বিনোদন

রোদন ভরা এ বসন্তে তোমায় মনে পড়ে

হুমায়ূন পাঁচজন আছেন, ফরিদী একজনই। সর্বজন শ্রদ্ধেয় অভিনেতা হামায়ূন ফরিদীকে নিয়ে এভাবেই বলেছিলেন নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। রাজনীতিবিদ হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, দৈনিক বাংলার সম্পাদক আহমেদ হুমায়ূন, অধ্যাপক এবং কবি হুমায়ূন আজাদ, অভিনেতা হুমায়ূন ফরীদি এবং নিজের কথা উল্লেখ করে এই কথা বলেছিলেন তিনি। সত্যি তাই। অনেক হুমায়ূনের ভিড়ে আমাদের ফরিদী ছিলেন একজনই। তেমনি বলা যায়, অনেক অভিনেতার ভিড়েও ফরিদী একজনই। জীবনভর শুধু অভিনয়ই করে গেছেন। নিজেই বলতেন ‘অভিনয় ছাড়া আর কিছুই পারি না আমি’। ভীষণ কৌতুকপ্রিয় মানুষ ছিলেন। নাটকের সেটে সদা সবাইকে কৌতুকে মাতিয়ে রাখতেন। এত কৌতুক মনে রাখেন কীভাবে, প্রশ্নের উত্তরে একবার বলেছিলেন, ‘জীবনটাই তো কৌতুক, আমরা কেউ থাকব না, থাকবে শুধু কৌতুক।’ নিজের জীবনের সাথে কৌতুক করতে করতে অস্তাচলে যাওয়া হুমায়ূন ফরিদীর অভাব কখনোই পূরণ হবার নয়। হচ্ছেও না। সবখানে ফরিদী অভাব বোধ! তার চলে যাওয়ার দিনে যেন সেই অভাব আরো বেশি করে অক্টোপাসের মতো পেঁচিয়ে ধরে। মন খারাপ হয় খুব। আগুন লাগা এই ফাগুনও পারে না ফরিদীর প্রয়াণ দিবস ম্লান করে দিতে। তাই মঞ্চ থেকে চলচ্চিত্র- অভিনয়ের সবখানেই আজ নীরব শোক চলে অবিরাম।একদিকে আজ রুক্ষতাকে বিদায় দিয়ে সবুজাভ পৃথিবীর বার্তা নিয়ে দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে ঋতুরাজ বসন্ত। কৃষ্ণচূড়ার রঙ আজ একটু বেশিই লাল। কোকিলেও যেন মাদকতা ভর করেছে মাতাল বাতাসে। উদাসী মন নিয়ে আজ বাঙালি কাটাবে বসন্তের প্রথম দিন। তারই ভিড়ে অন্যদিকে কেউ কেউ আজ ভীষণ মন খারাপ করবেন প্রিয় মানুষ, প্রিয় অভিনেতা, প্রিয় বন্ধু, প্রিয় সঙ্গীর স্মরণে। আজ হুমায়ূন ফরিদীর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী! দেখতে দেখতে দিন কতো দ্রুত চলে গেল। ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ফাগুনের আগুনে বিষাদের কালো আঁভা ছড়িয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন অভিনয়ের কিংবদন্তী পুরুষ হুমায়ুন ফরিদী। কাঁদিয়েছিলেন কোটি ভক্তকে। সেদিন ফরিদীর বাসভবন পরিণত হয়েছিলো মানুষের সমুদ্রে। শোবিজের নানা অঙ্গনের মানুষেরা সেদিন লোক লজ্জা ভুলে আহাজারি করে কেঁদেছিলেন ফরিদীর জন্য। এভাবে আর কোনো শিল্পীর জন্য কান্না দেখেনি এদেশের মানুষ। হয়তো ব্যক্তিজীবনে খুব বেশি একা ছিলেন বলেই অনেক বেশি মানুষের প্রিয় ছিলেন তিনি।চরিত্র থেকে চরিত্রে ভিন্নতা নিয়ে এই মানুষটি হয়ে উঠেছিলেন ভার্সেটাইল। অভিনয়ের সাবললীতায় মঞ্চ থেকে ছোট কিংবা বড় পর্দায় কোটি মানুষকে মোহিত করেছেন এই অভিনেতা। অভিনয় দিয়ে মানুষকে কাঁদিয়েছেন, হাসিয়েছেন আবার ক্রোধে জ্বালিয়েছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন অভিনেতা কমই এসেছে যে কিনা একই সাথে মঞ্চ, টিভি এবং চলচ্চিত্রে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন।শিল্পী হুমায়ুন ফরিদীর জন্ম ২৯ মে, ১৯৫২, নারিন্দা, ঢাকা। বাবা এ.