্য ডেঙ্গু বিস্তারের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেই চলছে| ঢাকার বাইরে ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, কক্সবাজারে ক্রমাগতভাবে ডেঙ্গু বেড়েই চলেছে| আগামী বছরগুলোতেও হয়তো একই ধারাই বজায় থাকবে|
অতীতে একবার ডেঙ্গু হলে কেউ দ্বিতীয় বার অন্য কোন সেরোটাইপের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে ভয়াবহতা অনেক বেশি হয়| এমন প্রেক্ষিতে সমন্বিত ডেঙ্গু মহামারী নিয়ন্ত্রণে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অতীতে ডেঙ্গু হওয়ার ইতিহাস থাকলে শুধুমাত্র এমন ৯ থেকে ৪৫ বছর বয়সি সেরোপজিটিভ সবাইকে টিকা নেওয়ার কথা বলেছে| সানোফি পাস্তুইউর ২০১৫ সালে আবিষ্কৃত ডেঙ্গভ্যাকসিয়া নামক টিকা ইতিমধ্যে ২০ টি দেশ ব্যবহারের জন্য অনুমোদন করেছে| বর্তমানে ডেঙ্গুর উদ্ভূত পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যতের ঝুঁকি বিবেচনায় তাই টিকা প্রদানের গুরুত্ব অনেক বেড়ছে|
আবহাওয়ার উপর কারো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় আবহাওয়ার প্রতিকূলতাকে ডেঙ্গু বিস্তারের জন্য দায়ী করাটা সমীচীন যুক্তি হতে পারে না| সম্প্রতি তান্ডব চালানো সিত্রাঙ্ এর মত ঘূর্ণিঝড়, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ঝিরঝির বৃষ্টি বা নিম্নচাপ এই অঞ্চলের আবহাওয়ার অন্যতম বৈশিষ্ট্যর অংশ| ফলে সেটাকে ধরে নিয়েই, সব স্টেকহোল্ডারদেরকে সাথে নিয়ে ডেঙ্গুর উৎস নির্মূলে এবং ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের সমন্বিত কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত|
আবহাওয়ার প্রতিকূলতা দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে মানুষকে লার্ভা এবং অযাচিত স্বচ্ছ পানির আধার নষ্ট করার জন্য সচেতনমূলক প্রচারণার কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার| এক্ষেত্রে সোশ্যাল এবং পাবলিক মিডিয়া, মোবাইল ফোন কোম্পানির সরাসরি সহায়তা নেওয়া যেতে পারে| এছাড়াও অধিক ঝুঁকিপূর্ণ মানুষকে টিকার আওতায় নিয়ে আসার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রস্তাবনাকে কার্যকরী করার ক্ষেত্রে আশু পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারেও ইতিবাচক হওয়া উচিত|
লেখক: অধ্যাপক, ফলিত পরিসংখ্যান, পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সভাপতি, আই এস আর টি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন নির্বাহী কমিটি।
এইচআর/জেআইএম