মতামত

মানবাধিকার সুরক্ষা এবং বাংলাদেশের অঙ্গীকার

পঞ্চমবারের মতো জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের (ইউএনএইচআরসি) সদস্য নির্বাচিত হয়েছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ হলে এ-সংক্রান্ত ভোট হয়। ভোটে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৬০টি ভোট পেয়ে সদস্য নির্বাচিত হয়েছে বাংলাদেশ। নির্বাচনের ফল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবাধিকারের উন্নয়ন ও সুরক্ষায় বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতির প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতির প্রকাশ।

Advertisement

শুধু এবার নয়, জাতিসংঘের ৪৭ সদস্যের এই সংস্থায় এর আগে ২০০৬, ২০০৯, ২০১৪ ও ২০১৮ সালেও বাংলাদেশ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল। বিশ্বের অনেক দেশ মুখে মানবাধিকারের বুলি তুললেও বাংলাদেশ মানবাধিকারের সুরক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে এই ফল তারই প্রমাণ।

এর আগে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সাবেক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেটের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী জাতিসংঘের দৃষ্টিতে মানবাধিকার বা অন্যান্য বিষয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো উদ্বেগ প্রকাশিত হয়নি। যেসব দেশ ও অঞ্চলে মানবাধিকার এবং মানবিক অধিকার নিয়ে সমস্যা ও উদ্বেগ রয়েছে, সেটি তার সর্বশেষ রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে। ওই রিপোর্টে উল্লিখিত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের নাম নেই।

মিশেল ব্যাচেলেটের ওই রিপোর্টে গুম-খুনের মতো বিশেষ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা যেসব দেশে বিরাজমান, সে বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। রিপোর্টে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সর্বাধিক গুরুত্ব এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক মানবাধিকারের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। মিশেলের এই রিপোর্টে মূলত জাতিসংঘের দৃষ্টিতে গত চার বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির একটা মূল্যায়ন ফুটে উঠেছে।

Advertisement

মিশেল তার রিপোর্টে উল্লেখ করেন, তার এই মেয়াদকালে পৃথিবীর মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে। বৈশ্বিক কোভিড মহামারির অপরিসীম নেতিবাচক প্রভাব, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশে দেশে তীব্র খাদ্য, জ্বালানি ও আর্থিক সংকট- বর্তমান বিশ্বের প্রধান তিন ইস্যু।

সম্প্রতি জাতিসংঘের ৭৭তম অধিবেশনে যোগদান শেষে, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভয়েস অব আমেরিকায় এক সাক্ষাৎকারে বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘন নয় বরং সুরক্ষায় কাজ করছে বর্তমান সরকার। একসময় দেশের মানুষের মতপ্রকাশের কোনো অধিকার ছিল না। এখন মানুষ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সাবেক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট বাংলাদেশে আসার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর হাজার খানেক মানুষ বিনা বিচারে নিহত হয়। পুলিশ গুলি করে মেরে ফেলে। সে দেশে প্রতি বছর লক্ষাধিক লোক নিখোঁজ হয়, ওইটা নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথা নেই। আমরা চাই আমাদের দেশে প্রত্যেক অপরাধীর আইনের মাধ্যমে বিচার হবে।

তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, যেহেতু আমরা পলিটিক্যালি-স্ট্রাটিজিক্যালি খুব ভালো অবস্থানে আছি, আমাদের আশে পাশের বড় বড় দেশ আমাদের সমুদ্রে অ্যাকসেসের জন্য অনেক বেশি উদ্বিগ্ন, সেই জন্য এখন আমরা সবার চক্ষুশূল। মূল বিষয় কিন্তু হিউম্যান রাইটস না, আসল উদ্দেশ্য এটা নিয়ে একটা অংশের কিছু ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করা।

Advertisement

মানবাধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ জাতিসংঘে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে মতবিরোধ থাকলেও বাংলাদেশের সক্রিয় উদ্যোগে সংস্থাটির ৫০তম অধিবেশনে জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবাধিকার বিষয়ক একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। এই প্রস্তাবের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে এবং গুরুত্বপূর্ণ এই প্রস্তাবটি উপস্থাপনের জন্য বাংলাদেশের প্রশংসাও করা হয়।

২০০৮ সাল থেকে প্রতিবছর মানবাধিকার পরিষদে বাংলাদেশের উদ্যোগে জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবাধিকার বিষয়ক এ প্রস্তাবটি গৃহীত হয়ে আসছে। প্রস্তাবটিতে খাদ্য নিরাপত্তা ও মানুষের খাদ্যের অধিকারের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের চরম প্রভাবের প্রতি আলোকপাত করা হয়। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের অতি ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোতে লাখ লাখ মানুষের খাদ্যের অধিকার নিশ্চিতকরণে জরুরি পদক্ষেপের ওপর জোর দেয়া হয়।

এদিকে ২০১৭ সাল থেকে মিয়ানমার তাদের দেশের ২৫ হাজার রোহিঙ্গা নাগরিক হত্যা করে এবং শত শত গ্রাম মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ‘পুশ’ করে। যা মানবাধিকার ইতিহাসের জঘন্যতম অপরাধ। এসব রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় ও খাদ্য সহায়তা দিয়ে বাংলাদেশ মানবাধিকার রক্ষার সবচেয়ে বড় উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।

জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ২০২৩-২৫ মেয়াদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ নির্বাচনের এই ফল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মানবাধিকারের প্রচার ও সুরক্ষায় বাংলাদেশের অব্যাহত প্রচেষ্টা এবং অঙ্গীকারের আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতির সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ।

এটি বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে নেতিবাচকভাবে চিত্রিত করার লক্ষ্যে দেশে এবং বিদেশে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কতিপয় ব্যক্তিবর্গের দ্বারা মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য দিয়ে চলমান স্মারক প্রচারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে।

জাতিসংঘের একটি দায়িত্বশীল ও সক্রিয় সদস্য রাষ্ট্র এবং আগামী তিন বছরের জন্য নির্বাচিত ইউএনএইচআরসি সদস্য হিসেবে জাতীয় ও বিশ্বব্যাপী মানবাধিকারের প্রচার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। মানবাধিকার বিষয়ক বৃহত্তম আন্তর্জাতিক সংস্থার এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের মানবাধিকার প্রেক্ষাপট উন্নয়নের চলমান প্রচেষ্টাকে আরও পুনরুজ্জীবিত করবে।

লেখক: সংবাদকর্মী।

এইচআর/জেআইএম