টি এম নুরুল ইসলাম ছিলেন জুরী বোর্ডের কর্মকর্তা। বাবার বদলির চাকরীর সুবাদে ফরিদীকে মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, কিশোরগঞ্জ, মাদারীপুরসহ অসংখ্য জেলায় ঘুরতে হয়েছে। মা বেগম ফরিদা ইসলাম গৃহিনী। ছোটবেলায় ছন্নছাড়া স্বভাবের জন্য ফরিদীকে ‘পাগলা’, ‘সম্রাট’, ‘গৌতম’-এমন নানা নামে ডাকা হত ফরিদীকে। প্রাথমিক শিক্ষা নিজ গ্রাম কালীগঞ্জে। মাদারীপুর ইউনাইটেড ইসলামিয়া গভর্নমেন্ট হাই স্কুল পাস দিয়ে চাঁদপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হন। ১৯৭০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্গানিক কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হলেন। এলো একাত্তুর, চলে গেলেন যুদ্ধে। নয় মাসের যুদ্ধ পরে লাল-সবুজের পতাকা হাতে ঢাকায় ফিরলেও ঢাকা ভার্সিটিতে ফেরেননি। টানা পাঁচ বছর বোহেমিয়ান জীবন কাটিয়ে শেষে অর্থনীতিতে অনার্স-মাস্টার্স করলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। অনার্সে তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বিশিষ্ট নাট্যকার সেলিম আল দীনের সংস্পর্শে আসেন। এই ক্যাম্পাসেই ‘আত্মস্থ ও হিরন্ময়ীদের বৃত্তান্ত’ নামে একটি নাটক লিখে নির্দেশনা দেন এবং অভিনয়ও করেন ফরিদী। ছাত্রাবস্থায়ই ১৯৭৬ সালে তিনি ঢাকা থিয়েটারের সদস্য হন। জড়িয়ে যান মঞ্চের সাথে। সেলিম আল দীনের ‘সংবাদ কার্টুন’-এ একটি ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় করে ফরিদী মঞ্চে উঠে আসেন। অবশ্য এর আগে ১৯৬৪ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে কিশোরগঞ্জে মহল্লার নাটক ‘এক কন্যার জনক’-এ অভিনয় করেন। মঞ্চে তার সু-অভিনীত নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘শকুন্তলা’, ‘ফনিমনসা’, ‘কীত্তনখোলা’, ‘মুন্তাসির ফ্যান্টাসি’, ‘কেরামত মঙ্গল’ প্রভৃতি। ১৯৯০ সালে স্ব-নির্দেশিত ‘ভূত’ দিয়ে শেষ হয় ফরিদীর ঢাকা থিয়েটারের জীবন।আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় ‘নিখোঁজ সংবাদ’ ফরিদীর অভিনীত প্রথম টিভি নাটক। যারা দেখেছেন বিটিভি’র ‘ভাঙ্গনের শব্দ শুনি’ (১৯৮৩) নাটকে সেরাজ তালুকদারের কথা মনে আছে নিশ্চয়। সেলিম আল দীনের রচনা ও নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর পরিচালনায় এই নাটকে ফরিদীকে দেখা যায় টুপি দাড়িওয়ালা শয়তানের এক জীবন্ত মূর্তি রূপে। ‌‌‘আরে আমি তো জমি কিনি না, পানি কিনি, পানি’ কিংবা ‘দুধ দিয়া খাইবা না পানি দিয়া খাইবা বাজান’-এই সংলাপগুলো এখনও মন ছুঁয়ে যায়। সেগুলো নাকি আশির দশকে ভীষণ জনপ্রিয় ছিলো। এরপর শহীদুল্লাহ কায়সারের ‘সংশপ্তক’ (১৯৮৭-৮৮)-এ ‘কান কাটা রমজান’ চরিত্রে-ফরিদীর অনবদ্য অভিনয় কেউ ভোলে নি। ভুলা কি যায়! অসম্ভব! ‘দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা’, ‘একটি লাল শাড়ি’, ‘নীল নকশার সন্ধানে’ (১৯৮২), ‘দূরবীন দিয়ে দেখুন’ (১৯৮২), ‘বকুলপুর কতদূর’ (১৯৮৫)’, ‘মহুয়ার মন’ (১৯৮৬), ‘সাত আসমানের সিঁড়ি’ (১৯৮৬) ‘একদিন হঠাৎ’ (১৯৮৬), ‘ও যাত্রা’ (১৯৮৬) ‘পাথর সময়’, ‘সমুদ্রে গাঙচিল’ (১৯৯৩), ‘চন্দ্রগ্রন্থ’ (২০০৬), ‘কাছের মানুষ’ (২০০৬), ‘ে কোথাও কেউ নাই’ (১৯৯০), ‘মোহনা’ (২০০৬), ‘ভবেরহাট’ (২০০৭), ‘জহুরা’,‘আবহাওয়ার পূর্বাভাস’, ‘প্রতিধ্বনি’, ‘শৃঙ্খল’ (২০১০), ‘প্রিয়জন নিবাস’ (২০১১), ‘অক্টোপাস’, ‘আরমান ভাই দি জেন্টেলম্যান’ (২০১১)-আরো আরো অনেক নাটকে বিরামহীনভাবে দর্শকদের হাসিয়েছেন, কাঁদিয়েছেন। উত্তেজনার উত্তুঙ্গে নিয়ে দর্শক-শ্রোতাকে দিবা-নিশি মাতিয়ে রেখেছেন। অসম্ভব ইম্প্রোভাইজ করতে পারতেন। কখনোই স্ক্রিপ্টের গণ্ডিতে আটকা থাকেননি। টেলিভিশন নাটকের সব আঙ্গিক ভেঙ্গে গড়ে তোলেন নতুন ধারা।