দেশজুড়ে

নওগাঁয় কাজে আসছে না কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস বোর্ড

নির্ভরযোগ্য কৃষি আবহাওয়া বিষয়ক তথ্য কৃষকদের মাঝে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে নওগাঁয় স্থাপন করা হয় ‘কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস বোর্ড ও রেইনগেজ মিটার’। কিন্তু বোর্ডটি স্থাপনের চার বছরে কৃষকদের তেমন কোনো কাজে আসছে না। আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানতে না পারায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষক। এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস বোর্ডের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে কৃষি ও কৃষকের অভূতপূর্ব উন্নয়ন হবে, এগিয়ে যাবে অর্থনীতি।

Advertisement

কৃষি সার্ভিস তথ্য (এআইএস) সূত্রে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম সারিতে। কাজেই নির্ভরযোগ্য কৃষি আবহাওয়া বিষয়ক তথ্য কৃষকদের মাঝে সময়মতো পৌঁছে দেওয়া কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে প্রতিকূল আবহাওয়ার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে যেমন ফসল রক্ষা করা যাবে তেমন অনুকূল আবহাওয়াকে কাজে লাগিয়ে উৎপাদন খরচ কমানোর পাশাপাশি কৃষি উৎপাদন বাড়ানো যাবে। সে কারণেই বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সারা দেশব্যাপী ‘কৃষি আবহাওয়া তথ্যপদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করছে।

তথ্য বলছে, বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশব্যাপী কৃষি আবহাওয়া তথ্যপদ্ধতি উন্নতকরণ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় কৃষি আবহাওয়া ডিসপ্লে বোর্ডটি স্থাপন করা হয়েছে। নওগাঁর ১১ উপজেলার ৯৯টি ইউনিয়ন পরিষদের দেওয়ালে এসব বোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। এই কৃষি আবহাওয়া ডিসপ্লে বোর্ডের মাধ্যমে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বায়ুপ্রবাহ, ঝড়ের পূর্বাভাস এবং আলোকঘণ্টাসহ ১০টি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশের ব্যবস্থা আছে।

নিয়ম অনুযায়ী এই বোর্ডে ছয়দিনের (তিনদিন আগে ও পরে) হালনাগাদ তথ্য থাকার কথা। কিন্তু বোর্ড স্থাপনের পর থেকে তার কোনো কার্যক্রম নেই। এমনকী উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের বোর্ডটি হালনাগাদ করার কথা থাকলেও এ বিষয়ে তাদের কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। ফলে সরকারের এ প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়তে চলেছে। নষ্ট হতে চলেছে যন্ত্রপাতি।

Advertisement

চাষাবাদের সুবিধার জন্য কৃষকদের আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানা খুবই জরুরি। কোন মৌসুমে কখন কী ফসল রোপণ করা হবে বা ক্ষেতে সার-ওষুধ প্রয়োগ করা হবে তা আবহাওয়া পূর্বাভাসের বোর্ড থেকে কৃষকরা জানতে পারবেন। আবহাওয়া পূর্বাভাস না জানার কারণে হঠাৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়।

জানতে চাইলে মহাদেবপুর উপজেলার খাজুর ইউনিয়নের আলী দেওনা ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. এজাদ আলী বলেন, কৃষি আবহাওয়া ডিসপ্লে বোর্ডের বিষয়ে আমার জানা নেই। এছাড়া ওই বোর্ড কখনো চালু করা হয়নি। দেওয়ালে লাগানোর পর ওই অবস্থায় আছে। এ বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়নি। আবহাওয়া অফিসে ফোন দিয়ে তথ্য নিয়ে কৃষকদের জানানো হয়।

ওই ইউনিয়নের গ্রাম পুলিশ জিল্লুর রহমান বলেন, ওই বোর্ডটি লাগানোর পর কোনো কার্যক্রমই দেখছি না। কিসের জন্য এবং কেন লাগানো হয়েছে সেটাও আমরা জানি না।

খাজুর গ্রামের কৃষক আমিনুল ইসলাম বলেন, স্মার্টফোন ও টেলিভিশনের মাধ্যমে আবহাওয়া বিষয়ে জানতে পারি। ইউনিয়ন পরিষদে কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাসের যে বোর্ডটি স্থাপন করা হয়েছে, বোর্ডে প্রায় এক সপ্তাহের আবহাওয়ার খবর দেওয়ার কথা। কিন্তু তার কোনো কার্যক্রম আমরা কখনো দেখিনি।