নব্বইয়ের গোড়া থেকেই হুমায়ুন ফরিদীর বড় পর্দার জীবন শুরু হয়। বাণিজ্যিক আর বিকল্প ধারা মিলিয়ে প্রায় ২৫০টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। এরমধ্যে প্রথম ছবি তানভীর মোকাম্মেলের ‘হুলিয়া’। এরপর তার অভিনীত সিনেমার মধ্যে ‘সন্ত্রাস’, ‘বীরপুরুষ’, ‘দিনমজুর’, ‘লড়াকু’, ‘দহন,’ ‘বিশ্বপ্রেমিক’, ‘কন্যাদান’ (১৯৯৫), ‘আঞ্জুমান’ (১৯৯৫), ‘দুর্জয়’ (১৯৯৬), ‘বিচার হবে’ (১৯৯৬),‘মায়ের অধিকার’ (১৯৯৬) ‘আনন্দ অশ্র“’ (১৯৯৭), ‘শুধু তুমি’ (১৯৯৭), ‘পালাবি কোথায়’, ‘একাত্তুরের যীশু’, ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’, ‘মিথ্যার মৃত্যু’. ‘বিদ্রোহ চারিদিকে, ‘ব্যাচেলর’ (২০০৪), ‘জয়যাত্রা’, ‘শ্যামল ছায়া’ (২০০৪), ‘রূপকথার গল্প’ (২০০৬), ‘আহা!’ (২০০৭), ‘প্রিয়তমেষু’ (২০০৯) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। নেগেটিভ, পজেটিভ অর্থাৎ নায়ক-খলনায়ক দু চরিত্রেই তিনি ছিলেন সাবলীল, এক কথায় ভার্সেটাইল। এক সময়ে মানুষ আর নায়ককে না, এক ভিলেনকে দেখতেই হলে যেতেন। সেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী খলনায়ক ছিলেন ফরিদী। এমন বিরল ইতিহাস আর কোনো চলচ্চিত্র খল অভিনেতা দেখাতে পারেননি। তার অভিনীত শেষ চলচ্চিত্র ‘এক কাপ চা’ ২০১৪ সালে মুক্তি পায়। তখন তিনি বড় পর্দায় অনিয়মিত। হুমায়ূন ফরিদী আবৃত্তিকার হিসেবেও ছিলেন অসাধারণ। তার ভরাট কণ্ঠে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘উত্তরাধিকার’ কবিতার আবৃত্তি আজও কবিতা প্রেমীদের হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়। ‘নবীন কিশোর, তোমাকে দিলাম ভুবনডাঙ্গার মেঘলা আকাশ’ তার কণ্ঠে যতটুকু মানায়, সম্ভবত আর কারও কাছেই এত সহজে মানায় না। নাটকে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি মেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মাননা। আর ২০০৪ সালে ‘মাতৃত্ব’ ছবিতে সেরা অভিনেতা হিসাবে পান ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’। তবে রাষ্ট্র তাকে সম্মান জানাতে পারেনি। এ নিয়ে হুমায়ূন ফরিদীর কোনো ক্ষোভ তো দূরের কথা আগ্রহও দেখা যায়নি। তবে তার ভক্ত-অনুরাগীরা বরাবরই এই কিংবদন্তি অভিনেতার প্রতি রাষ্ট্রের উদাসীনতার বড় সমালোচক। এমনকি হুমায়ূন আহমেদও আক্ষেপ করেছিলেন পঞ্চ হুমায়ূনের সবাই একুশে পদক পেলেও হুমায়ূন ফরিদীকে এই সম্মান দেয়া হয়নি বলে।বয়েই গেল! আলোচনায় ফরিদী কোনোদিন ছিলেন না, এখনো নাই। তিনি ঠাঁই নিয়েছেন কোটি ভক্তের হৃদয়ে, মগজে। ফরিদী আছেন পৃথিবীর সব নাট্যমঞ্চের ড্রেসিং রুমে, পাটাতনে আছেন রূপোলি পর্দার সামনে-আড়ালে আছেন, থাকবেন অনন্তকাল। আর কে পারে এমন করে বসন্তকে কাঁদাতে! কে পেরেছে?এলএ

Advertisement