Advertisement

তিনি বলেন, সব কৃষকের তো আর স্মার্টফোন নেই। তারা তো অবগত হবে না। যদি কৃষকদের নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কোনো বৈঠক করা হয় তাহলে তারা এ বোর্ডের মাধ্যমে আবহাওয়া বিষয়ে জানতে পারবে। এতে করে কৃষকরা দুর্যোগের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবে এবং উপকার হবে।

দারসা গ্রামের কৃষক রাজ্জাক বলেন, সামান্য জমিতে শাকের জন্য সরিষা লাগিয়েছি। লাগানোর পরই বৃষ্টি। তিন দফায় সরিষা নষ্ট হয়ে যায়। এখন গাছ উঠেছে তাতে পানি দেওয়া হচ্ছে। যদি এ বিষয়ে আগেই জানতাম তাহলে সরিষা লাগাতাম না। আবার এখন জমিতে কষ্ট করে সেচ দিতে হচ্ছে, তার ওপর যদি বৃষ্টি হয় তাহলেও ক্ষতি। কৃষি অফিস আবহাওয়া বিষয়ে জানালে আমাদের জন্য সুবিধা হবে।

সদর উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের এনায়েতপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল কুদ্দুস বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের দেওয়ালে একটি আবহাওয়া বোর্ড টাঙানো আছে। কিন্তু তার কোনো কার্যক্রম আমরা দেখি না। কোনো কর্মকর্তাও আমাদের বলেনি আসলে বোর্ডের কাজটা কী। এছাড়া আবহাওয়া বিষয়ে কৃষি অফিস থেকেও আমাদের কিছু জানানো হয় না।

এ বিষয়ে নওগাঁ সদর উপজেলার বক্তারপুর মডেল ইউনিয়ন পরিষদ সচিব আব্দুল মতিন বলেন, কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাসের বোর্ড থাকলেও কখনো আপডেট এবং কার্যক্রম করা হয়নি। এমনকী এ নিয়ে কখনো কোনো সভায় আলোচনাও হয়নি। তবে এ বোর্ড চালু করা হলে কৃষকদের জন্য সুবিধা হবে।

বক্তারপুর মডেল ইউনিয়ন পরিষদের হালঘোষপাড়া ব্লক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যখন কোনো বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয় আসে তখন আবহাওয়া অফিস থেকে জেনে ওই বোর্ডে কলম দিয়ে লিখে দেওয়া হয়। তবে ডিসপ্লে বোর্ডের যেসব পয়েন্ট আছে সেগুলোর কোনো কাজ করা হয় না। কারণ এ বিষয়ে আমাদের কোনো প্রশিক্ষণ নেই।

একই ইউনিয়নের বাচারীগ্রাম ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলেন, বৃষ্টি পরিমাপক যন্ত্র রেইনগজ মিটার থেকে ব্লুটুথের মাধ্যমে সাতদিনের বৃষ্টির পরিমাপ পাওয়া যায়। তবে এখানে থাকা যন্ত্রটি অনেক দিন থেকে আর কাজ করছে না। এ যন্ত্রটিতে পাওয়ার সাপ্লাইয়ের যে সোলার প্যানেল থাকার কথা তা নেই। আগে হয়ত ছিল। আমি এ ব্লকে যোগদানের পর থেকেই দেখিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আবু হোসেন বলেন, প্রতিটি ইউনিয়নে ‘কৃষি আবহাওয়া তথ্যপদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্পের’ আওতায় কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস বোর্ড ও রেইনগজ মিটার স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে এনালগ বা ম্যানুয়াল বোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের পরিমাণ লিপিবদ্ধ থাকার কথা। তবে যে কারণেই হোক সেটার কার্যক্রম চালু হয়নি বা ব্যবহার হয়নি।

প্রকল্পের পরিচালক ড. মো. শাহ কামাল খানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে কৃষি আবহাওয়া ডিসপ্লে বোর্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে মিটিংয়ে ব্যস্ততার কথা জানান। পরে অফিসে গিয়ে সরাসরি সাক্ষাৎ করতে বলেন তিনি।

এমআরআর/জিকেএস